এ কোন বামপন্থার চর্চা!

পশ্চিমবঙ্গ বামপন্থী আন্দোলনের পীঠস্থান৷ অথচ সরকারে যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই সিপিএম যা করতে শুরু করল, প্রথম প্রথম খুব দুঃখ হত সেসব দেখে৷ তারপর হত রাগ৷ এর পরে কী আসে– হতাশা? না, আমি হতাশ নই৷ বামপন্থার প্রতি আস্থা আজও আমার আছে৷ সে জন্যই চিঠিটা লিখছি এবং আপনাদের পাঠাচ্ছি৷

১৯৭৭ সাল থেকে টানা প্রায় তিন দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র দলীয় কব্জা কায়েম করেই বিরাট কেউকেটা হয়েছিলেন সিপিএম নেতারা৷ ২০০৬–’০৭ সালে সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামের মানুষই প্রথম তাদের চ্যালেঞ্জ জানাল৷ প্রধানত সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোট এবং ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে সিপিএমের ক্ষমতার গড় ভেঙে পড়ল৷ সেই থেকেই কার্যত পায়ের তলায় আর কোনও মাটি নেই তাঁদের৷ গোড়ালি, হাঁটু, কোমরের হাড় এবং মেরুদণ্ডের ধ্বংসাবশেষ অর্থাৎ নৈতিক শক্তি ও মনোবল এমন ভাবে গুঁড়িয়ে গিয়েছে নেতাদের যে, এখন সামান্য উঠে দাঁড়াতে গেলেও দু–হাত জোড় করে কংগ্রেসের ক্রাচ ভিক্ষে করতে হচ্ছে৷ নেতৃত্বের এ হেন হাল দেখে কে বলবে, এ সেই প্রবল প্রতাপান্বিত সিপিএম, যার দুর্দান্ত দাপটে এক সময় সিঁটিয়ে থাকত রাজ্যের সাধারণ মানুষ

গত সাত–আট বছর ধরে ক্ষমতায় ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে কী না করছে তাদের নেতারা পঞ্চায়েত ভোটেও বিভিন্ন এলাকায় বিজেপির সাথে যোগসাজশে আসন বাড়াবার কৌশল করেছিল তারা৷ পাড়ায়–পাড়ায়, গ্রামে–গ্রামে গিয়ে কর্মীদের বুঝিয়েছিল, তৃণমূল আমাদের সরকার কেড়ে নিয়েছে, ফলে ওরাই আমাদের প্রধান শত্রু৷ ওদের হঠাতে যা করতে হয় কর৷ নীতি–নৈতিকতাহীন ক্ষমতা দখলের নোংরা রাজনীতির পচা পাঁকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সিপিএম নেতৃত্ব আজ পড়েছে মহা ফাঁপরে৷ কারণ, তল্লাটে নিচু তলার কর্মী–সমর্থকদের মৌরসিপাট্টা কেড়ে নিয়েছে তৃণমূল৷ দাদাগিরি, তোলাবাজি, প্রোমোটারির ময়দানে এখন কেবলই জোড়াফুল৷ এই ‘বঞ্চনা’ সইতে না পেরে সিপিএম কর্মী–সমর্থকেরা, এমনকী নেতারাও, দলে দলে যোগ দিয়েছে দিদির ‘উন্নয়নের যজ্ঞে’৷ যারা সে সুযোগ পাচ্ছে না, তারা ঢুকছে বিজেপিতে৷

সুবিধাবাদের হিসেবনিকেশ যখন প্রায় শেষ, লোকসভার ভোট যখন শিয়রে তখন সিপিএম নেতাদের যেন টনক নড়েছে৷ তাঁরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন, রাজ্যে তাদের শূন্য করে দেওয়ার জন্য অন্য কোনও শত্রুর দরকার নেই, নিজেদের কর্মী–সমর্থকরাই যথেষ্ট৷ মূলত তারাই বাড়িয়ে চলেছে গেরুয়া দুর্বৃত্তদের শিবির৷ এলাকায় এলাকায় চোখে পড়ছে সিপিএম পার্টি অফিসের পাশের দেওয়ালে বিজেপি প্রার্থীর পোস্টার৷ কিসে কী হচ্ছে ধরতে পেরে বিমান বসু–সূর্যকান্তরা মিটিংয়ে হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করেছেন৷ কর্মীরা তলায় তলায় বলছেন, ‘ছাড়  ওসব৷ তৃণমূলকে টাইট দিতে গেলে বিজেপিকেই ভোটটা দিতে হবে৷’ কোনও কেন্দ্রিকতা ছাড়া পাহাড় থেকে সাগর সর্বত্র এই মানসিকতা এল কোত্থেকে? এ হেন মনোভাবের স্পষ্ট বার্তা পেয়ে রাজ্যে তৃণমূলকে টেক্কা দিতে নোটের বাণ্ডিল, মদ, মস্তান–বাহিনী আর রক্তাক্ত দাঁত–নখ এবং লকলকে জিভ নিয়ে ঘোঁৎ–ঘোৎ করতে শুরু করেছে জাত–ধর্ম ভাঙিয়ে খাওয়া বিজেপি৷ এক শ্রেণির ভাড়াটে সাংবাদিক টিভি–রেডিও–কাগজ ইত্যাদিতে দিনরাত বুঝিয়ে চলেছে রাজ্যে বিজেপিই এখন ‘দু–নম্বর’ দল৷ ফলে, সিপিএমের অস্তিত্ব জনসমক্ষে ফর্দাফাঁই এবং নেতারা কার্যত দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য৷

ফলে, সিপিএম যে শুধু শূন্য হবে তা–ই নয়, বরং মাইনাসে রান করবে বলেই নানা জায়গায় কানাঘুষো চলছে৷ পরিচিত অনেকেই বলছেন, তিন–তিনটে দশক ধরে ভোট–রাজনীতিকে সম্বল করে নৈতিকতার যে কবর সিপিএম নেতারা খুঁড়েছেন, পরিস্থিতি যেন সেই কবরের দিকেই তাঁদের ঠেলছে৷

তবু বামপন্থী হিসাবে আমি হতাশ নই৷ কারণ, আপনাদের দল রাজ্যের বিয়াল্লিশটা আসনেই লড়ছে বরাবরের মতো নীতি–আদর্শকে ভিত্তি করে৷ কাকে ভোট দেব, এ কথা আর ভাবতে হবে না৷

পলাশ মিত্র, কলকাতা–৭৭

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা)