ক্লাসরুম শিক্ষায় ‘ধীরে চলো’ নীতি কী উদ্দেশ্যে

গত এপ্রিল থেকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ২০২০-র শিক্ষাবর্ষ কেটে গেল কার্যত শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ছাড়াই। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অনলাইনে পাঠদান কোনও ক্রমে চালিয়ে ফলাফলও ঘোষণা করে দিয়েছে। স্কুল স্তরে সকলকে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সকলকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে সিলেবাস কমানো হয়েছে। যার ফল উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে ভুগতেই হবে। সকলেই উপলব্ধি করছেন, এ ক্ষতি আর দীর্ঘায়িত করা চলে না। উদ্বিগ্ন অভিভাবক, শিক্ষক, ছাত্রদের বৃহৎ অংশের দাবি– উঠছে স্কুল খুলুক, ক্লাসরুম পড়াশোনা চালু হোক। কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য কোনও সরকারেরই এ বিষয়ে হেলদোল নেই। জানুয়ারি পার হয়ে গেল, অথচ নতুন শিক্ষাবর্ষে ক্লাস শুরুর কোনও লক্ষণ নেই। তবে কি অনলাইনেই চলবে শিক্ষা? সেই উদ্দেশ্যেই কি প্রাথমিক শিক্ষকদের অনলাইন শিক্ষার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা? সেই উদ্দেশ্যেই কি ট্যাব কেনার জন্য দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের দশ হাজার করে টাকা দেওয়ার ঘোষণা?

‘অনলাইন শিক্ষা প্রথাগত শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না’, এক সাক্ষাৎকারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অফ এডুকেশনের প্রাক্তন ডিন অনিতা রামপল।

কথাটি সত্য। ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের কাছ থেকে যতটুকু শেখার সুযোগ পায়, অনলাইন ক্লাসে তা সম্ভব নয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা যে স্বকীয়তা নিয়ে, বিশেষ বিশেষ ছাত্রের অবস্থা বুঝে যে বিশেষ বিশেষ সৃজনশীল ভূমিকা নিয়ে পড়াতে পারেন, অনলাইনে তা একেবারেই অসম্ভব। অধ্যাপক রামপলের মতে, অনলাইন ব্যবস্থায় শিক্ষকরা একটা সিস্টেমে বাঁধা পড়ে থাকেন, সিস্টেমটা যেমন, তেমনভাবেই শিক্ষককে চলতে হয়। কোনও স্বকীয়তার সুযোগ নেই। তাঁর মতে, ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকের কাছ থেকে যতটুকু শেখে, তার চেয়ে অনেক বেশি শেখে পরস্পরের কাছ থেকে। এক সঙ্গে কাজ করা, একত্রে চিন্তা করা– এসব থেকে তারা অনেক কিছু শেখে। অনলাইন শিক্ষা ছাত্রদের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে। এ ক্ষতি সাংঘাতিক। তা ছাড়া অনলাইনে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব সুশৃঙ্খলভাবে চালানো বা ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ যথাযথভাবে রক্ষা করাও যায় না।

অধ্যাপক রামপল বলেন, এটা খুব বেদনার যে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে অনলাইন শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা ছাত্রদের শিক্ষার মৌলিক অধিকারের বিরোধী। কারণ, সকলে এর সুযোগ পাবে না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গরিব। অনলাইন শিক্ষার সুযোগ নেওয়া এবং চালিয়ে যাওয়ার আর্থিক সঙ্গতি তাদের নেই। ডিজিটাল পরিকাঠামোও দেশের সর্বত্র নেই। বহু গ্রামাঞ্চল আছে, যেখানে বিদ্যুৎ নেই। নেই দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থা। এই অবস্থায় ডিজিটাল শিক্ষায় কায়েম হবে বৈষম্য।

তা হলে অনলাইন শিক্ষা নিয়ে সরকার এত উদগ্রীব কেন? এর পেছনে রয়েছে তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানি মালিকদের চাপ। তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত বৃহৎ পুঁজিপদিদের সামনে বিরাট বাজার খুলে দিয়েছে অনলাইন শিক্ষা। কিছু দিন আগেই উচ্চশিক্ষার অনলাইন কোর্সের বৃহৎ কোম্পানি ‘আপগ্রাড’ সারা দেশের নানা কেন্দ্রীয় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে চিঠি লিখে অনলাইন শিক্ষা ব্যবসাকে যৌথ উদ্যোগে সম্প্রসারিত করার আহ্বান জানিয়েছে। কোম্পানির অন্যতম কর্তা রনি স্ক্রুয়ালা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ব্যবসায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের কোম্পানি এখন মুম্বাই ইউনিভার্সিটি, জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি, আইআইটি মাদ্রাজ সহ ১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হিসাবে পূর্ণ সময়ের অনলাইন ডিগ্রি কোর্স চালু করার কাজ করছে।

অনলাইন শিক্ষার উপর জোর কি কেবলমাত্র করোনা মহামারিজনিত পরিস্থিতিতে জরুরি বলে ভেবেছে সরকার? ২০১৯ থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় শিক্ষানীতিতে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ছাত্রকে অনলাইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে। এর শুরু ২০১৫-১৬ সাল থেকে। এই অনলাইন শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য সার্টিফিকেট বেচা। কে কী শিখল তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে গঠিত বিড়লা-আম্বানি কমিশন ২০০০ সালে বলেছিল, কৃষি এবং শিল্পের চেয়ে শিক্ষা অনেক বেশি মুনাফাদায়ক। শিল্পে সর্বাত্মক মন্দার কারণে একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের এখন লক্ষ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থে্যর মতো পরিষেবাগুলিকে কর্পোরেট ব্যবসার আওতায় আনা। এ জন্যই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাও এ দিকে মন দিয়েছে। ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিমালিকরা শিক্ষা বিপণি নিয়ে অন্য দেশের বাজারে শিক্ষা ব্যবসায় ঢুকতে নিজের দেশের বাজারে বিদেশি শিক্ষা ব্যবসায়ীদের ঢোকার ছাড়পত্র দিচ্ছে। সেই লক্ষে্যই সাজানো হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতিকে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে গুগল কোম্পানির সিইও সুন্দর পিচাইয়ের বৈঠকে ভারতের ডিজিটাল শিক্ষায় গুগল ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা ঘোষণা করেছে। ভারতের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে এই অনলাইন শিক্ষা এক নতুন বৈষম্যের জন্ম দেবে। দুই তৃতীয়াংশ ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে এই শিক্ষা কেনার সামর্থ্য প্রায় নেই। আর যারা কিনবে তারাও পাবে প্রাণহীন একটা শিক্ষার খোলস। যার চকচকে মোড়কটুকুই সম্বল। এ দিয়ে ছাত্রদের না হবে শিক্ষা, না হবে কারিগরি দক্ষতা। হবে না সামাজিক দায়বদ্ধতা, বা চরিত্র গঠনের শিক্ষা। অনলাইন শিক্ষায় সরকারের লাভ কী? তার লাভ, শিক্ষাখাতে খরচ কমবে। আর যে পুঁজিমালিকরা অনলাইন শিক্ষা বেচবে তাদের টাকার থলির আশীর্বাদ পাবে নেতা-মন্ত্রীরা। এ তো একটা বিরাট দায় থেকে সরকারের মুক্তি!

তা হলে ক্ষতি কার? ক্ষতি ছাত্রছাত্রীদের। ক্ষতি শিক্ষার গুণগত মানের। অনলাইন শিক্ষার উপযোগী সিলেবাস হবে। অনলাইনে উত্তর দেওয়ার মতো বহু বিকল্পধর্মী প্রশ্ন হবে, যেখানে লিখে প্রকাশ করার সুযোগ কম, বিশ্লেষণের ব্যাপার প্রায় নেই। এই পরিস্থিতি ছাত্রদের চিন্তাশক্তির বিকাশের অন্তরায়। শিক্ষার এই অবনমন শেষপর্যন্ত সমাজ বিকাশের প্রতিবন্ধক হবে। এই অবস্থায় ক্লাসরুম শিক্ষার মতো প্রথাগত শিক্ষা চালু করার দাবিতে জনমত গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।