ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের পঞ্চাশ বছর, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়তে হবে নতুন লড়াই

রেলকর্মীদের দখলে ট্রেন। ১৯৭৪

কিছুদিন আগে খুব ধুমধাম করে হাওড়া-পুরী বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্রেনের উদ্বোধন হয়েগেল। অনেক রেলওয়ে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘ভারতমাতা কি জয়’ ধ্বনির উন্মাদনা গড়ে তোলার জন্য। সেই ট্রেনে সওয়ার হয়েছিলেন বিজেপি-র সাংসদ-বিধায়করা। রেল হাসপাতাল খালি করে ডাক্তার থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের মোতায়েন করা হয়েছিল স্টেশনে স্টেশনে। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বন্দে ভারতের যাত্রার সূচনা হল। অভিভাবকদের গভীর উদ্বেগে রেখে ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি ফিরল রাত দেড়টা-দুটোয়, যাদের অধিকাংশেরই ওই ট্রেনে চড়ার আর্থিক সামর্থ্য নেই।

বন্দে ভারতের প্রচারের মাধ্যমে জাঁকজমক, চাকচিক্য আর জাতীয় উন্মাদনা গড়ে তোলাই লক্ষ্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের। গোটা ভারতে রক্তজালিকার মতো বিস্তৃত রেলব্যবস্থা তথা ‘লাইফলাইন অফ ইন্ডিয়া’র সংবহনতন্ত্রে রক্ত সরবরাহে প্রবল ঘাটতি কিন্তু তাতে ঢাকা পড়ছে না। নতুন রেলপথ চালু করার বদলে পুরনোগুলি বন্ধ করা শুরু হয়েছে। অলাভজনক আখ্যা দিয়ে বহু ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপক ভাড়াবৃদ্ধির মতলবে বহু প্যাসেঞ্জার ট্রেনে এক্সপ্রেস ট্রেনের তকমা আঁটা হয়েছে। ১১৯টি রুটের ১৫১ জোড়া ট্রেনকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। দেড়শোর বেশি স্টেশন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চালানোর জন্য ব্যক্তিমালিকের কাছে জলের দরে বিক্রি করা হয়েছে। রেলের প্রায় সাড়ে চার লক্ষ হেক্টর জমি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রেলকর্মীর সংখ্যা সাড়ে বাইশ লক্ষ থেকে কমে বারো লক্ষেরও নীচে নেমে গেছে। সমস্ত টিকিট কাউন্টার বন্ধ করে শতকরা একশো ভাগ অনলাইন টিকিট ব্যবস্থা চালুর প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই রেলের নিরাপত্তা-বহির্ভূত ক্ষেত্রগুলির সমস্ত শূন্য পদ অবলুপ্ত করে দেওয়া হবে। দেশের সাধারণ মানুষের টাকায় গড়ে তোলা এই বৃহৎ রাষ্ট্রীয় সম্পদের যদি এইভাবে বেসরকারিকরণ হতে থাকে, তা হলে খুব বেশি দেরি নেই যখন যখন খাঁ-খাঁ করবে রেলের হাজার হাজার কারখানা ও স্টেশন চত্বরগুলি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে প্রাণচঞ্চল সমস্ত রেল কলোনি।

১৮৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় রেল আয়তনে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম পরিবহন ব্যবস্থা। আজও রেলকর্মীরা ছাড়াও জীবিকার জন্য রেলের উপর নির্ভর করেন আরও কয়েক লক্ষ মানুষ। এ হেন ভারতীয় রেলকে বেসরকারি একচেটিয়া মালিকদের কাছে বেচে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে দেশের শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজার সরকারগুলি। এই সর্বনাশ রুখতে প্রয়োজন রেল-কর্মচারী ও রেল-শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ ও লাগাতার আপসহীন আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনকে সফলতায় পৌঁছে দিতে চাই সঠিক নেতৃত্ব।

লড়াই-আন্দোলন রেল-কর্মীদের কাছে নতুন নয়। ১৯৭৪ সালে গোটা দেশের প্রায় ২০ লক্ষ রেলকর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে সংগঠিত করেছিলেন এক ঐতিহাসিক আন্দোলন। নিজেদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ২০ দিন ধরে ধর্মঘট চালিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু শুধুমাত্র সঠিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি, কিংবা বলা ভাল, আপসমুখী নেতৃত্বের আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতায় সেই আন্দোলন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। সেই গৌরবময় আন্দোলনের ৫০ বছর পরে আজ যদি রেলকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিসাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তবে রেলকর্মীদের সংগঠিত আন্দোলন প্রয়োজন। তার জন্য ১৯৭৪-এর সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের ইতিহাস জানা জরুরি।

ধর্মঘটের প্রেক্ষাপট

১৯৪৭-এ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে দেশীয় পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর দেশ জুড়ে ভারী শিল্প গড়ে তোলা থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ, সবেতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ভারতীয় রেল। কিন্তু বেতন কম থাকায় বরাবরই ক্ষোভ ছিল রেল-কর্মচারীদের। ১৯৬০-এর দশকে রেলের আয়ের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হওয়া সত্তে্বও কর্মীদের বেতন বাড়েনি। এদিকে ‘৭০-এর দশকে সমস্ত ভোগ্যপণ্যের বিপুল মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। চাল, গম, ভোজ্য তেল, কেরোসিনের আকাশছোঁয়া দামে কর্মীদের যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার রেলকর্মীদের মাসিক বেতন সামান্য বাড়িয়ে ঘোষণা করে, তাঁদের পাওনা মহার্ঘভাতা কয়েকটি দফায় দেওয়া হবে। শুধু কম বেতন নয়, ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য অনুসারে রেলের উচ্চপদস্থ অফিসারদের জন্য বিলাসবহুল জীবন কাটানোর ব্যবস্থা থাকলেও বহু জায়গাতেই সাধারণ কর্মীদের কোয়ার্টারগুলি ছিল ভাঙাচোরা, বাসের অযোগ্য। অনেক সময়ই সেখানে বিদ্যুৎ থাকত না। এ নিয়েও ক্ষুব্ধ ছিলেন কর্মীরা।

কর্তৃপক্ষের কাছে কর্মীদের ক্ষোভ, দাবি-দাওয়া পৌঁছে দেওয়া, আন্দোলন সংগঠিত করে সেগুলি আদায় করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনুমোদিত দুই প্রধান কর্মচারী সংগঠন এআইআরএফ (অল ইন্ডিয়া রেলওয়েমেন্স ফেডারেশন) এবং এনএফআইআর (ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান রেলওয়েমেন)-এর নেতৃত্বের আপসমুখী আচরণে কর্মীরা ক্রমাগত তাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছিলেন। এনএফআইআর সংগঠনটি ক্ষমতাসীন কংগ্রেস প্রভাবিত হলেও এআইআরএফ-এর নিয়ন্ত্রণ ছিল সোসালিস্ট পার্টি এবং সিপিআই, সিপিআইএম-এর মতো তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলির হাতে। তা সত্ত্বেও এনএফআইআর-এর মতোই এআইআরএফ-এর নেতৃত্বও রেল কর্তৃপক্ষের প্রতি ছিল নিতান্ত অনুগত এবং আন্দোলনবিমুখ। বড় ইউনিয়নগুলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ রেলকর্মীরা ‘৬০-এর দশকে বিভিন্ন বিভাগে আলাদা আলাদা সংগঠন গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন। এরকমই একটি সংগঠন এআইএলআরএসএ (অল ইন্ডিয়া লোকো রানিং স্টাফ অ্যাসোসিয়েশন) তৈরি হয়েছিল ১৯৭০-এর আগস্ট মাসে। ইঞ্জিনের চালক, সহকারী চালক, ফায়ারম্যান ইত্যাদি লোকো-কর্মচারীরা ছিলেন চরম অত্যাচারিত। অনেক সময় ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা একনাগাড়ে কাজ চালিয়ে যেতে হত তাঁদের। ফলে অসুস্থতা ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। কাজের সময় কমানোর দাবিতে এআইএলআরএসএ-র ডাকে ‘৭৩ সালের ধর্মঘটে সামিল হয়েছিলেন ৫০ হাজারেরও বেশি লোকো-চালক। আন্দোলনের চাপে রেলমন্ত্রী তাঁদের কাজের সময় কমিয়ে ১০ ঘন্টা করতে এবং ধর্মঘটীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

সেই সময় রেলে দু’লাখেরও বেশি নিতান্ত কম মজুরির অস্থায়ী কর্মী ছিলেন সমস্ত শ্রম-অধিকার থেকে বঞ্চিত। অসুস্থ হলে বা দুর্ঘটনায় পড়লে বিনা বাক্যব্যয়ে এঁদের ছাঁটাই করে দিত কর্তৃপক্ষ, সামান্য ক্ষতিপূরণটুকুও মিলত না।

এগুলি ছাড়াও পদোন্নতি সংক্রান্ত কিছু অন্যায় নিয়ম এবং বোনাস না পাওয়ায় রেলকর্মীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ জমা হয়েছিল। ক্ষোভের জমা বারুদে আগুন দিয়েছিল খাদ্যশস্য ও কেরোসিনের আকাল, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, সরকার ও প্রশাসনের স্তরে স্তরে দুর্নীতি এবং সর্বোপরি, সেই সময়ে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন ও দেশে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রবল জোয়ার। এই সবকিছুই ১৯৭৪-এর ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।

ধর্মঘটের প্রস্তুতি

‘৭৩-এ লোকো-কর্মচারীদের আন্দোলন ও দাবি আদায় রেল-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। ‘৭৪-এর শুরু থেকেই দক্ষিণ-মধ্য রেল ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন ভাবে বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ-আন্দোলনে সামিল হন কর্মচারীরা। এখানে ওখানে স্বতঃস্ফূর্ত কর্মী-বিক্ষোভে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। কর্মীদের সংগ্রামী মেজাজ দেখে ১৯৭৪-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে একটি জাতীয় কনভেনশনের ডাক দেয় ইউনিয়নগুলি। ১১০টি অনুমোদিত ও অননুমোদিত ইউনিয়ন যোগ দেয় এই কনভেনশনে। সেই সময়ে এস ইউ সি আই (সি)-র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ ছিলেন ইউটিইউসি-লেনিন সরণি (বর্তমানে এআইইউটিইউসি)-র সর্বভারতীয় সভাপতি। তাঁর উদ্যোগে ইউটিইউসি-লেনিন সরণিও এই কনভেনশনে অংশ নেয়। প্রতিনিধিত্ব করেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্পাদক এবং এসইউসিআই(সি)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড প্রীতীশ চন্দ। কনভেনশন থেকে সোস্যালিস্ট পার্টির জর্জ ফার্নান্ডেজকে আহ্বায়ক করে তৈরি হয় ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেশন কমিটি ফর রেলওয়েমেন্স স্ট্রাগল (এনসিসিআরএস) এবং সিদ্ধান্ত হয়, রেলমন্ত্রক যদি ১০ এপ্রিলের মধ্যে ইউনিয়নগুলির সঙ্গে আলোচনায় না বসে তাহলে কর্মীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করবেন। একটি অ্যাকশন কমিটিও তৈরি হয়, যার সদস্য ছিলেন সিপিআই প্রভাবিত এআইটিইউসি ও সিপিএম প্রভাবিত সিটুর বেশ কয়েকজন নেতা সহ আরও কয়েকজন। কনভেনশনের প্রস্তুতিপর্ব থেকে শুরু করে ধর্মঘটের প্রতিটি স্তরে, কমরেড শিবদাস ঘোষের দিকনির্দেশে ইউটিইউসি-এলএস এবং এসইউসিআই(সি)-র নেতা-কর্মীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

এখানে প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি, যা এই আন্দোলনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করবে। বিভাগীয় ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে আলাদা করে আন্দোলনের বদলে সর্বসম্মত কর্মসূচির ভিত্তিতে সমস্ত ইউনিয়নকে একজোট করে রেলশ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সামিল করার জন্য কমরেড প্রীতীশ চন্দ দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। পরে জর্জ ফার্নান্ডেজ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন। দিল্লির কনভেনশনে যে এনসিসিআরএস গঠিত হয়, তাতেও কমরেড চন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। রেলওয়েমেন্স ফেডারেশন, বিভিন্ন বিভাগীয় ইউনিয়ন সহ রেলের শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে ইউটিইউসি-লেনিন সরণির উপস্থিতি ও কাজ ছিল। দিল্লির কনভেনশনেও কমরেড চন্দ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। তা সত্তে্বও এনসিসিআরএস-এর বডিতে কোনও মতেই ইউটিইউসি-লেনিন সরণির কোনও প্রতিনিধিকে জায়গা দেওয়া হয়নি এবং জানা যায়, এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা এসেছিল সিটু এবং এআই×টিইউসি-র পক্ষ থেকে। তবে রেলকর্মীদের মধ্যে এই সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করতে না পেরে অ্যাকশন কমিটির বৈঠকগুলিতে বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে কমরেড চন্দকে যোগ দিতে বলা হয় এবং তিনি প্রতিটি বৈঠকে উপস্থিত থেকে কার্যকরী নানা প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেগুলির আন্দোলনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সোসালিস্ট পার্টি, সিপিআই ও সিপিএম প্রভৃতির আপসকামী দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তাই তারা ইউটিইউসি-এলএল-এর প্রস্তাবগুলির রূপায়ণে বাধা দিচ্ছিল প্রবল ভাবে।

ধর্মঘটের ঘোষণা

ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার আলোচনার সদিচ্ছা না দেখালে ৮ মে থেকে ধর্মঘট শুরু করা হবে বলে এনসিসিআরএস সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মর্মে ২৩ এপ্রিল সরকারের কাছে নোটিস পাঠানো হয়। চাকরি হারানো সহ শাস্তির নানা ঝুঁকি থাকা সত্তে্বও শুরু থেকেই বঞ্চিত রেলকর্মীরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদগ্রীব ছিলেন। এই অবস্থায় সরকার ২ মে আচমকা ফার্নান্ডেজ সহ আন্দোলনের কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করলে পরদিনই এর প্রতিবাদে দিল্লি ও বোম্বেতে রেলকর্মীরা বনধ ডাকেন। মধ্য ও পশ্চিম রেল সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস সহ সমস্ত সরকারি দফতর বন্ধ হয়ে যায়।

কর্মীরা আপসহীন লড়াইয়ের জন্য তৈরি থাকলেও শুরু থেকেই নেতৃত্ব আপসের পথে চলতে শুরু করে। তাঁরা প্রথম থেকেই এমন মনোভাব প্রকাশ করেন যে, হয়তো ধর্মঘট করতেই হবে না, যদি একান্তই করতে হয়, তাহলে তা অল্প কয়েকদিনের বেশি স্থায়ী হবে না। তাই ২ মে-র গ্রেফতারির পর থেকেই বিচ্ছিন্ন ভাবে ধর্মঘট শুরু হলেও ইউনিয়নের নেতারা সঙ্গে সঙ্গে দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ডাক না দিয়়ে ৮ মে থেকে ধর্মঘট শুরুর ডাক দেন। সরকার এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে ধর্মঘট মোকাবিলায় ব্যবস্থা নিয়ে নেয়। আপসকামী দোদুল্যমান নেতৃত্বের স্বরূপ চিনতে ভুল হয়নি কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের। তাই, গোটা দেশের প্রধান পরিবহন ব্যবস্থা রেল স্তব্ধ হয়ে গেলে কতখানি চাপের সামনে সরকারকে পড়তে হতে পারে তা জানা থাকা সত্তে্বও এবং এই আন্দোলনের পিছনে বিপুল জনসমর্থন আছে জেনেও সরকার ধর্মঘট দমনে কড়া পদক্ষেপ নিতে সাহস করে।

ধর্মঘটের দিনগুলি

৮ মে শুরু হয় ধর্মঘট। গোটা দেশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা রেলপথগুলি নিস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকে। প্রায় ২০ লক্ষ রেলকর্মী ধর্ম-বর্ণ-জাত-ভাষা নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একযোগে স্তব্ধ করে দেন গোটা দেশের পরিবহন ব্যবস্থা। মুম্বাই, চেন্নাই, নিউ দিল্লি, গুয়াহাটি, হাওড়া, শিয়ালদহ, খড়গপুর, আদ্রা সহ রেলের প্রধান কেন্দ্রগুলি ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে যায়। কাঁচরাপাড়া, জামালপুর, পেরুমবুর, চিত্তরঞ্জন সহ রেলওয়ে কারখানাগুলি জনমানবহীন হয়ে পড়ে থাকে।

৮ মে ধর্মঘট শুরু হওয়ার আগে থেকেই জায়গায় জায়গায় আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ মোতায়েন করেছিল কংগ্রেস সরকার। দিনে দিনে তাদের সংখ্যা বাড়ানো হতে থাকে। ধর্মঘটী রেলকর্মী এমনকি তাঁদের পরিবার-পরিজনের উপর সরকার নির্মম উৎপীড়ন চালাতে থাকে। রেলমন্ত্রী ললিত নারায়ণ মিশ্র হুমকি দেন, ধর্মঘটীদের বরখাস্ত করা হবে। তা সত্ত্বেও ধর্মঘটে অটল থাকেন রেলকর্মীরা। ১৫ মে দেশ জুড়ে সরকারি কর্মচারীরা এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সাধারণ ধর্মঘটে সামিল হন। বম্বেতে বিদ্যুৎ, পরিবহন দফতর এমনকি ট্যাক্সি-ড্রাইভাররা রেলকর্মীদের আন্দোলনে ভাগ নিয়েছিলেন। পেরামবুরে ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরির ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক চেন্নাইতে মিছিল করে গিয়ে ধর্মঘটে সংহতি জানিয়েছিলেন। শুধু ভারতের মেহনতি মানুষই নন, জাপান, অস্টে্রলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেনের শ্রমিকরাও ভারতের রেল-কর্মীদের এই আন্দোলনে সংহতি জানান ও চিঠি লিখে সরকারকে অনুরোধ করেন তাঁদের দাবি-দাওয়া মেনে নিতে। শুধু রেলের শ্রমিক-কর্মচারীরাই নন, মহিলা-শিশু নির্বিশেষে তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও একযোগে আন্দোলনে সামিল হন। তৎকালীন মাদ্রাজে ১ হাজার মহিলা ও শিশু ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিল করে। ত্রিচিতে এমন মিছিলে যোগ দেন প্রায় ২ হাজার নারী ও শিশু। মাদুরাইতে ১ হাজার মহিলার বিক্ষোভ মিছিল রেলের ডিভিশনাল সুপারিনটেন্ডেন্টকে ঘেরাও করে এবং তাঁকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। রেল ধর্মঘটের কারণে চূড়ান্ত অসুবিধায় পড়া সত্ত্বেও কার্যত গোটা দেশের মানুষ রেলকর্মীদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের ধর্মঘটকে সমর্থন করেন।

আন্দোলনকারীদের উপর চূড়ান্ত দমন-পীড়ন

সরকারি বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে ওঠা রেলশ্রমিক-কর্মচারীদের এই অভূতপূর্ব আন্দোলন গায়ের জোরে দমন করার রাস্তা নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন তৎকালীন ইন্দিরা-কংগ্রেস সরকার। সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ পদদলিত করে দমনপীড়নের যে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালিয়েছিল তারা, তা যে কোনও স্বৈরাচারী ও বর্বর শাসককে লজ্জা দিতে পারে। রেল কলোনি ও শ্রমিক মহল্লাগুলিতে পুলিশ এবং বিএসএফ, সিআরপিএফ ইত্যাদির মতো আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। এদের দিয়ে রেলকর্মীদের উপর অকথ্য অত্যাচার ছাড়াও তাঁদের পরিজনদের উপর হামলা চালাতে ভাড়াটে গুন্ডা লাগিয়েছিল সরকার। শুধু মারধর, ভয় দেখানো নয়, আন্দোলনকারীদের বাড়ির মেয়েদের পর্যন্ত রাস্তায় টেনে এনে প্রায় বিবস্ত্র করে নারকীয় অত্যাচার চালানো হয়েছিল। রেল-কোয়ার্টার থেকে পুরুষ কর্মীটিকে গ্রেফতার করে পরিজনদের বের করে দেওয়া হয়েছিল। গ্রেফতার করা হয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার রেলকর্মচারীকে। অনেকের বিরুদ্ধে এমনকি ‘মিসা’-র মতো চরম দমনমূলক আইনেও অভিযোগ দায়ের করা হয়। এছাড়া অপপ্রচার, ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা ইত্যাদি তো ছিলই। এত কিছু সত্ত্বেও সরকার যখন আন্দোলনকারীদের মনোবল ভাঙতে পারল না, তখন পুলিশ-মিলিটারি দিয়ে কর্মীদের ধরে এনে জোর করে বন্ডে সই করিয়ে, বন্দুকের মুখে ফেলে তাদের দিয়ে কাজ করানোর চেষ্টা করে। কোথাও কোথাও এমনকী ড্রাইভারদের কেবিনের সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে ট্রেন চালানো হয়।

প্রথম থেকেই নেতৃত্বের আপসকামী আচরণ

প্রবল উৎপীড়ন সত্ত্বেও রেলকর্মীরা যখন অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন নেতৃত্বকারী তিনটি দলের ভূমিকাই ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক। শুরু থেকে ঘটনাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আন্দোলনের কোনও স্তরেই নেতৃত্ব গুরুত্ব সহকারে এই সংগ্রাম পরিচালনা করতে চায়নি।

ফেব্রুয়ারি মাসে আন্দোলনের প্রস্তুতির লক্ষ্যে দিল্লি সম্মেলনেই ইউটিইউসি-লেনিন সরণির পক্ষে কমরেড প্রীতীশ চন্দ এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সরকারের গতিপ্রকৃতি থেকে স্পষ্ট যে তারা প্রচণ্ড আক্রমণে রেল ধর্মঘট এবার ভাঙতে চাইছে। এই আন্দোলনে কঠিন লড়াই হবে ও তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ফলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার দিকে তাকিয়ে না থেকে কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলার মানসিকতা তৈরি ও তার উপযুক্ত সাংগঠনিক প্রস্তুতি নেওয়ার দিকে বার বার তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সরকারি অত্যাচারের মুখে পড়লে কর্মীরা যাতে নিজেদের মধ্যে ও নেতৃত্বের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে পারেন, সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলেন তিনি। কিন্তু সম্মানজনক মীমাংসায় না আসা পর্যন্ত আন্দোলনকে ধাপে ধাপে শক্তিশালী, দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপকতর করা এবং উন্নত রাজনৈতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতি আদৌ গড়ে তুলতে চায়নি নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত সোসালিস্ট পার্টি, সিপিআই ও সিপিএম– এই তিন দলের কোনও নেতাই। ফলে ধর্মঘট শুরু হওয়ার পর লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীর নিজেদের মধ্যে, কিংবা নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। ধর্মঘট শুরু হওয়ার পরেই এই দলগুলির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যাঁরা ইউনিয়নের নেতা, তাঁরা জেলে ঢুকে গিয়েছিলেন, বাকিরাও আত্মগোপনের এমন রাস্তা নিয়েছিলেন যে কর্মীরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারেননি, কর্মসূচি স্থির করা দূরের কথা। ফলে সরকারি আক্রমণের সামনে কর্মীরা হয়ে পড়েন নিতান্ত অসহায়।

তা সত্ত্বেও নিজেদের উদ্যোগে বহু জায়গাতেই তাঁরা ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সংগঠন ও নেতৃত্ব ঠিক থাকলে প্রায় বিশ লক্ষ রেলকর্মী ও তাঁদের পরিজন মিলে সত্তর লক্ষ মানুষ এই ধর্মঘটে যে মনোবল দেখিয়েছিলেন, তাতে প্রতিদিন উপযুক্ত কর্মসূচি নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারলে ১৯৭৪-এর রেল ধর্মঘট গণআন্দোলনকে অনেক বৃহত্তর স্তরে নিয়ে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারত।

আপসের ফর্মুলা

এই আন্দোলন সম্পর্কে নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি আরও একটি ঘটনায় স্পষ্ট হয়। ধর্মঘট শুরু হওয়ার মাত্র একদিন পরে ১০ মে প্রধানমন্ত্রী সহ পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সিপিআই, সিপিএম সহ বিরোধী দলের নেতাদের যে বৈঠক হয়, সেখানে রেলকর্মী ও সরকারের মধ্যেকার বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে একটি ‘থ্রি-পয়েন্ট ফর্মুলা’-র উদ্ভব হয়। এই ফর্মুলার মূল বক্তব্য ছিল নেতাদের মুক্তি, ধর্মঘট প্রত্যাহার ও আলোচনা নতুন করে আরম্ভ করা– এই তিনটি বিষয় নিয়ে, যা দেখলেই বোঝা যায়, ধর্মঘট আরম্ভের একদিন পর থেকেই কোনও মতে তা তুলে নিতে কতখানি ব্যগ্র ছিলেন নেতারা। এই ফর্মুলায় আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়া পূরণের কথা দূরে থাক, শাস্তিপ্রাপ্ত রেলকর্মীদের প্রশ্ন, এমনকি জেলবন্দি সাধারণ রেলকর্মী বা ইউনিয়নের সাধারণ নেতাদের মুক্তির প্রসঙ্গটিও নেই। রয়েছে শুধু বড় নেতাদের মুক্তির কথা। প্রসঙ্গক্রমে এ কথাও উল্লেখ্য যে, সেদিনই দুপুরে এনসিসিআরএস-এর অ্যাকশন কমিটির বৈঠকে এই ফর্মুলা রিপোর্ট আকারে পেশ করেছিলেন সিপিএম নেতা সমর মুখার্জী। ১২ মে-র অ্যাকশন কমিটির বৈঠকে কমরেড প্রীতীশ চন্দ এই ফর্মুলার তীব্র বিরোধিতা করেন এবং এর মধ্যে দিয়ে নেতৃত্বের দুর্বলতা যেভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল, তার বিরোধিতা করেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের গাইডেন্সে একটি সুস্পষ্ট প্রস্তাবে কমরেড চন্দ ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক দাবিগুলি সম্পর্কে সরকারের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দাবি করেন। ধৃত হাজার হাজার রেলকর্মী, অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ও রাজনৈতিক কর্মী সহ সকলের মুক্তি নিশ্চিত করা ও তাঁদের উপর দায়ের করা দমনমূলক ধারাগুলি প্রত্যাহারের দাবি তোলেন এবং এই প্রস্তাব গ্রহণে সরকারকে বাধ্য করতে ধর্মঘটের সমর্থনে ব্যাপকতর আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু এই প্রস্তাবে ধর্মঘটে প্রধান তিনটি দলের কেউই সেদিন কর্ণপাত করেনি।

কর্মীরা লড়তে তৈরি ছিলেন, নেতৃত্ব নয়

ধর্মঘটী রেলকর্মীরা যখন সরকারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছিলেন তখন সরকারের সঙ্গে আপস-মীমাংসার রাস্তা না খুঁজে নেতৃত্বকারী দলগুলির উচিত ছিল সংগ্রামী রেলকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের মনোবল রক্ষা করা এবং বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ আন্দোলনগুলির সমন্বয় ঘটানো। ধর্মঘটের সমর্থনে শ্রমিক-কৃষক-শিক্ষক-ছাত্র-যুব-মহিলাদের গণসংগঠনগুলিকে যুক্ত করে জনসাধারণের সমর্থনকে সক্রিয় রূপ দিয়ে দেশ জুড়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলা। নেতৃত্বকারী দলগুলির সাংসদরা যদি অত্যাচারিত আন্দোলনকারী ও তাঁদের পরিবারগুলির পাশে দাঁড়াতেন এবং অত্যাচারী সরকারের স্বৈরাচারী চেহারা জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতেন, তা হলে পুলিশি আক্রমণের বিরুদ্ধে তাঁদের নিজস্ব প্রতিরোধব্যবস্থা থাকার কারণে, সরকার পিছু হটতে বাধ্য হত এবং এই ঐতিহাসিক আন্দোলন সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারত।

নেতৃত্বকারী দলগুলির আপসকামী চরিত্র

কিন্তু, এই রেল ধর্মঘটের নেতৃত্বে প্রধান তিনটি স্তম্ভ হিসাবে কাজ করেছে যে এসপি, সিপিআই এবং সিপিএম, তারা নিজেদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই অসাধারণ আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে গণআন্দোলন পরিচালনার সঠিক বিজ্ঞানসম্মত নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেনি।

এসপি একটি সুপরিচিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পার্টি। গণতান্ত্রিক সমাজবাদের স্লোগান তুলে এই দলটি সংসদীয় পদ্ধতিতেই আইন-কানুন পাল্টে সমাজতন্ত্র কায়েম করার কথা বলে। ফলে এই আন্দোলনে এসপি যে ভূমিকা পালন করেছে, তার পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক।

সিপিআই দলটি সেইসময়ে এক দিকে সংশোধনবাদী সোভিয়েট নেতৃত্বের কাছে দাসখত লিখে দিয়েছিল, অন্য দিকে কংগ্রেসের প্রগতিশীল (!) ভূমিকা দেখে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক মোর্চায় যুক্ত ছিল এবং ক্ষমতাসীন জাতীয় বুর্জোয়াদের হয়ে ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর ধারক-বাহক হয়ে বসেছিল। ফলে ধর্মঘট শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরেই তাদের নেতা শ্রীপাদ ডাঙ্গে খোলাখুলি বলেছিলেন, রেলের মতো শিল্পে বেশিদিন ধর্মঘট চলতে দেওয়া ঠিক নয়, কারণ তাতে ‘জাতীয় স্বার্থ’ বিপন্ন হয়ে পড়বে। শ্রেণিবিভক্ত এই রাষ্ট্রে তাঁদের ‘জাতীয় স্বার্থ’-কে বিপন্ন হতে না দেওয়ার দুশ্চিন্তা যে দেশের মেহনতি জনসাধারণের স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার জন্য নয়, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় উদ্বেল, শ্রেণি-সচেতন মানুষের তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষাকারী ইন্দিরা কংগ্রেসের বক্তব্যের সঙ্গে তাদের বক্তব্যের বিশেষ পার্থক্য ছিল না।

১৯৭০-এর দশকে সিপিএম দলটির কর্মীদের মধ্যে কিছুটা সংগ্রামী বামপন্থী মেজাজ ছিল। তাঁরা নিজেদের বিপ্লবী দল বলতেন, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা প্রচার করতেন। এই অবস্থায়, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব বলতে যদি তাঁরা রাষ্ট্র-বিপ্লবকেই বোঝাতেন, তাহলে তো দেশের ভিতরে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনগুলিকে ব্যাপকতর করে, স্তরে স্তরে উন্নত করে সেগুলোকে উন্নত রাজনৈতিক চেতনার স্তরে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা তাঁদের মধ্যে দেখা যাওয়া উচিত ছিল। রেল ধর্মঘট তাঁদের সামনে সেই সুযোগ চমৎকারভাবে এনে দিয়েছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা সিপিএম নেতৃত্ব করেননি। এস ইউ সি আই (সি)-র পক্ষে কমরেড প্রীতীশ চন্দ যখনই অ্যাকশন কমিটি বা ট্রেড ইউনিয়ন বৈঠকগুলিতে বার বার গণসংগঠনগুলিকে যুক্ত করে রেল ধর্মঘটকে ব্যাপকতর করার প্রস্তাব এনেছেন, সিপিআই নেতাদের সুরে সুর মিলিয়ে সিপিএমের পলিটবুরো সদস্য ও সিটুর সাধারণ সম্পাদক রামমূর্তি প্রতিবারই তার বিরোধিতা করেছেন। কোনও সময়েই রেল ধর্মঘটের সঙ্গে গোটা দেশের জনসাধারণের সমর্থনকে যুক্ত করে এই আন্দোলনকে বিস্তৃত করার কোনও উদ্যোগই তাঁরা নেননি। ১৫ মে তাদের প্রস্তাবিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাকশনের প্রস্তাবের বদলে ইউটিইউসি-এলএস-এর পক্ষে ভারত বনধের প্রস্তাব দিলে ডাঙ্গের মতো করেই সিটুর রামমূর্তি বিরোধিতা করে কমরেড চন্দকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘রেল আন্দোলনের পরিধি ও গভীরতাকে বাড়াবেন না’ (ডোন্ট অ্যাড ডাইমেনশন টু ইট)। শুধু তাই নয়, অর্থনীতির চূড়ান্ত বেহাল দশায় যখন দেশের মানুষ চূড়ান্ত বিক্ষুব্ধ, সেই সময় রেল ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের মধ্যে সংগ্রামী আন্দোলনে সামিল হওয়ার যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তাকে কাজে লাগাতে সমস্ত বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে যুক্ত করে একটি যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় এস ইউ সি আই (সি) গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু এরও কার্যকরী বিরোধিতা করেছিল সিপিআই, সিপিএম।

