‘চৌকিদার’ কিংবা ‘জনতা কি সিপাহি’, মানুষের চোখে দু’জনেই প্রতারক

পাঁচ বছর পার করে নরেন্দ্র মোদি আবার ভোট চাইতে নানা সাজে অবতীর্ণ৷ ‘আচ্ছে দিন’, ‘বিকাশ’, চাষির আয় দ্বিগুণ করে দেওয়া, বছরে দু’কোটি  চাকরি,  কালো  টাকা  উদ্ধার, ‘না খাউঙ্গা–না খানে দুঙ্গা’– এ সব কোনও কিছুই এখন তাঁর গলায় আর শুনতে পাওয়ার জো নেই৷ এখন তিনি রাজস্থান–গুজরাটের পোস্টারে শোভিত হচ্ছেন গলায় বুলেটের মালা ঝোলানো, বন্দুকধারী এক নতুন অবতার রূপে৷ এখন তাঁর ভরসা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা উগ্র–দেশপ্রেমের জিগির আর তীব্র সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ভিত্তিতে বিদ্বেষ ও ঘৃণার বাতাবরণে সৃষ্ট ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি৷ তাই পাঁচ বছর নানা প্রতিশ্রুতির ফানুস ওড়ানো বিজেপি সরকারের রাজত্বের পর ‘এডেলম্যানস ট্রাস্ট ব্যারোমিটার’ নামক সমীক্ষা দেখাচ্ছে ভারতের ৭২ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ কোনও ভাল মাইনের কাজের আশাই ছেড়ে দিয়েছেন৷ দেশের অধিকাংশ মানুষ একটু সুখে থাকার আশা আর করেন না৷ ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ সরকার, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমনকী এনজিওগুলিকেও এতটুকু বিশ্বাস করতে পারছেন না৷ স্বঘোষিত চৌকিদার প্রধানমন্ত্রী কিংবা আর এক স্বঘোষিত ‘জনতা কি সিপাহি’ কংগ্রেস সভাপতি ইত্যাদি কোনও ভোটবাজ দলের নেতাকেই অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন না৷ তাদের প্রতারক মনে করেন তাঁরা৷

এর জন্য দায়ী কে? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি হবে আর তিন বছর পরে৷ এর মধ্যে দেশ চালিয়েছে হয় কংগ্রেস, না হলে বিজেপি অথবা এই দুই দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনপুষ্ট নানা রঙের দল৷ স্বাধীনতার পর কংগ্রেস নাকি সব কালোবাজারিকে ল্যাম্প পোস্টে ঝুলিয়ে ফাঁসি প্রায় দিয়েই দিচ্ছিল তারপর ইন্দিরা গান্ধীর আমলে গরিবি হটিয়ে দেশকে কেমন সোনায় মুড়ে দিয়েছিল, সে অভিজ্ঞতাও মানুষের আছে৷ তারপর বিজেপির নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি ভারতবাসীকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘ফিল গুড’– খেতে যদি নাও পান, আনন্দ অনুভব করুন৷ কিন্তু দেশের মানুষ এমনই ‘অকৃতজ্ঞ’ যে এতবড় উপদেশটাকে না মেনে পেঁয়াজের দাম কেন ১০০ টাকা ছাড়াল, সরষের তেলের দাম কেন আকাশ ছোঁয়া, মানুষের চাকরি কেন নেই, এই সব নিয়ে বিক্ষোভে নেমে পড়ল এখন নরেন্দ্র মোদি এসে তো এমন ভাব দেখাচ্ছেন যে, সব সমস্যা একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি কেমন সে হাল? সম্প্রতি প্রকাশিত অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনাল সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্টই তার পর্দা একেবারে ফাঁস করে দিয়েছে৷

মোদি সাহেবের ‘আচ্ছে দিনে’ ভারতের ৭৩ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে ১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে৷ অন্যদিকে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৩ নম্বরে৷ কিছুদিন আগে সরকারি সমীক্ষা দেখিয়েছিল জনসংখ্যার ৭৭ শতাংশ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে৷ এ দেশের সদ্য প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি স্বীকার করেছেন, ১২৩ কোটি ভারতীয়ের ৬৬ কোটিই কর্মহীন৷ ঠিক এর বিপরীত চিত্র হল, ভারতীয় ধনকুবেরদের শীর্ষে থাকা মুকেশ আম্বানির ২০১৮ সালে আয় ছিল দিনে ৩০০ কোটি টাকা৷ ভারতের ১১৯ জন বিত্তবান মানুষের সম্পদ আচ্ছে দিনের সুবাদে বেড়েছে বছরে ৩৯ শতাংশ হারে, আর একই ভারতে নিম্নতম আয়ের ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষের রোজগার বেড়েছে মাত্র ৩ শতাংশ৷ আর্থিক বৈষম্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে খরচ, শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা এবং মানুষের ন্যূনতম আয় বজায় রাখার নিরিখে বিশ্বের শেষ ১১ দেশের মধ্যে স্থান নিয়েছে ‘আচ্ছে দিন’–এর ভারত৷

নরেন্দ্র মোদি সরকারে বসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বছরে ২ কোটি চাকরি দেবেন৷ কর্পোরেট পুঁজি মালিকদের হাতে থাকা সংবাদমাধ্যমের প্রচারের জোরে দেশের মানুষ তো তাঁকে বিশ্বাসই করেছিলেন অথচ তাঁরা দেখছেন নতুন চাকরি দূরের কথা, গত এক বছরে কর্মরত মানুষের সংখ্যা কমেছে৷ এক বছরে কাজ থেকে ছাঁটাই হয়েছেন ৪ কোটি ৭০ লক্ষ (ডেকান হেরাল্ড ২২ মার্চ, ২০১৯)৷ নরেন্দ্র মোদি নিজে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডে খোলা নতুন অ্যাকাউন্ট প্রমাণ করছে ২ কোটি চাকরি হয়েছে৷ তাঁর ধামাধরা পারিষদ তথা মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা আবার প্রভুকে খুশি করতে বলে দিয়েছেন, বিজেপি জমানায় ৬ কোটি নতুন চাকরি হয়েছে৷ এটা যে একেবারে ডাহা মিথ্যা তা দেখিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ন্যশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন (এনএসএসও)–র সমীক্ষা৷ এই সমীক্ষা দেখিয়েছে দেশে বেকারির হার বিগত ৪৫ বছরে সর্বাধিক৷ এনএসএসও বেকারত্বের হার জনসংখ্যার ৬.১ শতাংশ বলায় মোদি সরকার সেই রিপোর্ট প্রকাশ করতে দেয়নি৷ অথচ সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই) সমীক্ষায় বলেছে, এই বেকারত্বের হার আরও বেশি, জনসংখ্যার ৭.২ শতাংশ৷ সংখ্যার দিক থেকে যা হয় ৯ কোটি ৩৬ লক্ষ৷ কিন্তু এই পরিসংখ্যানওদেশের ভয়াবহ বেকার সমস্যার পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়৷

কেন্দ্রীয় লেবার বুরো প্রতি বছর শ্রম ক্ষেত্রে সমীক্ষা চালিয়ে ‘এমপ্লয়মেন্ট আনএমপ্লয়মেন্ট– সিনারিও’ নামে রিপোর্ট তৈরি করে৷ ২০১৭–১৮ সালে সেই রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি৷ কারণ ২০১৫ সালে লেবার বুরো দেখিয়েছিল ভারতে কাজের বাজারে আসে জনসংখ্যার মাত্র ৬১ শতাংশ বা প্রায় ৮০ কোটি মানুষ৷ অর্থাৎ দেশের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৫০ কোটি কাজ পাওয়ার আশাই করেন না৷ এঁদের মধ্যে বিরাট সংখ্যায় মহিলা যাঁরা বিনা পারিশ্রমিকে পরিবারের গৃহস্থালী বা চাষে এবং অন্যত্রও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন৷ প্রথমোক্ত ৮০ কোটির মধ্যে ৩৯ শতাংশই স্বনিযুক্ত৷ অর্থাৎ পকোড়া ভাজা থেকে শুরু করে ছোটখাটো দোকান, হকারি, মাথায় করে জিনিস ফেরি ইত্যাদি করে টিকে থাকেন৷ এদের বেশিরভাগই বলার মতো কোনও রোজগার করেন না৷ সরকার এই সংখ্যাকে যতই কর্মসংস্থান বলুক, কোনও সুস্থ মানুষ এটাকে কাজ বলে মানতে পারেন না৷ ৩৬.৬ শতাংশ মাঝে মাঝে কাজ পান, ১৯ শতাংশ মজুরির ভিত্তিতে কিছুটা নিয়মিত কাজ করেন, বাকি ৫.৪ শতাংশ একেবারেই কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী৷ শ্রম মন্ত্রকের ২০১৫–১৬’র রিপোর্ট বলছে, দেশের ৭৭ শতাংশ পরিবারের নিয়মিত রোজগারের মতো কাজ নেই৷ তাহলে, সরকারি হিসাবেই দেশের কর্মক্ষম মানুষের বেশিরভাগটাই বাস্তবে জীবন নির্বাহ করার মতো কাজ পান না৷ এর পরেও মানুষ বিজেপিকে বিশ্বাস করবে, প্রতারক বলবে না? কংগ্রেসের রাজত্ব সম্বন্ধেও মানুষের ধারণা আছে৷ তখনকার তীব্র বেকার সমস্যার জ্বালা দেশের জনগণ ভুলতে পারে না৷ সেই কংগ্রেস যখন বছরে ৭২ হাজার টাকার টোপ দিয়ে ভোট চায়– তাকেও কেন প্রতারক বলবে না দেশের মানুষ?

