আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধিতে হাহাকার মানুষের, অপদার্থ সরকারের বুলিই সার

মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্র, বেকারি সহ জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যা সমাধানের দাবিতে ২৯ সেপ্টেম্বর ভূবনেশ্বরে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল।

আমেরিকায় বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ-এর সাম্প্রতিক সভায় ভারতীয় অর্থনীতির উজ্জ্বল ছবি তুলে ধরতে অনেক কথা বলে এলেন দেশের অর্থমন্ত্রী। চেন্নাইয়ের বাজারে তাঁর হাসিমুখে সবজি কেনার ছবি খবরের কাগজের পাতা আলো করল। ভাবটা এমন যেন, কোথায় মূল্যবৃদ্ধি? কোথাও কোনও সমস্যা নেই তো! এদিকে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ গোটা বাজার তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছেন, কোথায় একটু কম দামে চাল-ডাল-সবজি-মাছের সন্ধান মেলে! তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে থলির এক কোণে পড়ে থাকা সামান্য জিনিস হাতে ঘরের পথ ধরছেন। সেখানে অপেক্ষা করে থাকা সন্তান-পরিজনদের মুখে কী করে দু’বেলা খাবার তুলে দেবেন, সেই দুর্ভাবনায় মুখ তাঁদের শুকনো।

বাস্তবিকই মূল্যবৃদ্ধি সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি এবং ক্রমাগত তা বেড়েই চলেছে। গত দু’মাসে চাল, গম, ডালের দাম বিপুল বেড়েছে। সবজির দামও জুলাই মাসের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। জ্বালানি গ্যাসের দাম হাজার টাকা ছাড়িয়ে গৃহস্থের নাগালের প্রায় বাইরে। এক লিটার কেরোসিন তেল দোকান থেকে কিনতে গেলে ১২০ টাকা নগদ গুনে দিতে হচ্ছে।

সব মিলিয়ে এই ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন জেরবার করে দিচ্ছে। এমনিতেই লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন দেশের কয়েক কোটি মানুষ। বিরাট সংখ্যক মানুষ সামান্য মজুরিতে দিন গুজরান করছেন। বেকারত্বের হার গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, শিল্পোৎপাদনের হার শূন্যেরও নীচে নেমেছে। অর্থাৎ আরও বেশি করে বন্ধ হচ্ছে কল-কারখানা। কাজ চলে যাচ্ছে আরও বেশি শ্রমিকের। গরিবির অতল অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে আরও অসংখ্য পরিবার। বাড়ছে অনাহারী, অর্ধাহারী মানুষের সংখ্যা। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির স্পষ্ট প্রমাণ হিসাবে সামনে এসেছে বিশ্বক্ষুধা সূচকের রিপোর্ট, যেখানে দেখা যাচ্ছে গত বছরের চেয়ে আরও অনেকটা নেমে গিয়ে ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের জায়গা হয়েছে ১০৭ নম্বরে। এর মানে হল, অপুষ্টি, শিশুদের বৃদ্ধি ও উচ্চতায় ঘাটতি এবং শিশুমৃত্যুর হার ক্রমাগত বীভৎস চেহারা নিচ্ছে ভারতে।

কিন্তু দেশে তো একটা জবরদস্ত সরকার আছে, যার নেতৃত্বে আছেন ৫৬ ইঞ্চি ছাতিবিশিষ্ট এক ‘বিকাশপুরুষ’! তাহলে দেশের মানুষের এই হাল কেন? তাদের এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার জন্য কী ভূমিকা পালন করছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার? বাস্তবে দেশের ধনকুবের পুঁজিপতিদের মুনাফা আকাশছোঁয়া করে তোলার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করা ছাড়া দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব-নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র দায়িত্বও তারা পালন করেনি, করছেও না।

মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসাবে জ্বালানি তেলের চড়া দামকে দায়ী করা হচ্ছে। এটা ঠিকই, পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়লে পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে খাদ্যপণ্য সহ সমস্ত জিনিসের দাম বাড়ে। প্রশ্ন হল, পেট্রল-ডিজেলের দাম কমানোর জন্য সরকার কী চেষ্টা করেছে? মানুষকে ধোঁকা দিতে ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করছেন নেতা-মন্ত্রীরা। অথচ তথ্য দেখাচ্ছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে, বছরের শুরুতেই দেশে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের উপরে। এ কথা এখন আর গোপন করার উপায় নেই যে, পেট্রল-ডিজেলের চড়া দামের পিছনে রয়েছে চড়া হারের শুল্ক ও সেস, যা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার চাপিয়েছে যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই। নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে মানুষ যখন নাজেহাল, তখন নাম-কা-ওয়াস্তে একবার শুল্ক সামান্য কমিয়ে দায় সেরেছে কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারই। যুদ্ধ পরিস্থিতিকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী করছেন যে নেতা-মন্ত্রীরা, তাঁরা তো কই একবারও বলছেন না যে, যুদ্ধের এই সময়েই রাশিয়া থেকে জলের দরে তেল কিনে সেই তেল চড়া দামে দেশের মানুষকে কিনতে বাধ্য করে তেল-কোম্পানির কর্পোরেট মালিকদের মুনাফার ভাণ্ডার ভরিয়ে তুলেছেন তাঁরা! এভাবেই সাধারণ মানুষকে জীবনযন্ত্রণায় জেরবার করে নির্লজ্জের মতো মালিকদের পদলেহন করে চলেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।

দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র দায়িত্ববোধ থাকলে বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম তাদের নাগালের মধ্যে রাখা সরকারের পক্ষে অসম্ভব ছিল না। দেশে গত কয়েক বছর ধরে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য কেন্দ্রীয় ভাবে সঞ্চয় করে রাখা চাল-গমের চাপে এফসিআই-এর গুদামগুলি গত দু’বছরই উপচে পড়েছে। তা সত্তে্বও এ হেন আকাশছোঁয়া দাম কেন? এর পিছনে রয়েছে খাদ্যপণ্যের বাজারটির নিয়ন্ত্রণ লাগামহীন ভাবে বেসরকারি মালিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সরকারি নীতি। সরকারের পেটোয়া বৃহৎ পুঁজির মালিকরা খাদ্যশস্যের বাজারটির দখল নিয়ে নেওয়ার ফলে একদিকে ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে চাষিরা হাহাকার করছেন, ঋণের বোঝা থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। পাশাপাশি চাল-গম কিনতে পকেটের টাকায় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না শ্রমজীবী মানুষ। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক পরিমাণে খাদ্যশস্য সস্তায় কিনে গুদামে মজুত করে রাখছেন বৃহৎ পুঁজিপতিরা এবং কৃত্রিম ভাবে চাহিদা তৈরি করতে এমন পরিমাণে বাজারে তা জোগান দিচ্ছেন, যাতে দাম হয়ে পড়ছে আকাশছোঁয়া।

সরকার যদি সত্যিই চায়, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে কঠিন কাজ নয়। কিন্তু তা তারা করবে না। কারণ, পুঁজিপতিদের বদান্যতায় সরকারে বসে তার প্রধান কাজ হল মালিকদের মুনাফার স্বার্থ রক্ষা করা, তাতে জনসাধারণ যদি না খেয়ে মরে তো মরুক। এটাই হল কেন্দে্রর নরেন্দ্র মোদি সরকারের ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’-এর আসল চেহারা। এ প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারের ভূমিকাও কম লজ্জাজনক নয়। পরিসংখ্যান বলছে, গত দু’মাস ধরে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সরকারে বসেই তৃণমূল সরকার প্রবল ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তৈরি করেছিল একটি টাস্ক ফোর্স। বলা হয়েছিল, এই টাস্ক ফোর্স নিত্যপণ্যগুলির দামের ওঠানামায় কড়া নজর রাখবে। ভয়ঙ্কর এই মূল্যবৃদ্ধির সময়েও সেই টাস্ক ফোর্সের কোনও অস্তিত্ব নজরে পড়ছে না। পাশাপাশি, পেট্রল-ডিজেলের দাম কমানোর নামে মাত্র একবার সরকারি প্রাপ্য সামান্য কমিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মতো করেই দায় ঝেড়ে ফেলেছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার।

বড় পুঁজির মালিক যে সব আড়তদার জেলায় জেলায় বেআইনি শস্যভাণ্ডার তৈরি করে রেখেছে, ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের তাদের বিরুদ্ধে সামান্য মুখ খুলতেও দেখা যায় না। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারের মতো, রাজ্য সরকারেরও টিকি বাঁধা রয়েছে প্রবল ক্ষমতাধর এই সব পুঁজিপতিদের কাছে। জনগণের খেতে পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে তাই আজ কোনও সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী দেশের সম্ভাব্য আর্থিক বৃদ্ধির হার নিয়ে আকাশকুসুম ভাষণ দিচ্ছেন, আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হাসিমুখে মেলা-খেলায় মনোনিবেশ করছেন।

অন্যায় শোষণের উপর দাঁড়িয়ে থাকা যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে বহাল রয়েছে দেশের এইসব সরকার, সেই ব্যবস্থায় জনসাধারণের প্রতি তাদের এই নির্মম দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। বেকারি-গরিবির সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির দুঃসহ আগুনে পুড়তে থাকা খেটে-খাওয়া মানুষকে বুঝতে হবে, শুধু সরকার পাল্টে এই জীবনযন্ত্রণা দূর করা যাবে না। তার জন্য চাই এই শোষণমূলক ব্যবস্থাটিকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রবর্তন। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে চলতে চলতেই একের পর এক গড়ে তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত গণআন্দোলন, যার চাপে সরকারগুলি বাধ্য হবে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে।