অপুষ্টি, অনাহার, আদিবাসী মৃত্যু সরকারি নিষ্ঠুরতার ট্র্যাডিশন চলছেই

ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড়ের একটি গ্রামে শবর সম্প্রদায়ের সাত জন মানুষের অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সরকার, শাসকদল, তথাকথিত বিরোধী দলগুলি আর জেলা ও স্থানীয় প্রশাসন নড়ে চড়ে বসার ভাব করছে৷ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং শাসক দলের একজন বড় নেতা অনাহারে মৃত্যুর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে জানিয়েছেন মৃত্যুর কারণ মদ খাওয়া আর ওষুধ না খাওয়া৷

এদিকে কংগ্রেস–বিজেপি–সিপিএম সকলেই ছুটছেন লালগড়৷ তাঁদের বিবৃতি ফলাও করে ছাপা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে৷ এতগুলি অসহায় মানুষের মৃত্যু নাকি মেনে নেওয়া যায় না৷ তাই এ সরকারকেও চলতে দেওয়া যায় না৷ যেন দারিদ্রে, অনাহারে, বিনা চিকিৎসায়, মাদকাসক্তির বিষাক্ত প্রভাবে সর্বনাশের অতলে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা তাঁরা প্রথম দেখছেন বা শুনছেন৷ যেন এই অভূতপূর্ব ঘটনা বিজেপির ‘আচ্ছে দিন’–এর রামরাজত্বে, কংগ্রেসের স্বাধীনতা–উত্তর দীর্ঘ শাসনে কিংবা ৩৪ বছরের সিপিএম জামানায় এর আগে আর ঘটেনি, বর্তমানে ঘটছে না৷

অনাহারে মৃত্যু আমলাশোলের মর্মান্তিক

স্মৃতিকে সামনে আনছে

এস ইউ সি আই (সি)–র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ১৪ নভেম্বর এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সংবাদপত্রে যখন জঙ্গলমহলে অল্পদিনের মধ্যে বহু মানুষের অনাহার–মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, তখন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘কোথাও কোনও খাদ্যের অভাব নেই’৷ মন্ত্রীর এই ধরনের বিবৃতি প্রদান গভীর উদ্বেগজনক৷ এই অনাহার–মৃত্যু বিগত বামফ্রন্ট সরকারের আমলাশোলের মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতিকে সামনে আনছে৷ বাস্তবে এ কথা সত্য, অন্যান্য রাজ্যের মতো এই রাজ্যের নানা প্রান্তে অনাহারে মৃত্যু প্রায় নিত্য  নৈমিত্তিক ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে৷

আমরা অবিলম্বে জঙ্গলমহল সহ রাজ্যের সর্বত্র সকল মানুষের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্য ও চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি’৷

 

বিরোধীদের এই তৎপরতা দেখে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যা বোঝার ঠিকই বুঝছেন৷ কারণ তিনিও জানেন নির্বাচন আসন্ন৷ তিনি তাঁর রাজ্যের সুশাসনে নিজেই মুগ্ধ৷ রাজ্যের জঙ্গল–পাহাড়–গ্রাম সবই তাঁর সেই সুশাসনের জন্য হাসছে৷ অথচ ‘সেই শুধু হাসি খেলা প্রমোদের মেলার’ মধ্যিখানে এরকম বেসুর তালকাটা তিনি তার মন্ত্রী, সান্ত্রি, নেতা, আমলা সকলকে জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখতে আর নির্বাচনের আগের এই গোলমেলে মুহূর্তে সতর্ক থাকতে বলেছেন৷ আর বলেছেন তিনি আর কত করবেন? বলেছেন, আমি তো আর হাতে করে খাইয়ে আসতে পারবো না৷ অর্থাৎ এই হাসিখুশি সুখের রাজত্বে সমস্ত সুষ্ঠু–পরিপাটি ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও শুধু নিজে হাতে করে ভাত খাওয়ার, ওষুধ খাওয়ার শুভ ইচ্ছার অভাবটুকুর জন্যই যেন শবর সম্প্রদায়ের মানুষগুলির মৃত্যু৷ যেন মানুষগুলি এতই অপদার্থ যে একটু কষ্ট করে খাওয়া কিংবা চিকিৎসা নেওয়ার থেকে মদ খাওয়া এবং ওষুধ পথ্যকে নাকচ করে মরে যাওয়ার দিকেই তাদের আগ্রহ!

এই ঘটনার সুবাদে মুখ্যমন্ত্রীর জেলা এবং স্থানীয় প্রশাসন গ্রামে গ্রামে কী কী ব্যবস্থা ‘অতি–সুষ্ঠুভাবে’ চলছে তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন বারে বারে৷ একশো দিনের কাজ, মিড ডে মিল, দু’টাকা কেজি চাল, খাদ্য সাথী, বিনা পয়সায় সুপার স্পেশালিটি চিকিৎসা পরিষেবা কী নেই তার পরেও যেহেতু সতর্ক থাকা দরকার, তাই দিন দুয়েকের মধ্যেই জেলাশাসক ঝাড়গ্রাম জেলার মধ্যেই নাকি আটটি কমিটি গড়ে ফেলেছেন৷ এই অতি নাটকীয় ডামাডোলের মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে সাতজন মানুষের মৃত্যুর নেপথ্যে থাকা বাস্তব সত্য৷ অনাহার, অপুষ্টি, বিনা চিকিৎসা, অশিক্ষা, সর্বোপরি অবহেলা আর মনুষ্যত্বের অপমানে ভরা শবর পল্লির নিবিড় অন্ধকার৷

একশো দিনের কাজের প্রকল্পের ঢাক–ঢোল যাই পেটানো হোক এই প্রকল্পে কাজ মেলে ১২–১৪ দিন বা তার আশেপাশে৷ রাজ্য সরকারই সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা এ বছর নাকি ৫২ দিন কাজ দিয়েছে এবং এটা রেকর্ড৷ বাস্তবে শবর পল্লিই শুধু নয়, অসংখ্য হতদরিদ্র গ্রামে একশো দিনের কাজে কোনও কাজই পাওয়া যায়নি এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর৷ তার ওপর যারা কাজ পায়, মজুরি পেতে তাদের অপেক্ষা আর হয়রানির একশেষ৷ এ সমস্ত কিছু বাদ দিয়েও যদি ৫২ দিন কাজ পাওয়াই ধরা যায় তবে মানুষগুলির বছরের বাকি ৩১৩ দিন চলবে কীভাবে?

২ টাকা কেজি চাল? চালের নিম্ন মানের কথা ছেড়ে দিলেও প্রতি সপ্তাহে একজন প্রাপ্তবয়স্ক্ মানুষের মেলে ৩০০ গ্রামেরও কম চাল৷ অপ্রাপ্তবয়স্কদের এর অর্ধেক৷ যারা শাক–সব্জি, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম–এর সাথে ভাত খান তাদেরও একদিনের অন্তত তিন বেলায় এর দ্বিগুণ কার্বোহাইড্রেট লাগে৷ অথচ এখানকার মানুষগুলির, জোটাতে পারলে শাক–পাতা, গেঁড়ি–গুগলি না হলে শুধু মাত্র নুন দিয়েই খেতে হয় ভাতের সাথে জল মিশিয়ে৷

আর মিড ডে মিল? প্রাইমারির ৪ টাকা ১৩ পয়সা আর আপার প্রাইমারির ৬ টাকা ১৮ পয়সার ওপর অনেক সাধ্য সাধনার পরে কেন্দ্রীয় সরকার ২২ পয়সা ভিক্ষা বরাদ্দ করেছেন৷ এই পরিস্থিতিতে হাসি খুশি থাকতে হলে স্বাভাবিক প্রকৃতিস্থ থেকে তো তা সম্ভব নয়৷ তাই বোধহয় সরকার বাহাদুর গ্রামে গ্রামে একেবারে আইনসিদ্ধ মদের দোকান খুলছেন লিভার সিরোসিস মহামারির আকার ধারণ করছে৷ সুপার স্পেশালিটির আউটডোর যে সর্দি–কাশি, পেটখারাপের বড়ি দিয়েছে তার প্রতি মায়া না বাড়িয়ে বোধ করি হাসতে হাসতেই মরে যাচ্ছেন শবর সম্প্রদায়ের মানুষগুলি৷

এর প্রমাণ খুঁজতে বেশি দূর যেতে হবে না৷ জেলা শহর ঝাড়গ্রামের ৩–৪ কিলোমিটারের মধ্যে প্রণব পল্লি– প্রশাসনের নাকের ডগায়৷ ৫০টি পরিবারের জীবনের রোজনামচা, তাদের দারিদ্র, অপুষ্টি, বিনা চিকিৎসা, রোগ–ভোগ মৃত্যু সব নমুনাই এখানে পাওয়া যাবে৷ তার সাথে গত ১৪ মাস গ্রামটি বিদ্যুৎ বিহীন৷ কেন না ভুতুড়ে বিলের ৫০ হাজার, ষাট হাজার টাকা দরিদ্র মানুষগুলি দিতে পারেনি৷ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সংগঠন অ্যাবেকা আর এস ইউ সি আই (সি) দলের পক্ষে থেকে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা হয়েছে বারবার৷ অনাহার, অশিক্ষা, অপমৃত্যু সহ চরম দুর্দশা মোচনের জন্য পদক্ষেপের দাবি নিয়ে৷ কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনও পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি৷ অনাহারে মৃত্যুর এই হইচই থিতিয়ে গেলে সরকার আবার শবর পল্লির কথা ভুলে যাবে৷ তাছাড়া, এই অন্ধকারটা শুধু শবর পল্লির, রাজ্যের বাকিটা আলো–ঝলমলে– এটাও সত্য নয়৷ তাই দরকার জাতি–গোষ্ঠী–ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন৷ দরিদ্রপল্লির এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই পথ৷ ভোটবাজদের মেকি সহানুভূতির চক্করে ভুললে আবার ঠকতে হবে৷

অনাহারে মৃত্যু নিয়ে নির্মম রসিকতা

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার ছিয়াত্তর আর পঞ্চাশের মন্বন্তরকে অনাহারে মৃত্যু বলে মানতে চায়নি৷ বলেছিল ম্যালেরিয়া বা অন্য রোগে মরেছে৷ তার প্রতিবাদ করে বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, অপুষ্টিতে ভোগার ফলেই প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে মানুষ দলে দলে মারা যায়৷ তাই মৃত্যুর প্রধান কারণ পুষ্টির অভাব অর্থাৎ খাদ্যের অভাব৷ সেটাই তিনি স্মরণ করিয়েছিলেন ব্রিটিশকে৷

কংগ্রেস আমলে ১৯৫৯ সালে অনাহারে মৃত্যু নিয়ে খাদ্য মন্ত্রী প্রফুল্ল সেন বিধানসভায় বিবৃতি দিয়েছিলেন, ‘অনাহারে নয়, ওরা সব হার্ট ফেল করে মারা গেছে’৷ ১৯৬৬–তে যখন দুর্ভিক্ষে মানুষ মরছে কংগ্রেসের খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজ্যে কত চাল উদ্বৃত্ত তার গল্প শুনিয়েছিলেন৷ চালের বদলে কাঁচকলা খাওয়ার নিদান কংগ্রেসের খাদ্যমন্ত্রীই দিয়েছিলেন৷

সিপিএম আমলে ২০০৪ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা প্রসঙ্গে সিপিএম নেতা–মন্ত্রীরা একসুরে বলেছিলেন অভাব নয়, রোগ আর স্বভাবেই মৃত্যু৷ এতদূর নেমেছিল তারা যে, দলীয় মুখপত্র গণশক্তি লিখেছিল, মৃত সনাতন মুড়ার বাড়িতে ৭ মন চাল মজুত, তাদের পরিবার নাকি শ্রাদ্ধে ৬০০ লোককে মাংস ভাত খাইয়েছে (গণশক্তি, ১৩–০৬–০৪)৷ যদিও অচিরেই তাদের এই কদর্য প্রচারের পর্দা ফাঁস হয়ে সত্যটা বেরিয়ে এসেছিল৷ ওড়িশার কালাহান্ডিতে অনাহারে মৃত্যুকে অস্বীকার করতে গিয়ে কংগ্রেস সরকার বলেছিল ওরা অনাহারে ছিল না, কারণ পাকস্থলীতে আমের কষি পাওয়া গেছে৷ বিজেপির রাজ্যত্বে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এমনকী গুজরাটে পর্যন্ত একাধিক বার অনাহারে মৃত্যুর খবরকে সরকার একইভাবে চাপা দিয়েছে৷

 

(৭১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা ২৩ – ২৯ নভেম্বর, ২০১৮)