ভোটের ময়দানে দাঁড়িয়ে রঙ বে–রঙের নেতারা যতই প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছোটান না কেন, তা বিশ্বাস করলে যে ঠকতে হয় তা বারবার দেখেছে দেশের মানুষ৷ বিজেপি সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বহর মানুষ সদ্য দেখছে, ফলে তাদের ঠগবাজ চরিত্র জনমানসে জ্বলজ্বল করছে৷ সেই সুযোগে এখন কংগ্রেস সাধু সাজার প্রতিযোগিতায় নেমেছে৷ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলও এই প্রতিযোগিতায় নেমে মুখে মুখে লক্ষ লক্ষ চাকরির গল্প বলে যাচ্ছে৷ অথচ এ রাজ্যের মানুষের অভিজ্ঞতা, কাজ মানে মুখ্যমন্ত্রীর চপ ভাজার উপদেশ,  ২ হাজার টাকার ইন্টার্ন শিক্ষক, না হলে অস্থায়ী সিভিক পুলিশ– এর বেশি কোনও কাজের দিশা রাজ্যের যুবকদের দেখায়নি তৃণমূল কংগ্রেস৷ রাজ্যে সরকারি স্থায়ী কাজে নিয়োগ প্রায় বন্ধ, যেমন বন্ধ অসংখ্য শিল্প–কলকারখানা৷ মানুষের অভিজ্ঞতা হল বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিএমও অতীতে ক্ষমতায় থাকার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে মিথ্যা শিল্পায়নের খোয়াব দেখাতে চেয়েছে৷ বেকার সমস্যার প্রকৃত সমধানের রাস্তা তুলে না ধরে মানুষকে বুঝিয়েছে, ‘সিপিএমকে ভোট দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷’

আবার একটা ভোটের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষকে তাই বুঝতে হবে, বারবার এই দলগুলি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবে৷ এরা প্রত্যেকেই একই ভারতীয় পঁুজিপতি শ্রেণির ছোট–বড় রাজনৈতিক ম্যানেজার৷ সেই ভূমিকা পালন করতেই এরা ভোট মঞ্চে নানা রঙের কুশীলব হিসাবে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছে৷ ভোটের ডামাডোলেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বুঝতে হবে, এই ভোটবাজ দলগুলি শোষক পঁুজিপতি শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করে চলেছে৷ এরা কেউ সাধারণ মানুষের পক্ষে নয়, শোষকের পক্ষে৷ এই অবস্থায় সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায় করা ছাড়া জনসাধারণের সামনে বিকল্প কোনও পথ নেই৷ দেশের নানা প্রান্তে সেই আন্দোলন স্ফুলিঙ্গ রূপে ফেটেও পড়ছে৷ প্রয়োজন সঠিক রাজনৈতিক পথের দিশা৷ নির্বাচনী লড়াইয়ের মধ্য দিয়েও মার্কসবাদ–লেনিনব ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে সেই পথের দিশাকেই তুলে ধরছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা)