আম্বানি–আদানিদের ‘আচ্ছে দিন’, বিপুল হারে দেশে বাড়ছে বৈষম্য

প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশের মতো ভারতেও আর্থিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমান৷ একদিকে ধনী–মালিক শ্রেণির প্রতিনিধি যারা তাদের ধনসম্পদ ফুলে ফেঁপে উঠছে৷ অন্য দিকে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, শ্রমিক, কৃষক, যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাঁরা প্রতিদিন পরিণত হচ্ছেন হতদরিদ্রে৷ তা হলে দেশে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ তৈরি হচ্ছে কোটি কোটি শ্রমিক–কৃষক মেহনতি মানুষের কঠোর পরিশ্রমে তা যাচ্ছে কোথায়?

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পত্রিকা ‘ফোবর্স’ ধনীতম ভারতীয় ১০০ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে৷ যেখানে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মুকেশ আম্বানি, যার মোট সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে ভারতীয় মুদ্রায় ৩.৭ লক্ষ কোটি টাকা, আছেন এক নম্বরে৷ গত ৫ বছরে যার সম্পদ বেড়েছে ১১৮ শতাংশ৷ এই তালিকায় দ্বিতীয় শিল্পপতি গৌতম আদানি৷ যার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১.১৩ লক্ষ কোটি টাকা৷ যিনি গত বছরের তালিকা থেকে আট ধাপ উঠে এসে এবার ২ নম্বর স্থানে৷ আদানির সম্পদ গত ৫ বছরে বেড়েছে ১২১ শতাংশ৷ এঁদের ঠিক পিছনেই রয়েছেন যথাক্রমে অশোক লেল্যান্ডের মালিক হিন্দুজা ভাইয়েরা (মোট সম্পদ : ১.১২ লক্ষ কোটি টাকা), সাপুরজি পালোনজি গ্রুপের মালিক পালোনজি মিস্ত্রী (মোট সম্পদ : ১০.৭৯ হাজার কোটি টাকা)৷ কোটাক মাহিন্দ্রা ব্যাঙ্কের মালিক উদয় কোটাক মোট সম্পদ ১০.৬৫ কোটি টাকা৷

বলা বাহুল্য, ‘ফোবর্স’ পত্রিকার এই সদ্য প্রকাশিত তালিকা কতগুলো নির্মম সত্যকে একই সাথে প্রকাশ করে দিয়েছে৷ ধনীতম ভারতীয়দের প্রথম ১০০ জনের মোট সম্পদ ২০১৪ সালের ২৫ লক্ষ কোটি টাকা থেকে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩২ লক্ষ কোটি টাকা৷ অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ৩১ শতাংশ৷ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ শতাংশের মালিক এই ১০০ জন ধনী৷ আরেকটি বিষয়ও উল্লেখযোগ্য৷ গত ১২ বছর ধরেই দেশের ধনীতম ভারতীয়ের শীর্ষস্থানটি দখলে রেখেছেন বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি৷ মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে যার সম্পদ বেড়েছে ১১৮ শতাংশ৷ অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি৷ অপর মোদি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানি, যার মোদি ঘনিষ্ঠতা মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময় থেকেই সুবিদিত, তারও সম্পদ বেড়েছে ১২১ শতাংশ৷ মোদি আমলে অন্যান্য শিল্পপতিদের সাথেও বিজেপি–আরএসএসের ঘনিষ্ঠতা কারও অজানা নেই৷ বুঝতে অসুবিধা হয় না, ‘আচ্ছে দিন আনেওয়ালে হ্যায়’ বলতে প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রাক্কালে মোদিজি ঠিক কাদের ‘আচ্ছে দিন’ আনার কথা বলেছিলেন!

তথ্য থেকে স্পষ্ট শ্রমিক–কৃষক সহ শ্রমজীবী মানুষের চরম দারিদ্রের কারণ, তারা যে সম্পদ তৈরি করে চলেছেন, তা অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করছে এই মালিকরা৷ পুঁজিবাদী নীতির কারণেই মালিকরা এই নীতিহীন শোষণ চালাতে পারে৷ সরকারগুলিও মালিকদেরই পাশে দাঁড়ায়৷ তাই দেশজুড়ে যখন কৃষকদের আত্মহত্যার স্রোত বইছে, শ্রমিকরা সপরিবারে আত্মহত্যা করছেন, তখন মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের সম্পদের পরিমাণ বেড়েই চলেছে৷ দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদের মালিকানা কুক্ষিগত হয়েছে মাত্র ১ শতাংশের হাতে৷ স্বাধীনতার পর থেকেই কংগ্রেস, বাম নামধারী সিপিএম, বা তৃণমূলের মতো আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলো প্রত্যেকটির চরম মালিকঘেঁষা নীতির ফলেই আর্থিক বৈষম্য এমন হু হু করে বেড়ে চলেছে৷ দেশে বেকারির জ্বালায় বা অনাহারে মৃত্যু বাড়ছে প্রবলভাবে৷ ভিটে মাটি হারাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ৷ দেশের নেতা–মন্ত্রীরা উন্নয়নের কথা বলে, উগ্র প্রাদেশিকতায়, ধর্মান্ধতায়, উগ্র জাতীয়তাবাদের মোহে যতই দেশের মানুষকে ভোলানোর চেষ্টা করুন না কেন, শোষিত মানুষ বেশিদিন আর এই বৈষম্য মেনে নেবেন না৷ সেই দিন আর দূরে নেই, যেদিন দেশের লক্ষ কোটি জনতা তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য আদায়ে সমস্ত অন্ধতা মোহের জাল ছিঁড়ে সঠিক আদর্শ ভিত্তিক লড়াইয়ে সামিল হবেন৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১২ সংখ্যা)