টাটাকে এয়ার ইন্ডিয়া ‘উপহার’ বিজেপি সরকারের

মাত্র ১৮ হাজার কোটি টাকায় এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রির চুক্তি হচ্ছে। তার মধ্যে টাটা সন্স (টাটা গোষ্ঠীর মূল সংস্থা) ১৫,৩০০ কোটি টাকার ঋণের বোঝা নেবে। ফলে সরকারের ঘরে নগদ আসছে মাত্র ২,৭০০ কোটি টাকা। বাস্তবে এই সামান্য অর্থের বিনিময়ে বিজেপি সরকার টাটার হাতে এয়ার ইন্ডিয়া উপহার হিসেবে তুলে দিল।

এই টাকার বিনিময়ে টাটারা কী পাবে? এয়ার ইন্ডিয়ার কাছে শুধু বিমানই আছে ৩২ হাজার কোটি টাকার। এর সাথে এয়ার ইন্ডিয়ার অন্যান্য প্রধান সম্পত্তিগুলি– মহার্ঘ ল্যান্ডিং ও পার্কিং স্লট, আন্তর্জাতিক উড়ানের অধিকার, উড়ানের জগতে ‘এয়ার ইন্ডিয়া’ ব্র্যান্ড ব্যবহারের সুযোগ, এর সব কিছুই টাটারা পাবে বিনামূল্যে।

এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রির প্রধান সরকারি যুক্তি ছিল, এই সংস্থা একসময় লাভজনক থাকলেও, এখন ঋণের বোঝায় চলতে পারছে না। যদিও এয়ার ইন্ডিয়ার লোকসানের পিছনে প্রধানমন্ত্রী সহ ভিআইপিদের জন্য রাজকীয় পরিষেবা দেওয়া, সরকারের পেটোয়া আমলা ও রাজনীতিকদের পুরস্কার হিসাবে তাদের রাজকীয় সুবিধা দিয়ে সংস্থার মাথায় বসিয়ে রাখতে গিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার তহবিল খালি হয়েছে। এছাড়া সবচেয়ে জনপ্রিয় রুটগুলি ক্রমাগত সস্তার বেসরকারি কোম্পানির হাতে দেওয়া হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ার ভাড়া ক্রমাগত বাড়িয়ে তাকে অনাকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। এগুলো সবই পরিকল্পিত পদক্ষেপ, যাতে এই সংস্থা দুর্বল হয়। ভারত সরকার ১৯৪৮ সালে এয়ার ইন্ডিয়া অধিগ্রহণ করে এবং ১৯৫৩ সালে এটি জাতীয়করণ করা হয়। সেই সময় থেকে সরকার এই সংস্থাটি গড়ে তুলতে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা খরচ করেছে। শুধু ২০০৯-১০ সালেই এই কাজে সরকার ১ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছিল। অথচ সেই সরকারি সম্পত্তি মাত্র ১৮ হাজার কোটি টাকায় বেচে দেওয়া হল। আরও অবাক করার মতো বিষয় হল, এয়ার ইন্ডিয়ার ৬৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের ৪৬ হাজার ২৬২ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকারই বহন করবে বলে ঘোষণা করেছে। এয়ার ইন্ডিয়া প্রাইভেট হয়ে গেল, কিন্তু তার ঋণ প্রাইভেট হল না। অথচ বেসরকারি হাতে বেচে দেওয়ার জন্য বিপুল ঋণকেই যুক্তি হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। ঋণটাই যদি সরকার ঘাড়ে নেয়, তা হলে বেচে দেওয়ার যুক্তি কী? এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আপনার-আমার ট্যাক্সের টাকাতেই পরিশোধ করা হবে। প্রয়োজনে জীবন-যন্ত্রণায় জর্জরিত জনসাধারণের ওপর করের বোঝা আরও বাড়ানো হবে। শুধু তাই নয়, এর ফলে সংস্থার হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর চাকরি অসুরক্ষিত হয়ে পড়বে এবং একই সাথে এঁদের পরিবারের সদস্যদেরও জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

সরকারি সংস্থা ও সরকারি ক্ষেত্রের সর্বাত্মক বেসরকারিকরণ বিজেপি পরিচালিত বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত নীতি। রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা সহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বেচে দেওয়ার জন্যই সরকারের ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন প্রকল্প। এই প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবেই এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণ। এভাবেই জনগণের অর্থে গড়ে ওঠা সম্পত্তি বৃহৎ কর্পোরেট মালিকদের হাতে সরকার তুলে দিচ্ছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর এবারের বাজেটে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি বেচার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছেন। এ ছাড়া নাকি সরকারের রাজকোষ ঘাটতি সামাল দেওয়া যাবে না!

কিন্তু জনগণকে সরকার কী দিয়েছে? জনগণের জন্য সুবিধা দিতে গিয়ে কি ঘাটতি হয়েছে? তা তো নয়, বরং সরকার জনগণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় কমিয়েছে, বাড়িয়েছে পুঁজিপতিদের জন্য নানা সুবিধা। ফলে কোষাগার ঘাটতির কারণ পুঁজিপতিদের ভেট দেওয়ার জন্য জনগণের করের টাকা জলের মতোঢেলে দেওয়া। জনগণকে শুষে নিয়ে নিংড়ে পিষে ছিবড়ে করে ফেলার অবাধ মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠছে ভারত। বিজেপি সরকারের মালিকতোষণকারী মানুষমারা জনবিরোধী এই নীতির বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনসাধারণের সোচ্চার হওয়া ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে এগিয়ে আসা ছাড়া আজ আর বিকল্প কোনও পথ নেই।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ১৫ সংখ্যা ১৯ নভেম্বর ২০২১