অবাধ লুঠ চালাচ্ছে সরকার ও তেল কোম্পানিগুলি

 

কেন্দ্রীয় তেলমন্ত্রী থেকে বিজেপির তাবড় নেতা, সকলের মুখেই শুনবেন, দেশে তেলের দাম কমানো যাচ্ছে না, তার কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম চড়া। সত্যিই কি তাই?

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ের ১৩৯ ডলার থেকে নামতে নামতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম এখন ৭০ ডলার। অর্থাৎ অর্ধেক। অথচ ভারতীয় বাজারে সেই পুরনো দামই বহাল রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ধাপে ধাপে ক্রমাগত নামতে থাকলেও গত বছর মে মাস থেকে দেশের বাজারে দাম এতটুকুও কমানো হয়নি। তেল মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী গত বছরের মে মাসে ভারতের কেনা অশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ১০৯.৫ ডলার। গত ২০ মার্চ তা নেমেছে ৭০.৬৯ ডলারে। অর্থাৎ গত বছর প্রতি লিটারে তার দাম ছিল ৫৩.৪৫ টাকা। এখন হয়েছে ৩৬.৬৮ টাকা (সূত্রঃ আ.বা.পত্রিকা, ২৩ মার্চ ‘২৩)। অর্থাৎ শুধু অশোধিত তেলের দাম কমার কারণেই পেট্রল ও ডিজেলের দাম ১৬.৭৫ টাকা কমানো যায়। ফলে এ কথা স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে ভারতের বাজারে তেলের বর্তমান দামের কোনও সম্পর্ক নেই। বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা এ বিষয়ে যা বলছেন তা সম্পূর্ণ অসত্য।

তা হলে কীসের কারণে দেশের বাজারে তেলের দাম এতখানি চড়া? এর কারণ একদিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তেল কোম্পানিগুলির জন্য সীমাহীন লুঠের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, অন্য দিকে একই সঙ্গে প্রধানত কেন্দ্রীয় সরকার, সাথে রাজ্য সরকারগুলির ভাণ্ডারেও ঢুকছে তেলের উপর চাপানো কর ও সেস থেকে বিপুল পরিমাণ আয়।

বেসরকারি কোম্পানিগুলি এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি কী ধরনের লুঠ চালাচ্ছে?

সংসদে কেন্দ্রীয় তেল প্রতিমন্ত্রী রামেশ্বর তেলির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, তেলের শুল্ক থেকে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে কেন্দ্রের আয় হয়েছিল ৪.৯২ লক্ষ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ৪.৫৫ লক্ষ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০তে এই আয় ছিল যথাক্রমে ৩.৪৮ লক্ষ কোটি টাকা এবং ৩.৩৪ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ লকডাউনকে কেন্দ্র করে জনজীবন যখন বিপর্যস্ত, যখন মানুষ ভেবে পাচ্ছে না সংসার চালাবে কী করে, তখন ২০১৯-২০-র থেকে পরের বছর এক লাফে অতিরিক্ত ১ লক্ষ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের ঘাড় ভেঙে তুলেছে। পরের বছর তা আরও বেড়েছে।

অথচ সরকার এই সময়ে অনায়াসেই তেলের দাম কমিয়ে জনগণকে কিছুটা রেহাই দিতে পারত। লকডাউনের কারণে এক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম শূন্যে নেমে যায়। স্ট্র্যাটেজিক অয়েল রিজার্ভের নামে ভারত সরকার সেই সময় কয়েক কোটি ব্যারেল অশোধিত তেল বিভিন্ন রাজ্যের রিজার্ভারগুলিতে জমিয়ে রাখে, যা পরবর্তী সময় ধরে বিপুল কর সহ চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফা লোটে। দ্বিতীয়ত, সেই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তলানিতে নেমে গেলেও সরকার বিপুল কর চাপিয়ে দেশের মানুষকে তারও কোনও সুবিধা পেতে দেয়নি। কিন্তু তারপর তেলের দাম সামান্য বাড়লেই সরকার ক্রমাগত কর বাড়িয়ে গেছে। বিশ্ববাজারে দাম কমলে কিন্তু তারা দাম কমিয়ে মানুষকে রেহাই দেয়নি। অথচ বাজারে পেট্রল ডিজেলের চড়া দামই পরিবহণ খরচ বাড়াচ্ছে। যা সার্বিক ভাবে এবং বিশেষত খাদ্য সহ অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে।

বেসরকারি তেল কোম্পানিগুলি কিংবা সরকার দেশের বাজারে তেলের চড়া দামের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের দামের যে দোহাই দেয় তা দেশের জনগণের সঙ্গে এক বিরাট প্রতারণা। এখন দেশের জন্য প্রয়োজনীয় তেলের ৮০-৮৫ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বাকিটা দেশীয় খনি থেকে উত্তোলন করা হয়। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ বদলে যায়। আমেরিকা এবং ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি রুশ তেলে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে রাশিয়া অত্যন্ত কম দামে ভারতকে তেল দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। কত কম সেই দাম? রাশিয়া সেই সময়ে ৪০ ডলারে তেল দেওয়ার কথা ঘোষণা করে এবং জানায় তারা এমনকি এর থেকেও কম দামে ভারতকে তেল দিতে রাজি আছে। অর্থাৎ ভারত এখন ৪০ ডলারের থেকেও কম দামে তেল কিনছে রাশিয়া থেকে। এই অতি সস্তার তেল কী পরিমাণে ভারত আমদানি করছে, জানলে চোখ কপালে উঠবে।

গত অর্থবর্ষের শুরুতেও ভারতের তেলের চাহিদার মাত্র ০.২ শতাংশ মেটাত রাশিয়া। সেখানে সৌদি আরব, ইরাককে পিছনে ফেলে গত অক্টোবরেই ভারতে অশোধিত তেল রফতানিকারী দেশগুলির তালিকায় প্রথম স্থানে পৌঁছে গেছে রাশিয়া। আমদানি করা তেলের ৩৫ শতাংশ এখন আসছে রাশিয়া থেকে। এরপরও দেশে তেলের চড়া দামের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের দামকে দায়ী করা যায় কি? তা হলে এক দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অর্ধেক হয়ে যাওয়া, অন্য দিকে রাশিয়া থেকে কার্যত জলের দামে তেল আমদানি, দু’দিক থেকে কম দামের এই যে বিরাট সুবিধা, এর কিছুই জনগণকে পেতে দেওয়া হল না। কারা পেল এই বিরাট সুবিধাটা? পেল সরকার এবং বেসরকারি কোম্পানিগুলি। কী ভাবে পেল?

বেসরকারি কোম্পানিগুলি এবং কেন্দ্রীয় সরকার রাশিয়া থেকে জলের দামে যে তেল কিনছে তাকে পরিস্রুত করে ইউরোপ সহ বিশ্বের নানা দেশে আন্তর্জাতিক বাজারের দামে বিক্রি করছে এবং অস্বাভাবিক হারে মুনাফা করছে। এবং শুধু রাশিয়া থেকে আমদানি করা তেলই নয়, দেশে উৎপাদিত তেলও কোম্পানিগুলি দেশের বাজারে বিক্রি না করে চড়া দামে বিশ্বের বাজারে বিক্রি করছে। এই মুনাফা এতই অস্বাভাবিক যে সমালোচনার চাপে সরকার মাঝে কিছুদিনের জন্য ভারতে উৎপাদন ও রফতানির উপর এই পড়ে পাওয়া মুনাফায় ‘উইন্ডফল ট্যাক্স নামে নামমাত্র একটা কর চাপায়। কিন্তু তা-ও কমাতে কমাতে এখন প্রায় তুলেই নেওয়া হয়েছে।

তেলের দাম কমানোর প্রশ্নে তেলমন্ত্রী বলেছেন, তেল সংস্থাগুলির পুরনো লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দাম কমবে। লোকসান? তেল কোম্পানিগুলির? কী ভাবে হল? তেলমন্ত্রী তথ্য দিয়ে বলুন কোন বছরে, কোন সময়ে কার কত টাকা লোকসান হয়েছে। তেলমন্ত্রীর বক্তব্য, আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া দাম সত্ত্বেও নাকি কোম্পানিগুলি দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়ায়নি। তাই তাদের ক্ষতি হয়েছে? একই সঙ্গে তেলমন্ত্রী যোগ করেছেন, আমরা ওদের (তেল সংস্থাগুলিকে) দাম স্থির রাখতে বলিনি। ওরা নিজেরাই করেছে। এ তো রীতিমতো বিড়ালের মাছ না খাওয়ার শপথ! দেখা যাক, নিজেদের লোকসান করে তেল কোম্পানিগুলি কেমন জনসেবা করেছে?

রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সর্বোচ্চ মুনাফা গড়েছে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত লাভের পরিমাণ ১,৭৪৬.৯০ কোটি টাকা। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন লিমিটেড ২০২১-২২ অর্থবর্ষে মোট লাভ করেছে ২৪,১৮৪.১০ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ২১, ৮৩৬.০৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে রিলায়েন্স লাভ করেছে ৬০,৭০৫ কোটি টাকা। প্রায় একই হারে লাভ করেছে অন্য তেল কোম্পানিগুলিও। অথচ বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা কোম্পানিগুলির ক্ষতির গল্প শুনিয়ে বোকা বানাতে চাইছেন দেশের মানুষকে।

ফলে এ কথা স্পষ্ট যে, পুরোপুরি সরকারি মদতেই কোম্পানিগুলি এই অবাধ লুঠ চালিয়ে যেতে পারছে এবং দেশের মানুষকে বাধ্য করছে চড়া দামে তেল কিনতে যার অবধারিত ফল চড়া মূল্যবৃদ্ধি। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার বেসরকারি কোম্পানিগুলিকে এই বিপুল মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছে এবং তার পরিবর্তে ক্ষমতার গদিতে টিকে থাকার গ্যারান্টি আদায় করছে।

এর থেকে কেউ যদি মনে করেন, এই সরকারটাকে বদলে দিলেই এই লুঠ বন্ধ হয়ে যাবে, তবে তা ভুল ভাবনা। কারণ কংগ্রেসও অতীতে এই কাজই করেছে, সিপিএম সহ অন্য দলগুলিকে নিয়ে এক সময় যে যুক্তফ্রন্ট সরকার ছিল তারাও এই কাজ করেছে। রাজ্যে রাজ্যে সিপিএম সহ যে আঞ্চলিক দলগুলি সরকার চালাচ্ছে, তারাও সবাই যে যা পারছে করের পাশাপাশি সেস, ভ্যাট চাপিয়ে নিজেদের ভাঁড়ার ভর্তি করছে। তাই তেলের চড়া দাম সার্বিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস নিয়ে এলেও ভোটসর্বস্ব এই দলগুলির কারওরই তা নিয়ে এতটুকু মাথাব্যথা নেই। কারণ এই দলগুলি এবং তাদের পরিচালিত সরকারগুলি সবাই পুঁজিবাদের সেবক। পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ দেখাই তাদের চরিত্রবৈশিষ্ট্য। এবং তা তারা দেখছে জনস্বার্থকে বলি দিয়ে। কিন্তু এই সব দল এবং সরকারগুলির এই জনবিরোধী চরিত্রকে সাধারণ মানুষ বেশিরভাগ সময় খেয়ালই করেন না। করলেও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন না। জনগণের এই নিষ্পৃহতাই শাসকদের সুযোগ করে দিচ্ছে জনগণের সঙ্গে এই সীমাহীন প্রতারণার। আজ দরকার একদিকে তেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তুলে সরকারগুলিকে বাধ্য করা কিছুটা হলেও দাম কমাতে, অন্য দিকে শোষিত শ্রেণির ঐক্য গড়ে তুলে পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামকে তুঙ্গে তোলা যাতে তার পরিণতিতে পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী এই ব্যবস্থাকেই চিরতরে উচ্ছেদ করা যায়।