ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় এআইকেকেএমএস

দিল্লির কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে এআইকেকেএমএস-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতায় মিছিল। ৩ ডিসেম্বর।

‘আমাদের তো এমনিই আত্মহত্যা করতে হবে, নতুন করে করোনাতে ভয়ের কী আছে! আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব’ – দৃপ্ত ভঙ্গিতে বললেন গুরুব’ সিং, সুরেশ যাদবেরা। সাড়া ফেলে দেওয়া দিল্লির কৃষক আন্দোলনে এঁরাও এসেছেন লক্ষ লক্ষ কৃষকের মতো দাবি আদায়ের দৃঢ় মনোবল নিয়ে। ঘরবাড়ি, খেতখামার সমস্ত কিছু ছেড়ে তারা পণ করেছেন, যদি মাসের পর মাস অবরোধ করতে হয় তো ‘সে ভি আচ্ছা’। কিন্তু সরকারকে কৃষক মারা তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করতেই হবে। শুধু পাঞ্জাব, হরিয়ানা নয়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকেও এসেছেন কৃষকরা।

এই প্রত্যয়ের কাছে হার মেনেছে রাষ্টে্রর দমনপীড়নের শক্তি পুলিশ-প্রশাসন। তারা করোনা সংক্রমণের অজুহাত তুলে কৃষকদের দিল্লিতে ঢুকতে বাধা দিয়েছে। লাঠি-জলকামান-টিয়ারগ্যাস চালিয়ে, ভারি ভারি ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড করেও কৃষকদের অটুট মনোবলে এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি। প্রবল শীত উপেক্ষা করে রাজধানী দিল্লির চার সীমান্তে লক্ষ লক্ষ কৃষক বৃদ্ধ-যুবক নির্বিশেষে ‘দিল্লি চলো’ অভিযানে সামিল হয়েছেন। আন্দোলনে সামিল বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা একযোগে বিজেপি সরকারকে জানিয়েছে, ‘আমাদের ভাল করতে হবে না। আপনারা শুধু এই তিনটি কালা কানুন প্রত্যাহার করুন।’

দেশের বেশিরভাগ কৃষক সংগঠন এই আন্দোলনে সামিল। তিনটি বৃহৎ কৃষক জোটকে নিয়ে গড়ে উঠেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা (এসকেএম)। এই মোর্চার শরিক এ আই কে এস সি সি, যার অন্যতম শরিক অল ইন্ডিয়া কিষান খেতমজদুর সংগঠন (এআইকেকেএমএস) সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি সরকারের কৃষক মারা নীতির বিরুদ্ধে, আন্দোলন সংগঠিত করছে দেশ জুড়ে। ২৬ নভেম্বর থেকে চলা এই কৃষক বিক্ষোভের ফলে সরকার বাধ্য হয়েছে দফায় দফায় কৃষক প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করতে। কিন্তু মালিক শ্রেণির সেবায় নিয়োজিত সরকার কৃষকদের বক্তব্যের কোনও মূল্যই দেয়নি।

লকডাউনের সুযোগ নিয়ে কৃষিতে লুঠেরা বহুজাতিক পুঁজির প্রবেশ-দ্বার খুলে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কৃষক বিরোধী এই তিনটি আইন এবং জনবিরোধী বিদ্যুৎ আইন-২০২০ যখন পাশ করল তখন থেকেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এআইকেকেএমএস। কেকেএমএস সরকারের তিনটি কালা কৃষি কানুনের আসল চেহারা তুলে ধরে সাধারণ কৃষিজীবী মানুষকে নিয়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।

আন্দোলনরত নানা রাজ্যের কৃষক সংগঠনগুলির সর্বভারতীয় সংগঠন এআইকেএসসিসি-র ওয়ার্কিং কমিটিতে রয়েছেন কেকেএমএস-এর প্রতিনিধিরা। ২৫ সেপ্টেম্বর এআইকেএসসিসি যখন কালা কানুনের প্রতিবাদে গ্রামীণ ভারত বনধের ডাক দেয়, কেকেএমএস সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ১৪টি রাজ্যে ৩ হাজারেরও বেশি গ্রামে প্রচার করেন সংগঠনের সদস্যরা, ২ হাজারের বেশি জায়গায় রাস্তা অবরোধ করেন, সভা করেন অসংখ্য। আইনের প্রতিলিপি পোড়ানো হয় হাজার হাজার। কালা কানুনগুলির বিরুদ্ধে ১৪ অক্টোবর সারা ভারত কিষান প্রতিবাদ দিবসের ডাক দেয় এআইকেকেএমএস। এ দিন রাস্তা রোকো, রেল অবরোধ, ব্লক অফিস অবরোধ করেন সংগঠনের সদস্যরা। জনসভা, পথসভা, গ্রুপ মিটিং, গ্রামে গ্রামে কিষান কমিটি গড়ে তোলে কেকেএমএস। কৃষিনীতির ভয়াবহ দিকগুলি তুলে ধরে নানা ভাষায় প্রচার পুস্তিকা, লিফলেট বের করে অসংখ্য কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সংগঠন পরিচালিত অনলাইন আলোচনা সভায় কয়েক লক্ষ মানুষ এই নীতিগুলির ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত হন।

এই আন্দোলনের বিস্তারে ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট একটা মাইল ফলক। এ দিন বিজেপি সরকারের নানা জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে ১০টি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন যে ভারত বনধের ডাক দিয়েছিল, তাতে কৃষক স্বার্থবিরোধী কৃষিনীতি প্রত্যাহারের দাবি যুক্ত থাকায় কেকেএমএস এই বনধকে সমর্থন জানায়। বনধের সমর্থনে নানা জায়গায় সভা করে। ১৪টি রাজ্যে বনধ সফল করতে পথে নামে সংগঠনের সদস্যরা। হাজার হাজার গ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করে কৃষক বিরোধী কৃষিনীতির প্রতিলিপি পোড়ানো হয়। এস ইউ সি আই (সি) দল ও তার বিভিন্ন গণসংগঠনও পথে নামে।

কৃষক আন্দোলনের তীব্রতা দেখে ধূর্ত বিজেপি সরকার বিভ্রান্তি তৈরি করার চেষ্টা করছে– কৃষকদের ভালোর জন্যই নাকি তারা এই আইনগুলি নিয়ে এসেছে। প্রবাদ আছে, নিজের ভাল পাগলেও বোঝে। কৃষকরা নাকি নিজেদের ভাল বুঝতে পারছে না, সরকার তাদের ভাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে! কৃষকরা পাল্টা প্রশ্ন তুলছে, নোট বাতিল, জিএসটি সবই মানুষের ভালর জন্য করা হয়েছে বলে সরকার প্রচার করেছিল। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের ক্ষতি বই লাভ হয়নি। কৃষকরা বুঝেছেন এসব ধাপ্পা। কর্পোরেট মালিক আম্বানি-আদানিদের স্বার্থে তৈরি কৃষি আইনে কৃষকদের ভাল করার ঘোষণা নির্ভেজাল প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। বিভ্রান্তি বাড়াতে সরকার আরও প্রচার করছে যে ফসলের নূ্যনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) তারা তুলে নেয়নি। যদি নাই তুলে দেবে তাহলে তার উল্লেখ আইনের কোথাও নেই কেন?

২৭ নভেম্বর থেকে কৃষক সংগঠনগুলির আহ্বানে ‘দিল্লি চলো’ অভিযান সফল করতে সাধ্যমতো ভূমিকা নেয় কেকেএমএস। দিল্লির আশপাশ থেকে কৃষকদের নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংগঠন সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি, এ আই কে এস সি সি-র ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য কমরেড সত্যবান আন্দোলন মঞ্চে বলেন, এ আন্দোলন শুধু কৃষকদের নয়, সমস্ত দেশবাসীর। তিনি বলেছেন, আন্দোলন ছাড়া দাবি আদায় করার আর কোনও পথ নেই। ভগৎ সিং-রা যেমন স্বাধীনতার লড়াই করেছিলেন আমৃত্যু, এই আন্দোলনও তেমন দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত চালাতে হবে।

কৃষক বিরোধী ও জনবিরোধী কৃষি নীতির প্রতিবাদে রাজ্যে রাজ্যে কেকেএমএস আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ূ – ১৪টি রাজ্যে বিক্ষোভ সভা, মিছিল সহ নানা কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে। তেলেঙ্গানা-কেরালাতেও আন্দোলন হয়েছে সংগঠনের উদ্যোগে। ২৬ নভেম্বর ধর্মঘটের আগেই কেকেএমএস হরিয়ানা রাজ্য সম্পাদক কমরেড জয়করণ মান্ডৌথি সহ কৃষক নেতাদের গ্রেপ্তার করে কয়েকদিন জেলে আটকে রাখে রাজ্যের বিজেপি সরকারের পুলিশ। কৃষকরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। একদিকে জনবিরোধী কৃষি নীতি, অন্যদিকে পুলিশের দমন পীড়ন– মানুষের বিক্ষোভে ঘৃতাহুতি দেয়। আন্দোলনের ঢেউ নতুন নতুন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ধূর্ত বিজেপি প্রশ্ন তোলে, তাহলে কি আগের কৃষিনীতি ভাল ছিল? কৃষকরা জোরের সাথে বলছেন, না। কংগ্রেস আমলের কৃষিনীতিতেই কৃষকরা আধমরা হয়েছিল, বিজেপি সরকারের করা নয়া কৃষি আইনে কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পুরোপুরি মারা পড়বে।

বিভ্রান্তি ছড়াতে বিজেপি সরকার নানা কৌশল নিচ্ছে। কখনও এই আন্দোলনকে খালিস্তানি আন্দোলন বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কখনও বলছে, এটা ধনী কৃষকদের আন্দোলন। অথচ রিপোর্ট বলছে, দেশের ৮৬ শতাংশই ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক চাষি। ধনী কৃষক কজন? বৃহৎ পুঁজির আক্রমণ থেকে বাঁচতে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল চাষিরাও আন্দোলনে আসবেন এটাই স্বাভাবিক। দুরাত্মার ছলের অভাব নেই। তাই কখনও ধুয়া তুলছে, বিদেশ থেকে টাকা আসছে আন্দোলনে, উস্কানি দিচ্ছে। কৃষকরা এর জবাব দিয়েছেন দৃঢ়তার সাথে। বলেছেন, কোনও জনআন্দোলনে অর্থের অভাব হয় না। সমস্ত মানুষ আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, তারা অর্থ সাহায্যও দিচ্ছেন।

অনেক অসৎ উপায় অবলম্বন করেও আন্দোলনের তীব্রতাকে এতটুকু দমাতে পারেনি বিজেপি সরকার। ৩ ডিসেম্বর কিষাণ সংহতি দিবস পালিত হয় দেশজুড়ে। কলকাতায় ওই দিন কেকেএমএসের মিছিলে নেতৃত্ব দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর ঘোষ। ওই দিন বিজয়ওয়াড়ায় কেকেএমএসের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য সম্পাদক কমরেড বি এস অমরনাথকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সরকার এবং পুলিশ প্রশাসনের দমন-পীড়ন যতই বাড়ছে, ততই বেশি বেশি করে কৃষকরা ‘হয় জিতব, না হয় মরব’ শপথ নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। ছাত্র সংগঠন এ আই ডি এস ও, যুব সংগঠন এ আই ডি ওয়াই ও, মহিলা সংগঠন এ আই এম এস এস সংহতি সপ্তাহ পালন করে আন্দোলন বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। সর্বশক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে শ্রমিক সংগঠন এ আই ইউ টি ইউ সি। দেশের বিশিষ্ট মানুষেরা এমনকি বিদেশ থেকেও কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি বার্তা দিয়েছেন বহু জন। সরকারের দেওয়া খেতাব-পদক ফিরিয়ে দিচ্ছেন বহু গুণীজন। আন্দোলনের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।

সরকার কৃষি আইন সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছিল, তা নস্যাৎ করে কৃষক নেতারা জানিয়েছেন, এই তিনটি জনবিরোধী আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। কৃষক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (এসকেএম) ৮ ডিসেম্বর ভারত বনধের ডাক দিয়েছে। এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং তার প্রতি জনসমর্থন দেখে পুঁজিপতি আম্বানি-আদানিদের সেবক বিজেপি সরকার প্রমাদ গুনছে।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১২ সংখ্যা_১১ ডিসেম্বর, ২০২০)