বুঝতে অসুবিধা হয় না, গণআন্দোলন পরিচালনায় এস ইউ সি আই (সি)-র আপসহীন চরিত্রের কারণেই এই ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও এনসিসিআরএস-এ কমরেড প্রীতীশ চন্দকে জায়গা দেওয়া হয়নি, যে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, সিপিএম ও তাদের ট্রেড ইউনিয়নের গরম বিপ্লবী বুকনিগুলি যে নেহাতই প্রতারণামূলক, এই দলটি সঙ্গে থাকলে বার বার তা জনসমক্ষে এসে যাবে। সেই ঝুঁকি নিতে চায়নি বলে সঙ্গত কারণেই এনসিসিআরএস-এ-র মধ্যে ইউটিইউসি-এলএস-কে অন্তর্ভুক্ত করার সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা এসেছিল সিটু এবং এআই×টিইউসি-র কাছ থেকে।

ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা

১৬ মে ট্রেড ইউনিয়নগুলি ও অ্যাকশন কমিটির বৈঠকে কমরেড প্রীতীশ চন্দ আরও একবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন-নিবেদনের রাস্তা ছেড়ে সমস্ত বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনগুলিকে যুক্ত করে রেল ধর্মঘটের সমর্থনে দেশজুড়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করার প্রস্তাব দেন। এবারও নেতৃত্বকারী দলগুলি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি দিল্লির আশপাশের ধর্মঘটী শ্রমিকদের সমবেত করে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থানের যে কর্মসূচিটি ইউটিইউসি-এলএস দিয়েছিল, সেটিও সিপিআই ও সিপিএম নেতৃত্ব শোনামাত্র খারিজ করে দেন। ইন্দিরা সরকারের মধ্যে সেই সময় তাঁরা নাকি আপস-মীমাংসার মনোভাব দেখতে পেয়েছিলেন! শুধু তাই নয়, এ দিনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন ১৭ মে পার্লামেন্টের বিরোধী দলের নেতারা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাইলে চূড়ান্ত অপমানজনক ভাবে তা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিরোধী নেতাদের জানানো হয়, ধর্মঘট তুলে না নেওয়া পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে ইন্দিরাজি কোনও আলোচনাই করবেন না।

এই ঘটনার পর থেকেই সিপিএম সহ পার্লামেন্টের সমস্ত বিরোধী নেতারাই ধর্মঘট প্রত্যাহারের ব্যাপারে চূড়ান্তভাবে ব্যগ্র হয়ে পড়েন এবং তার জন্য যে কোনও উপায়ে একটি সূত্র বা ফর্মুলা বের করার জন্য হন্যে হয়ে চেষ্টা করতে থাকেন। তাঁরা কখনও কংগ্রেসের রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটির সদস্যদের সাথে, কখনও কংগ্রেসের নানা স্তরের নেতাদের সাথে দেখা করে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

এইভাবে রেল ধর্মঘট শক্তিশালী করার বদলে আপস-মীমাংসায় আসার জন্য আলোচনার ব্যবস্থার করতে নেতাদের যে মাত্রাতিরিক্ত ব্যগ্রতা ছিল, তা দেখে এবং নেতাদের আচরণের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠা দুর্বলতা লক্ষ করে ইন্দিরা গান্ধী সহজেই ধরতে পেরেছিলেন যে, এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাঁর সরকার যত দৃঢ় হতে থাকবে, ততই এই নেতারা আতঙ্কিত হতে থাকবেন, আপসের রাস্তা খুঁজবেন। বাস্তবে ঘটেছেও তাই।

সিপিএম-এর সঙ্গে যুক্ত রেলকর্মীরা ও তাদের প্রভাবিত ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যরা ১৬ মে থেকেই নানা জায়গায় ধর্মঘট ভেঙে কাজে যোগ দিতে শুরু করেন। নেতারা তাঁদের আটকানো দূরে থাক, যেখানে যেখানে ধর্মঘটের পক্ষে কর্মীদের অটুট মনোবল দেখেছেন, সেখানে কৌশলে কর্মীদের কাজে যোগ না দিয়ে মাইনে তুলতে যাওয়ার জন্য প্রভাবিত করেছেন এ কথা জেনেই যে, মাইনে তুলতে গেলেই কর্মীদের গ্রেফতার করা হবে এবং জোর করে তাঁদের দিয়ে কাজ করাবে সরকার।

এই অবস্থায় ২৮ মে বিনা শর্তে রেল ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। ধর্মঘটপ্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়ে ২৬ মে জেলের ভিতর থেকে ফার্নান্ডেজ সহ অ্যাকশন কমিটির সদস্যরা একটি চিঠি পাঠান। লক্ষণীয়, সেই চিঠি ২৭ মে অ্যাকশন কমিটির বৈঠকে পড়ে শুনিয়ে তৎক্ষণাৎ সেটি সংবাদপত্রগুলির দফতরে পাঠানো ও ধর্মঘট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছিলেন সিপিএম নেতা সমর মুখার্জী স্বয়ং। পরিস্থিতি দেখে কমরেড প্রীতীশ চন্দ ও এআইআরএফ নেতা প্রিয় গুপ্ত এই চিঠিতে উল্লেখিত ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কমিটির সকলের মতামত রেকর্ড করার জন্য চাপ দেন এবং ইউটিইউসি-লেনিন সরণির পক্ষ থেকে কমরেড চন্দ ধর্মঘট প্রত্যাহারের সেই প্রস্তাবের স্পষ্ট বিরোধিতা করেন।

নেতৃত্বকারী দলগুলি পুঁজিবাদের প্রতি নিজেদের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করেছিল

১৯৭৪-এর ধর্মঘটে সামগ্রিকভাবে সাধারণ রেলকর্মীদের মনোবল যে রকম অটুট ছিল এবং দেশের জনসাধারণের এই ধর্মঘটে যে অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল, তাতে আন্দোলনকারীদের সংগ্রামী চেতনার উপর ভরসা রেখে আরও কিছুদিন এই ধর্মঘট চালিয়ে গেলে সরকারের অনমনীয় মনোভাবের উপযুক্ত জবাব দেওয়া যেত।

 সেই সময়েই এস ইউ সি আই (সি)-র পক্ষ থেকে ‘ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের পর্যালোচনা’ পুস্তকে বলা হয়েছিল, ‘‘ধর্মঘট প্রত্যাহৃত হওয়ার সংবাদ রেডিও ও কাগজে প্রচারিত হওয়া সত্ত্বেও বহু জায়গায় রেলকর্মীরা তারপরেও দু-একদিন বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মঘট চালিয়ে গিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, তারা তখনও লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলেন। আর, অন্য দিকে ইন্দিরা সরকার বাইরে যতই অনমনীয় মনোভাব দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে অবস্থা তাদের পক্ষেও তখন চূড়ান্ত খারাপের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, প্রথম দিকে ইন্দিরা গান্ধী যেটা আশা করেছিলেন এবং দেশের ভিতরে শিল্পপতি ও একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠীদের আশ্বাসও দিয়েছিলেন যে, সাত-আট দিনের মধ্যেই রেল ধর্মঘট তিনি ভেঙে দিতে পারবেন এবং সেরকমভাবেই, বড় জোর তার দু’এক দিনের বেশি প্রস্তুতি নিয়ে রেল ধর্মঘট মোকাবিলা করার জন্য তিনি এগিয়েছিলেন, সরকারি এত অত্যাচার এবং নেতৃত্বের এত ত্রুটি এবং দুর্বলতা সত্ত্বেও রেলকর্মীদের বিস্ময়কর সংগ্রামী মনোবলের জন্য দীর্ঘদিন পার হওয়ার পরও তার সে আকাঙক্ষা সফল হয়নি। ফলে, গোড়ার দিকে শিল্পপতি ও একচেটিয়া পুঁজিপতিরা রেল ধর্মঘটে সরকারি আচরণের যতই তারিফ করুক না কেন, দীর্ঘদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও রেল ধর্মঘট ভাঙার কোনও লক্ষণই যখন দেখা গেল না, এবং স্বাভাবিক ভাবেই শিল্পে ও অর্থনীতিতে তার চাপ প্রকট হয়ে দেখা দিতে শুরু করল, তখন সেই সমস্ত শিল্পপতি এবং একচেটিয়া পুঁজিপতিরাই আতঙ্কিত হয়ে গিয়ে রেল-কর্মীদের সাথে মীমাংসায় যাবার জন্য তাদেরই সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে। এই অবস্থায় রেল ধর্মঘট আর কিছুদিন চললে ইন্দিরা সরকারের পক্ষে নতি স্বীকার করে রেলকর্মীদের সাথে একটা সম্মানজনক মীমাংসায় আসা ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা থাকত না। … অথচ, ঠিক যে সময়ে রেলশ্রমিকরা প্রায় বিজয়ের মুখে এসে গিয়েছিল, সেই সময়েই রেল আন্দোলনের বর্তমান নেতৃত্ব যেভাবে নিজেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়ে ইন্দিরা সরকারকে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে উদ্ধার করলেন, এবং তার দ্বারা রেলশ্রমিকদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করলেন, তাতে লেনিনের ভাষায় তাদের ‘ওয়ার্স্ট ক্রিমিনাল’ ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। বাস্তবে রেল ধর্মঘটের ক্ষেত্রে আগাগোড়া এই দলগুলি যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করেছে এবং আন্দোলনের চরম মুহূর্তে জাতীয় স্বার্থের দোহাই তুলে যেভাবে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে, তাতে এ কথা নিঃসংশয়ে বলা চলে যে, এই তিনটি দলই বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিশ্বস্ত অনুচর হিসাবে তাদের যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করে গিয়েছে।”

এইভাবে বিরাট সম্ভাবনাপূর্ণ ঐতিহাসিক এই রেল ধর্মঘট নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত এসপি, সিপিআই ও সিপিএম– এই তিনটি দলের চূড়ান্ত বুর্জোয়া সংস্কারবাদী ও আপসকামী মনোভাবের জন্য শোচনীয় পরিণতিতে শেষ হয়।

আজ রেলকে বাঁচানোর প্রয়োজনেই সংগঠিত রেলকর্মী আন্দোলন দরকার। আর সেই আন্দোলনকে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে হলে বিগত আন্দোলনের দুর্বলতাগুলি থেকে শিক্ষা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।