কমরেড রবীন মণ্ডল শোষিত মানুষকে শ্রেণিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতেন– স্মরণসভায় কমরেড প্রভাস ঘোষ

তেভাগা আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা, তিনবারের বিধায়ক, এস ইউ সি আই (সি)-র পূর্বতন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলী সদস্য কমরেড রবীন মণ্ডলের জীবনাবসান হয় গত ১ নভেম্বর। ২৫ নভেম্বর জয়নগরে শচীন ব্যানার্জী-সুবোধ ব্যানার্জী স্মৃতি ময়দানে তাঁর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বক্তা, দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের ভাষণটি প্রকাশ করা হল।

অন্যান্য সময় নেতারা ঠিক করেন আমি কোন মিটিংয়ে বলতে যাব, কিন্তু এই মিটিংয়ের ক্ষেত্রে আমি নিজেই বলেছি, এই বীর বিপ্লবী যোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য আমি আসব।

প্রয়াত কমরেড রবীন মণ্ডলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার আমার কিছু সুযোগ ঘটেছিল। সে সম্পর্কে দু-একটি কথা বলব। আর এতক্ষণ ধরে বিভিন্ন বক্তার কাছ থেকে আপনারা তাঁর সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায়ের কিছু কিছু দিক শুনেছেন। একজন সাধারণ গ্রাম্য যুবক, মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের সংস্পর্শে এসে এবং তাঁর প্রদর্শিত পথে সংগ্রাম চালিয়ে কী অসাধারণ বিপ্লবী যোদ্ধায় পরিণত হতে পারেন, কমরেড রবীন মণ্ডল তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এই জেলার এবং এই জয়নগর শহরের কিছু প্রাচীন ঐতিহ্য আছে যা এখনকার অনেকে জানেন না, অনেকের কাছে বিস্মৃতপ্রায়। জেলার এই শহরেই একদিন ভারতীয় নবজাগরণের মহান পথপ্রদর্শক বিদ্যাসাগরের অনুগামী শ্রদ্ধেয় শিবনাথ শাস্ত্রী নবজাগরণের মশাল নিয়ে এসেছিলেন। এই শহরেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এখানকার যুবকদের কাছে সশস্ত্র বিপ্লবের আহ্বান জানিয়ে গিয়েছিলেন। এই শহরেই আরেক জন মহান বিপ্লবী যুবক কানাইলাল ভট্টাচার্য অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকারের মৃত্যুদণ্ড বিধান করে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছেন নিজের নাম গোপন করে আরেক জন বিপ্লবীকে বাঁচাবার জন্য। আবার এই জেলার এই শহরেই ভারতবর্ষের সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) প্রতিষ্ঠিত হয় কমরেড শিবদাস ঘোষের নেতৃত্বে। তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন কমরেড নীহার মুখার্জী ও এই শহরেরই আরেক জন বিপ্লবী কমরেড শচীন ব্যানার্জী। যিনি আবার কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীকেও এই সংগ্রামে সামিল করেছিলেন। কমরেড শিবদাস ঘোষ যখন পার্টি গঠন করছেন, কলকাতায় তখন মুষ্টিমেয় কিছু কর্মী, ২০-২৫ জন। এখানেও কমরেড শচীন ব্যানার্জীর নেতৃত্বে ওই সংখ্যক যুবক কাজ শুরু করেছেন। সেই সময় কমরেড শিবদাস ঘোষ শুনেছেন, সুন্দরবন জঙ্গলের প্রান্তে এবং দুরন্ত নদীর পাড়ে যে বিশাল সংখ্যক গরিব মানুষ বাঘের সাথে, সাপের সাথে লড়াই করে, জঙ্গল কেটে জমি আবাদ করেছে, সেই গরিব মানুষের উপর কী অমানুষিক অত্যাচার হচ্ছে। তেভাগার দাবি কংগ্রেস সরকার আইনগত ভাবে মেনে নিলেও এখানে অস্বীকার করছে জোতদাররা, মালিকরা। এখানকার গরিবদের রক্ত শুষে কলকাতায় তারা বিশাল অট্টালিকা বানিয়েছে, ফূর্তি করছে, ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত থাকছে। এখানকার গরিবদের কান্না, আর্তনাদ, হাহাকার কলকাতায় পৌঁছত না। এই এলাকাগুলো অনেকটা বিচ্ছিন্নই ছিল। এই সংবাদ কমরেড শিবদাস ঘোষকে ব্যথিত করে, উদ্বেলিত করে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এদের ব্যথা-বেদনাকে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলবেন। সেই আন্দোলন গড়ার ক্ষেত্রে কমরেড শচীন ব্যানার্জী, কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর নেতৃত্বে কমরেড ইয়াকুব পৈলান, কমরেড রেণুপদ হালদার এগিয়ে আসেন। তার পরে কমরেড রবীন মণ্ডল, আরও কিছুদিন পরে কমরেড আমির আলি হালদার এগিয়ে আসেন। এই নামগুলো হচ্ছে জেলা স্তরে। আর প্রত্যেকটি অঞ্চলে এরকম বহু নাম আছে, যাঁদের অনেককে আমি চিনি-জানি, তাঁদের সংগ্রাম দেখেছি। তাঁদের চরিত্র আমাকে মুগ্ধ করেছে, আমার মনে শ্রদ্ধা সৃষ্টি করেছে।

কমরেড রবীন মণ্ডল সম্পর্কে আপনারা শুনেছেন, তিনি সচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন। সেই সময় কিছু পড়াশোনাও করেছিলেন। যখন তিনি চাকরি খুঁজছিলেন, এই সময় কীভাবে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল কমরেড ইয়াকুব পৈলানের সাথে, সেটাও আপনারা শুনেছেন। যখন কমরেড শচীন ব্যানার্জী তাঁর সাথে আলোচনা করেন, সেই আলোচনায় তিনি আকর্ষণ বোধ করেন। আবার মন দ্বিধাগ্রস্তও ছিল। একদিকে চাকরির আকর্ষণ, পরিবারকে দেখা, আর একদিকে কমরেড শচীন ব্যানার্জীর বক্তব্য। এরপরে যখন কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে, আপনারা শুনেছেন, ২০২১ সালে তিনি বলছেন, শিবদাস ঘোষের আবেদন তাঁর হৃদয়ে কী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং সেই আলোড়নের প্রভাব তাঁর মধ্যে কীভাবে আবেগ সৃষ্টি করেছিল। সেটা শেষদিন পর্যন্ত তিনি বহন করেছিলেন। কমরেড শিবদাস ঘোষকে শিক্ষক হিসাবে গ্রহণ করে এস ইউ সি আই (সি) পার্টি গড়ে তোলার আদর্শ নিয়ে এই জেলার শিক্ষাবঞ্চিত, নিরক্ষর, অজ্ঞ, গরিব ভাগচাষি-খেতমজুরদের মধ্যে তিনি কাজ শুরু করেন। এঁরা ছিলেন অত্যাচারিত, নিপীড়িত। কিন্তু তাঁদের জানা ছিল না কেন এই অত্যাচার, কেন এই নিপীড়ন। এ কি তাঁদের পূর্বজন্মের পাপের ফল? এ কি ভাগ্যের পরিহাস? এর থেকে মুক্তির কোনও পথ আছে কি? এই সময়েই কমরেড ইয়াকুব পৈলান, কমরেড রবীন মণ্ডল কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শ নিয়ে ঘুরছেন, গ্রামে গ্রামে বৈঠক করছেন। তাঁরা এই অসহায় মানুষগুলোর, এই হতাশাচ্ছন্ন মানুষগুলোর ঘুম ভাঙান, তাঁদের সচেতন করেন, সজাগ করেন, সংঘবদ্ধ করেন। তাঁদের নিয়ে গড়ে তোলেন দুর্বার আন্দোলন। যে আন্দোলন রক্তাক্ত আন্দোলন, অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন সেই আন্দোলনে। পুরুষেরা তীর-ধনুক নিয়ে জোতদারের লেঠেল বাহিনীর বিরুদ্ধে, পুলিশের বন্দুকের বিরুদ্ধে, মহিলারা দা-বঁটি নিয়ে গ্রামে গ্রামে লড়াই করেছেন। তাঁদের রক্ত ঝরেছে, বহু জন হতাহত হয়েছে, জেলে গেছে। এভাবে তেভাগার দাবি আদায় হয়েছে। এভাবে খাস জমি উদ্ধার হয়েছে। হাজার হাজার বিঘা জমি গরিবদের মধ্যে বন্টন হয়েছে। এরই ভিত্তিতে এসব অঞ্চলে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পার্টির একটা দুর্ভেদ্য ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল। এই ঘাঁটি ভাঙবার জন্য কংগ্রেস চেষ্টা করেছে। পরবর্তীকালে সিপিএম চেষ্টা করেছে। আমাদের বহু নেতাকে, কর্মীকে খুন করেছে। বলতে গেলে এমন কোনও গ্রাম নেই যেখানে আমাদের কোনও শহিদ বেদি নেই। অসংখ্য শহিদ বেদি, অনেকে প্রাণ দিয়ে গেছে এই পার্টিকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু মাথা নিচু করেনি।

এই সংগ্রামেরই বীর যোদ্ধা কমরেড রবীন মণ্ডল। দুর্বলতা বলতে কী বোঝায়, কাপুরুষতা বলতে কী বোঝায় তিনি জানতেন না। অত্যন্ত সাহসী ছিলেন, তেজস্বী ছিলেন। আমি নিজে দেখেছি তাঁকে। আমি তাঁর থেকে বয়সে ছোট। রাজনীতিতে হয়ত আমার থেকে একটু আগে বা একটু পরে এসেছেন, আমি ঠিক বলতে পারব না। ১৯৫১ সালে, আমার বয়স তখন খুবই কম, কমরেড নীহার মুখার্জী হঠাৎ আমাকে একটা চিঠি পাঠান– এখানে গিলের ছাটে একটা মিটিংয়ে যেতে হবে। কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ জ্বর হওয়ায় তিনি শয্যাশায়ী। সেই সময় আর কাউকে তিনি পাননি পাঠাবার জন্য। তখন বত্তৃতা দেওয়ার কোনও ক্ষমতাই আমার ছিল না। আমাকে তিনি বললেন, তোমাকে যেতেই হবে। আমি ইতস্তত করছি, তিনি জোর দিয়ে বললেন। তারপর বললেন কী কী বলতে হবে। আমি কাগজে লিখে নিলাম। আজকের সভায় যদি গিলের ছাটের সেই সময়ের কেউ থাকেন, তাঁর হয়ত স্মরণে থাকতে পারে। আমি কোনও রকমে কিছু কথা বললাম। পরদিন আমি জটায় গেছি। সেখানে রবীন মণ্ডল ছিলেন। এই প্রথম তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ। জয়নগর অফিস থেকে চিঠি গেল আমার কাছে যে, গিলের ছাটের বক্তব্য একদম ভালো হয়নি। এরকম বত্তৃতা দিলে চলবে না। আমি রবীন মণ্ডলকে চিঠিটা দেখালাম। তিনি বললেন, আপনি কী বলেছিলেন? আমি দু-চার কথা বললাম। তিনি বললেন, এ রকম বত্তৃতা নয়– আজকের হাটে আমি বত্তৃতা দেব, আপনি শুনবেন, সেইভাবে বলবেন। তিনি দিনের বেলা হাটে বত্তৃতা দিতেন। দিনের বেলা কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরতে সাহস করত না। পুলিশ তাঁকে খুঁজত রাতে। সেই জটার গ্রামে আমি তখন ছিলাম। তিনদিন আমি ছিলাম, আমার আজও মনে পড়ে। রাতে মহিলারা পাহারা দিত। পুলিশ আসছে শুনলেই শাঁখ বাজাত, কাঁসর-ঘণ্টা বাজাত। রবীন মণ্ডল সরে যেতেন। আবার তিনি দিনের বেলা ঘুরতেন, বত্তৃতা দিতেন। কারণ দিনের বেলা ধরতে এলেই হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে যেত। তাঁর বক্তব্য শুনলাম। সেই সময় আরেকটি ঘটনা আমার কাছে শিক্ষণীয়। মহিলারা কাঁসর-ঘণ্টা বাজাচ্ছেন, পুলিশ আসছে। আমি যাঁর বাড়িতে ছিলাম, আমার তখন বয়স খুব কম, তিনি আমাকে সাহস দিয়ে বললেন, পুলিশ যদি এই বাড়িতে ঢোকে– আপনার নাম এই, ঠিকানা এই। আপনি বলবেন এটা আমার শ্বশুরবাড়ি, আপনি আমার জামাই। যদিও আমার পরিচয় দিতে হয়নি, পুলিশ সে বাড়িতে আসেনি। মানে একটা লড়াইয়ের ক্ষেত্র বলতে যা বোঝায়– একদিকে পুলিশ-জোতদারের লাঠিয়াল বাহিনী, আরেক দিকে জনগণ। দিনের বেলা রবীন মণ্ডল ঘুরছেন, রাতের বেলা কোথায় থাকেন পুলিশ খুঁজে পায় না। মহিলারা পাহারা দেয়। এই ছিল সেদিনকার সংগ্রাম। সমগ্র সুন্দরবন এলাকা জুড়েই ছিল এই লড়াইয়ের ক্ষেত্র, আজও আমার মনে দাগ কেটে আছে।

পরবর্তীকালে রায়দিঘিতে আমি বক্তা, তিনিও বক্তা। মিটিংয়ের পর রায়দিঘি অফিসে আমি বললাম, আপনার মনে আছে কিনা জানি না, জটাতে একদিন আপনি আমাকে শিখিয়েছিলেন কী করে বত্তৃতা দিতে হয়। তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, সেদিন আপনাকে আমি শিখিয়েছি, আজ আপনি আমাকে শেখাচ্ছেন। দুজনেই হাসলাম।

এই যে চরিত্র– সত্যিকারের জননেতা, জীবন্ত নেতা! এই জননেতা মানে– আপনারা তো আজ অনেক নেতা পান, টিভিতে, কাগজে ছবি বেরোয়। সবাই তো নেতা। কিন্তু মানুষ মন থেকে কাউকে নেয় না। রবীন মণ্ডলকে কোনও কাগজ নিয়ে যায়নি, টিভির তো প্রশ্নই ছিল না। রবীন মণ্ডল কেন, কমরেড শিবদাস ঘোষকেও নিয়ে যায়নি। কোনও কাগজ, কোনও টিভি, কোনও প্রচারযন্ত্র নিয়ে যায়নি। রবীন মণ্ডল ছিলেন জনগণের অন্তর থেকে গ্রহণ করা নেতা, যাঁকে তারা নিজের ঘরের বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের থেকেও আপন মনে করে। দরকার হলে সন্তানকে বলি দেবে, কিন্তু রবীন মণ্ডলকে রক্ষা করবে– এই মানসিকতা গড়ে উঠল এই চরিত্রকে দেখেই তো! এই চরিত্র কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় এক অসাধারণ সৃষ্টি। এটা আপনাদের বুঝতে হবে।

স্মরণসভা, মাল্যদান, বত্তৃতা দেওয়া, কিছু কথা বলা– এগুলোর কোনও মানে নেই, যদি বক্তা হিসাবে আমরা, যাঁরা মাল্যদান করলাম, যাঁরা শ্রোতা, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছেন, তাঁরা যদি মনে না করেন এই চরিত্র থেকে আমার শেখার কী আছে। আজকে স্মরণসভা হবে– এই জন্যই কি তিনি দলে যুক্ত হয়েছিলেন? নাম-যশ-পদের কোনও প্রলোভনে তিনি কি যুক্ত হয়েছিলেন? তিনি যুক্ত হয়েছিলেন কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং অত্যাচারিত গরিব মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসায়।

আপনাদের আরেকটি ঘটনা বলি। ১৯৬৭ সালে যখন তাঁকে এমএলএ নির্বাচনে দাঁড়াবার কথা কমরেড শচীন ব্যানাজ¹ বলেন, তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বলছেন, আমি এখান থেকে যাব না। এখানে গরিবদের উপর অত্যাচার হচ্ছে। ঘরে ঘরে কান্না। আমি বিধানসভায় চলে গেলে এদের দেখবে কে? তখন কমরেড শচীন ব্যানার্জী তাঁকে কমরেড শিবদাস ঘোষের কাছে নিয়ে যান। কমরেড শিবদাস ঘোষ তাঁকে বোঝান, বিধানসভায় আপনি গেলে এখানকার গরিবদের উপর কী অত্যাচার হচ্ছে, সেটা আপনি বলতে পারবেন, প্রতিবাদ করতে পারবেন। এটা একটা সুযোগ। তখন বলেন, আমার একটা শর্ত আছে। শর্ত হচ্ছে, যখনই ওখানকার গরিবদের ডাক আসবে, আন্দোলন-লড়াইয়ের প্রয়োজন আসবে, বিধানসভার অধিবেশন থাকলেও আমি বিধানসভায় যাব না। এই শর্তে তিনি রাজি হয়েছিলেন। এমএলএ হওয়ার মোহ তো আজ কত, এই দলে সেই দলে, খুনোখুনি পর্যন্ত হয়ে যায়! আর দেখুন কমরেড রবীন মণ্ডলকে। কমরেড রবীন মণ্ডলকে খুন করার ষড়যন্ত্র বহুবার হয়েছিল। জটার থেকে দূরে কোনও গ্রামে যাবেন তিনি, সেখানকার গরিবরা ডেকেছে। পথে বিপদ– জোতদার বাহিনী। তাঁকে অন্যরা বলছে, আপনি যাবেন না, আপনাকে খুন করবে। তাঁর উত্তর ছিল– ‘মানুষ তো একবারই মরে। কুকুর-বেড়ালের মতো মরব না, মানুষের মতো মরব। শিবদাস ঘোষের ছাত্র হিসাবে বীরের মতো মরব।ক্স আমার নিজের কানে শোনা। কী অসাধারণ চরিত্র! জোতদাররা একদিকে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, আর এক দিকে বহু প্রলোভন দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হত্যার ষড়যন্ত্র, নানা প্রলোভন কোনও কিছুই তাঁকে টলাতে পারেনি।

বক্তা হিসাবে আমি তাঁকে দেখেছি। অনেক বক্তাকেই আমি দেখেছি। তাঁদের বক্তব্যের গুরুত্ব থাকে নানা দিক থেকে। জ্বালাময়ী ভাষণ থাকে, মানুষের মধ্যে আবেগ সৃষ্টি হয়। রবীন মণ্ডলের বক্তব্যের মধ্যে রাজনৈতিক শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় থাকত। শুধু আবেগময় ভাষা নয়, উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বক্তব্য নয়। মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি যাকে বলে, সেই শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি তিনি তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরতেন, শ্রোতাদের শ্রেণিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন। এটাও কিন্তু আরেকটা বিরল দৃষ্টান্ত, আমার নিজের চোখে দেখা।

আরেকটা জিনিসও আমি লক্ষ করেছি। এই জেলার নেতাদের মধ্যে কমরেড ইয়াকুব পৈলান, কমরেড দেবপ্রসাদ সরকারকে বাদ দিলে কমরেড রবীন মণ্ডল, কমরেড রেণুপদ হালদার, কমরেড আমীর আলি হালদার সহ সব নেতারা, এমনকি আঞ্চলিক নেতারা সবাই বিবাহিত ছিলেন, তাদের সন্তানও ছিল, কিন্তু কোনও সময় লড়াই করতে গিয়ে, পুলিশ-গুণ্ডাদের আক্রমণের সম্মুখীন হতে গিয়ে, জেল হাজতে বন্দি হতে গিয়ে একবারও ভাবেননি– স্ত্রী-সন্তানকে দেখবে কে, বলা তো দূরের কথা। এভাবেই তাঁরা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে বুকে বহন করেছিলেন।

তিনি বহুদিন ধরে রোগগ্রস্ত। আগের মতো ঘুরতে পারতেন না। কাজ করতে পারতেন না। কিন্তু তিনি দলের সমস্ত খোঁজখবর রাখতেন। আরেকটা জিনিসও আমি দেখেছি। অনেকেই মিটিং মিছিল সংগঠনের কাজে ব্যস্ত থাকে। তারা বলে আমরা পড়ার সময় পাই না। কখন পড়ব! কমরেড রবীন মণ্ডল কিন্তু, এত আন্দোলন, মিছিল-মিটিং, দিনরাত ছুটছেন, সাথে থাকত পার্টির বইপত্র, কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য, পার্টির কাগজপত্র। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। দলের সর্বশেষ যে পুস্তক বেরিয়েছে এবং মুখপত্র গণদাবী বেরিয়েছে, যখন চোখ অন্ধ, তখনও তিনি অন্যকে দিয়ে পড়িয়ে শুনতেন। আমার সাথে যখন মাঝেসাঝে কোনও মিটিংয়ে দেখা হত, অসুস্থ শরীর, অন্যেরা ধরে নিয়ে আসত, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতেন– কমরেড, এই বক্তব্যটা কেন লেখা হল, এ ভাবে কেন লেখা হল? আমি কমরেড পৈলান সাহেব, কমরেড আমির আলি হালদার ছাড়া আর কারও মধ্যে এতটা রাজনীতি বোঝার আগ্রহ দেখিনি। আমার এখনও মনে পড়ে, গত পার্লামেন্ট ইলেকশনে যখন আমরা হেরে যাই, কৃষ্ণচন্দ্রপুরে একটা বিশাল সভা হয়েছিল। কমরেড রবীন মণ্ডল মঞ্চে ছিলেন। বক্তব্য শেষ হওয়ার পর– চোখে দেখেন না– আমার খোঁজ করছেন। আমাকে ডাকলেন। আমি কাছে গেলাম। আমাকে বললেন, আচ্ছা কমরেড, ‘কর্পোরেট’টা কী? গণদাবীতে লেখা হয়, নতুন শব্দ শুনে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। আমি বললাম, একচেটিয়া পুঁজিবাদী সংস্থা বা কোম্পানিকেই কর্পোরেট বলে। এইরকম ছিল তাঁর জ্ঞানের স্পৃহা, জানবার আকুতি। এখন এগুলো খুব দুর্লভ। আমাদের অনেক কর্মী, অনেক নেতা বলেন, কাজের চাপে সময় পাই না। আমি তাঁদের এই শিক্ষা নিতে বলি। এমনকি যখন পড়তে পারছেন না, তখনও কাউকে পেলে, কোনও কর্মীকে বা এলাকার কোনও যুবককে পেলে ডেকে বলতেন, তুমি একটু পড়ে শোনাও। এইভাবে তিনি রাজনৈতিক বক্তব্যের সাথে পরিচিত থাকতেন।

 অনেকের বার্ধক্যে অবসন্নতা আসে। বার্ধক্যে শরীর যেমন নিস্তেজ হয়, দুর্বল হয়, জরাগ্রস্ততা আসে– মানসিক জরাগ্রস্ততাও আসে। একসময় যাঁরা অনেক লড়াই করেছিলেন, শেষ জীবনে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিপ্লবী ঐতিহ্য আগের মতো রক্ষা করতে পারেন না। এখানে কমরেড রবীন মণ্ডল এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। শরীর অসুস্থ, শয্যাশায়ী, দৃষ্টিহীন, চলৎশক্তিহীন, ৯৪ বছরের বৃদ্ধ– কিন্তু মন তাঁর সতেজ। মানসিক যৌবন চিন্তার যৌবনকে রক্ষা করে গেছে। মনেপ্রাণে চাইছেন, এই পার্টি শক্তিশালী হোক, পার্টির বিস্তার ঘটুক। পার্টির বিস্তার হচ্ছে, আন্দোলন-লড়াই হচ্ছে, কর্মীরা গুলির মুখে দাঁড়াচ্ছেন– তাঁর আনন্দ কী ভাষায় ব্যক্ত করেছেন, সেটা আপনারা শুনেছেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পৌঁছচ্ছে– লিখছেন, এর আনন্দই আলাদা। এ সবের খোঁজখবর রাখতেন। কাকদ্বীপের সাংগঠনিক সম্পাদক কমরেড সুজিত পাত্র পরশুদিন আমাকে ফোনে বলেছিল, তার সাথে ওঁর কিছু কথা একসময় হয়েছিল। ও-দিকে একসময় সংগঠন খুব জোরদার ছিল। এখন খানিকটা দুর্বল। অনেক নেতাই মারা গেছেন, অনেক নেতা খুন হয়ে গেছেন, নতুন নেতা এখনও গড়ে ওঠেনি। কমরেড সুজিতকে বলা তাঁর একটা কথা আমার খুবই স্ট্রাইক করেছে। তার তাৎপর্য ও বুঝেছে কি না, আমি জানি না। বলেছেন– আগুন জ্বালিয়ে রাখো। আগুন এখন একটু কমতেও পারে, কিন্তু আগুনটাকে জ্বালিয়ে রাখলে আগুন আবার বড় হয়ে জ্বলে উঠবে। অর্থাৎ, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার আগুনটাকে জ্বালিয়ে রাখো। এখন লোকজন একটু কম হলেও, সংগঠন খানিকটা দুর্বল হলেও কাজ চালিয়ে যাও, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার আগুনকে জ্বালিয়ে রাখো। এই আগুন আবারও জ্বলে উঠবে। আগুন জ্বলে উঠছে। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, পার্টির শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে। এই তো ৫ আগস্ট কলকাতায় কমরেড শিবদাস ঘোষের জন্মশতবার্ষিকীর ঐতিহাসিক সমাবেশ আপনারা দেখেছেন। আমাদের এমএলএ নেই, এমপি নেই। কাগজে আমাদের প্রচার নেই, টিভিতে প্রচার নেই। আমাদের কর্মীরাই প্রচারক। কিন্তু ভারতের ২৬টি রাজ্যে আজ আমরা কাজ করছি। শিবদাস ঘোষের শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ছে। যেখানে আমাদের কমরেডরা শিবদাস ঘোষের শিক্ষা বহন করে নিয়ে যেতে পারছেন, সেখানেই অসংখ্য সৎ মানুষ, চিন্তাশীল মানুষ, সৎ শ্রমিক-কৃষক আকৃষ্ট হচ্ছে, সাড়া দিচ্ছে। এই যে কলকাতায় সমাবেশ হল, এর অর্থ কে সংগ্রহ করেছে? কর্মীরা। কে দিয়েছে? জনগণ। আপনারা যারা সমাবেশে গেছেন, নিজেরাই চাঁদা দিয়ে বাস ভাড়া করে গেছেন। আবার বাস ভাড়া করে ফিরেও এসেছেন। কত লোক দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে। ওড়িশা থেকে চাঁদা তুলে দুটো ট্রেন ভাড়া করে এসেছে। বিহার থেকে এসেছে। সুদূর দক্ষিণ ভারতের, উত্তর ভারতের সব রাজ্য থেকেই এসেছে। পূর্ব ভারত থেকেও এসেছে। দেখেছেন কী ভাবে সমাবেশে মানুষ কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা সম্পর্কে বক্তব্য শুনেছে। নিঃশব্দে, নীরবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ। এমনকি যারা বাংলা জানেন না, বোঝেন না– কর্ণাটক, কেরালা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ– নানা রাজ্য থেকে এসেছেন, তাঁরাও নিঃশব্দে শুনেছেন শিবদাস ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধাবশত। নড়াচড়া নেই। এই হচ্ছে দলের আসল শক্তি।

আপনারা জানেন, প্রথম দিকে কংগ্রেস, তারপর ৩৪ বছর ধরে সিপিএম তাদের রাজত্বে পশ্চিমবাংলায় কী ভাবে এস ইউ সি আই (সি)-কে নিশ্চিহ্ন করার অভিযান চালিয়েছিল। এই জেলায় আমাদের কত নেতা-কর্মীকে তারা খুন করেছে, আপনারা জানেন। আজ সেই সিপিএমের অবস্থা কী? ৩৪ বছর যারা রাজত্ব করেছে, আজ কংগ্রেস, নওশাদ সিদ্দিকি বলে একজন পীরকে ধরে সেই সিপিএম মাথা তোলার চেষ্টা করছে। গত লোকসভা ভোটে এই সিপিএমই বলেছে, আগে রাম, পরে বাম। এখন বিজেপিকে ভোট দাও, তার পর আমরা আসব। এই রাজনীতির চর্চা করছে। এইভাবে দলকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই কর্মীদের তুলতে পারছে না। কর্মীরা এখনও আধশোয়া অবস্থায়। আবার সিপিএম একটু উঠবে, যদি সরকার পায়, মন্ত্রীত্ব পায়। ওদের শক্তি মন্ত্রীত্ব, এমএলএ-এমপি আর টাকা। টাকা দিয়ে মানুষকে কিনবে। সমস্ত দলই তাই করে– তৃণমূলও তাই। এই যে তৃণমূলের এত দুর্নীতি, এত টাকা কোথায় যায়! পাবলিকের এই টাকা আত্মসাৎ করে শহরে শহরে বিশাল রাজকীয় অট্টালিকা বানায়, ব্যবসায় খাটায়, ব্যাঙ্কে জমায় আর ভোগবিলাসে মত্ত থাকে। পঞ্চায়েত চাই, জেলা পরিষদ চাই। আর অন্যদিকে ভোটের সময় টাকা ঢালবে। এখন ভোট মানেই তো টাকার খেলা! গোটা ভারতেই তাই। আপনারা কাগজে দেখবেন– এই যে চারটে বিধানসভা নির্বাচন, আজ নির্বাচনের শেষ দিন। এরপর পার্লামেন্ট আসবে। কংগ্রেস আর বিজেপির লড়াই হবে। অন্যান্য দলও নামবে। এই যে ভোটে হাজার হাজার কোটি টাকা ছড়াবে, এ টাকা কার টাকা? এই যে বার্ধক্য ভাতা, মহিলা ভাতা, অমুক ভাতা, তমুক ভাতা– এ টাকা কার? এ হচ্ছে সরকারি তহবিলের টাকা। যে টাকা স্বাস্থ্যখাতে, শিক্ষাখাতে দেওয়ার কথা, যে টাকা দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার কথা, খরা নিয়ন্ত্রণ করার কথা, চাষির কৃষিঋণ মকুব করার কথা– এসব ক্ষেত্রে সাহায্য করার কথা, সেই টাকাটা সেখানে ব্যয় না করে ভোটের আগে এই ভাবে কিছু ঘুষ দেয়। মানুষকে ভিখারি বানিয়ে, ভিখারির মন তৈরি করে, তারপর ভিক্ষা দেয়। ভোটের জন্য ভিক্ষা দেওয়া। তার ফলে আবার সরকারি আর্থিক ভাণ্ডার কমছে। আর সরকারি ভাণ্ডার কমছে মানে বাজেট ঘাটতি। ঘাটতি বাজেট পূরণ করার জন্য ট্যাক্স বৃদ্ধি করে আবার জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে। এই যে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে, এটা ঘটছে কেন? প্রতিটি জিনিসের উপর প্রচুর ট্যাক্স। ট্যাক্সের উপরে ট্যাক্স, তার উপরে ট্যাক্স। বিদেশ থেকে অল্প দামে পেট্রল-ডিজেল কেনে। এখানে বেশি দামে বিক্রি করে। সে টাকা সরকার নেয়। এর ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এসবই চলছে মানুষকে প্রতারণার দ্বারা।

দেশের আজ ভয়ঙ্কর দুর্দিন। আমি অল্প কথায় কিছু বলতে চাই। এই রকম দুর্দিন আগে কখনও আসেনি। কোটি কোটি বেকার। ঘরে ঘরে বেকার। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে, এমএ-এমএসসি পাশ করেছে, চাকরি নেই। রিক্সা চালায়, ভ্যান চালায়। পিয়নের চাকরি খোঁজে। দশটা পোস্ট খালি থাকলে তার জন্য এক লক্ষ যুবক অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এরা বিএ-এমএ পাশ করা ছেলে। ডিগ্রির কোনও মূল্য নেই। আমি তো শুনি, এখন গ্রামাঞ্চলের ছেলেরা পড়তেও চাইছে না। কিছু মেয়ে স্কুলে পড়তে যায়, ছেলেদের সংখ্যা কমে গেছে। কোথাও কাজের সন্ধান পেলে, কেরালা হোক, কর্ণাটক হোক, এমনকি দুবাই হোক– যেখানে হোক চলে যায়। এদের বলে মাইগ্র্যান্ট লেবার। ভবঘুরের মতো আর কী। এখানে কয়েকদিন, ওখানে কয়েকদিন ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই দেখুন, সুড়ঙ্গ করতে গেছে হিমালয় পর্বত খুঁড়ে, তার মধ্যে আটকে গেছে ৪১ জন শ্রমিক। এর মধ্যে এ রাজ্যের শ্রমিকও আছে, অন্য রাজ্যের শ্রমিকও আছে। এই যে কিছুদিন আগে কাতারে ফুটবল খেলা হয়ে গেল, তার স্টেডিয়াম তৈরি করতে গিয়ে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর গরিব মানুষ গেছে। স্টেডিয়াম তৈরি করতে গিয়ে কয়েক হাজার শ্রমিক মারা গেল। বিশাল বিশাল অট্টালিকা তৈরি করতে গিয়ে মারা যায়। এদের খোঁজও কেউ রাখে না। আর এই মাইগ্র্যান্ট লেবারদের মধ্যে একটা মাইগ্র্যান্ট কালচারও ডেভেলপ করে গেছে। এখানে কয়েকদিন, ওখানে কয়েকদিন, সেখানে কয়েকদিন– যেখানে যেমন কাজ জোটে ছুটে যায়। একদল ঘরেও ফিরে আসে না। এইরকম জীবন। গ্রামের মেয়েরা পর্যন্ত শহরে চলে যাচ্ছে। রোজগার করতে হবে ঘর-সংসার চালানোর জন্য। আবার মেয়েদের নিয়ে একটা বিরাট ব্যবসা চলছে। গ্রাম থেকে একদল তুলে নিয়ে যাচ্ছে চাকরি দেবে, কাজ দেবে বলে। প্রলোভন দেখিয়ে শহরে নিয়ে চলে যাচ্ছে। বিক্রি করে দিচ্ছে বিদেশের বাজারে। এদের নিয়ে নোংরামি চলে। এইরকম এক দল গ্রামের গরিব পাড়ায় পাত্র নিয়ে আসে– বাবা-মায়ের হাতে ৫ হাজার, ১০ হাজার টাকা দেয়। বিয়ে করে সেই মেয়েকে নিয়ে যায়। তারপর দশদিন বিশদিন রেখে তাকে বিক্রি করে দেয়। সারা ভারতেই এই জিনিস হচ্ছে। আপনারা জানেন, ১৩ লক্ষ মহিলার খোঁজ নেই ভারতবর্ষে। কিছুদিন আগে কাগজে বেরোল এই খবর। কোথায় গেল তারা?

এই হচ্ছে দেশের অবস্থা! লক্ষ লক্ষ কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোটি কোটি শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। একদিকে আম্বানি আদানি টাটা জিন্দাল মিত্তাল– এই কয়েকজন, যাদের প্রতি ঘণ্টায় কয়েক হাজার কোটি টাকা মুনাফা হচ্ছে। আর দেশের ৮০ কোটি লোক রিক্ত, নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত। গোটা দেশের অবস্থা হচ্ছে এই।

 এই হচ্ছে ভারতের চেহারা। এই পুঁজিবাদের হয়ে যারা কাজ করছে– এই বিজেপি, কংগ্রেস, এই সমস্ত দল। এমনকি সিপিএম যখন সরকারে ছিল, তারাও পুঁজিবাদের হয়ে কাজ করেছে। নন্দীগ্রামের জমি বহুজাতিক সালিম কোম্পানিকে দিচ্ছিল কৃষকদের উচ্ছেদ করে। সিঙ্গুরে দিয়েছিল টাটাকে, যার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছিলাম, আপনারা জানেন।

তা হলে, রাজনীতি দুটি, সমাজও দুটি। একটা হচ্ছে শোষক শ্রেণি, পুঁজিপতি শ্রেণি। তারা মুষ্টিমেয়। কিন্তু তারাই সমস্ত সম্পদের মালিক। গরিবের রক্ত শোষণ করে, নিঃস্ব করে, তাদের শোষণযন্তে্র গরিবের হাড় চূর্ণবিচূর্ণ করে তারা মুনাফা লুটছে। আর কোটি কোটি মানুষ পথের ভিখারি হচ্ছে। এখনও যারা মধ্যবিত্ত, তারা নিম্নমধ্যবিত্ত হবে। নিম্নমধ্যবিত্ত নিঃস্ব হবে। এই হচ্ছে পুঁজিবাদ। কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, এই পুঁজিবাদ জনগণের শত্রু। এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আর লড়বে কারা? শোষিত শ্রমিক, শোষিত গরিব কৃষক, খেতমজুর। ফলে রাজনীতি দুটি। এই দলগুলো সবই হচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণির দল। পুঁজিপতিদের টাকায় তারা চলে। তাদের সংবাদপত্র, তাদের টিভিতে তাদের প্রচার চলে। আর এই একটি মাত্র দল, যেটি শোষিত গরিব মানুষের দল। এ দল মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে টানে না। মানুষের কাছে হাত পাতে চাঁদার জন্য। তার ভিত্তিতে এ দল চলে। এই দল মানুষকে নীতি-আদর্শের কথা বলে। এ দল মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে, আগেকার দিনের বড় মানুষদের চরিত্র থেকে শিক্ষা নাও। পুরনো দিনের বড় মানুষ যাঁরা ছিলেন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, সুভাষ চন্দ্র বসু– এঁদের থেকে শিক্ষা নাও। শহিদ ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, আসফাকউল্লা খানের থেকে শিক্ষা নাও। আমরা প্রচার করি– কানাইলাল ভট্টাচার্যের থেকে শিক্ষা নাও। আমরা তা করি যুবকদের মধ্যে আবার নতুন প্রাণসঞ্চার করার জন্য। ওরা যুবকদের বলে– মদ খাও, জুয়া খেলো, সাট্টা খেলো, ড্রাগ অ্যাডিকশনে ভোগো, নারীদেহ নিয়ে নোংরা আলোচনায় মত্ত থাকো। রাস্তার অন্ধকারে নারীদের পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ো পশুর মতো। এই পুঁজিবাদ শুধু মানুষের মুখের আহার কেড়ে নিয়েছে, পথের ভিখারি করছে তাই নয়, পুঁজিবাদ মানুষের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করছে, চরিত্রকে ধ্বংস করছে। মানুষকে পশু বানিয়ে দিচ্ছে। এই যে এত নারীধর্ষণ– ভারতবর্ষে আগে কেউ দেখেছে? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগর, সুভাষচন্দ্র দেখেছেন? এখন প্রতিদিন হাজার হাজার নারী ধর্ষিতা হচ্ছে। গণধর্ষিতা হচ্ছে। তিন বছরের চার বছরের শিশুকন্যা– তাকেও ধর্ষণ করে হত্যা করছে! বাবা মেয়েকে ধর্ষণ করছে! এমনকি আলিপুর কোর্টে কেস চলছে, মাকে ছেলে ধর্ষণ করেছে। এই পশ্চিমবাংলাতেই ঘটছে। এই যে নেতারা মঞ্চ আলো করে বসে থাকেন, তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ভোট, গদি, মন্ত্রীত্ব। আর টাটা, আম্বানি, আদানিদের লক্ষ্য শুধু মুনাফা, আরও মুনাফা।

কমরেড শিবদাস ঘোষ এনেছেন মুক্তির বাণী। পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবের শিক্ষা। এ জন্য দেখবেন আমাদের দলকে একসময় সিপিএম তাদের ফ্রন্টে যোগ দেওয়ার অফার করেছিল, আমরা যাইনি। তৃণমূল মন্ত্রীত্বের অফার পর্যন্ত করেছিল– আমরা যাইনি। আমরা বলেছি, এই দল বিপ্লবের আদর্শে গড়ে উঠেছে। আমরা ভোটসর্বস্ব পার্টি নই। আমাদের বামপন্থা বিপ্লবী বামপন্থা, সংগ্রামী বামপন্থা। সিপিএমের বামপন্থা গদিলোভী বামপন্থা, ভোটসর্বস্ব বামপন্থা। তারা যথার্থ মার্ক্সবাদী নয়। যথার্থ কমিউনিস্ট নয়। ওরা মার্ক্সবাদকে, কমিউনিজমকে কলঙ্কিত করেছে। আমরা মার্ক্সবাদ-কমিউনিজমের মর্যাদা রক্ষা করছি।

কমরেড শিবদাস ঘোষ যে সংগ্রামের সূচনা করেছেন কমরেড রবীন মণ্ডল সেই সংগ্রামের অন্যতম অগ্রগণ্য বীর যোদ্ধা ছিলেন। আজীবন তিনি কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে বুকে বহন করেছেন। রোগশয্যায় যখন ছিলেন, চলৎশক্তিহীন, দৃষ্টিশক্তিহীন, তখনও তিনি শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে বুকে বহন করেছেন। আমি কমরেডদের বলব, সমর্থকদের বলব– এখান থেকে শিক্ষা নিতে, তাঁকে স্মরণ করার, যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের তাৎপর্য এখানেই। আজ গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে হাজার হাজার এই ধরনের বীর বিপ্লবী যোদ্ধার জন্ম হওয়া প্রয়োজন, যারা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমৃত্যু বিপ্লবের ঝান্ডা বহন করে যাবে।