অন্যায় যারা করে তারাই প্রতিবাদকে ভয় পায়

 

দিল্লির শাহিনবাগে এনআরসি বিরোধী গণ অবস্থানে বক্তব্য রাখছেন এস ইউ সি আই (সি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড প্রতাপ সামল

ভয় পাচ্ছে শাসক বিজেপি৷ প্রতিবাদের নাম শুনলেই এখন তাদের ভয়৷ সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন দূরের কথা, সামান্য একটা মিছিল, ধরনা কিংবা এমনকি কোথাও কেউ জড়ো হয়ে সংবিধানের দুটো লাইন পড়লেও বিজেপি নেতারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন– এই বোধহয় গদি তাঁদের টলমল করে উঠল৷

২০ জানুয়ারি এনআরসির বিরুদ্ধে মানব-বন্ধন চাঁদনি চক, কলকাতা

রাজধানী দিল্লির কথাই ধরা যাক৷ জামা মসজিদের সামনে সিএএ–এনআরসি বিরোধী এক জমায়েত থেকে এক আন্দোলনকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে ঢোকায়৷ প্রায় পঁচিশ দিন জেলে থাকার পর জামিনের জন্য কোর্টে আবেদন জানালে বিচারপতি পুলিশের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ জানতে চান৷ পুলিশ উত্তর দেয়, তিনি সোসাল মিডিয়ায় জামা মসজিদের ধরনায় যোগদানের জন্য মানুষকে আহ্বান করেছিলেন৷ বিচারক বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করেন, ‘‘এর মধ্যে কী দোষ রয়েছে? এর মধ্যে হিংসা কোথায়?’’ তিনি বলেন, ‘‘ধরনা দিলে কী সমস্যা? প্রতিবাদ হলেই বা কী সমস্যা?’’ পুলিশ সাফাই গাইতে অজুহাত তোলে, প্রতিবাদকারীরা প্রতিবাদের অনুমতি নেয়নি৷ বিচারপতি প্রশ্ন করেন, ‘‘কীসের অনুমতি? প্রতিবাদ করাটা তো সাংবিধানিক অধিকার৷’’

২০ জানুয়ারি এনআরসির বিরুদ্ধে মানব-বন্ধন কার্জন গেট, বর্ধমান

প্রতিবাদের অধিকার যে প্রতিটি মানুষের অন্যতম গণতান্ত্রিক অধিকার, এ কথা কি বিজেপি নেতা–মন্ত্রী কিংবা তার পুলিশ–প্রশাসন জানে না? খুব ভাল করেই জানে৷ কিন্তু প্রবল গণবিক্ষোভে গদি টলে যাওয়ার আতঙ্ক যখন কোনও স্বৈরাচারী শাসককে তাড়া করে তখন লাঠি–গুলিই হয় তেমন শাসকের একমাত্র হাতিয়ার৷ শাসক বিজেপিরও আজ দেশের মানুষকে লাঠি–গুলি, দমন–পীড়ন ছাড়া দেওয়ার আর কিছু নেই৷ তাই জেএনইউ–এর ছাত্র–ছাত্রীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বিজেপি সরকারের পুলিশ নির্বিচারে লাঠি চালায়৷ জামিয়া মিলিয়াতে ছাত্রদের হোস্টেলের মধ্যে, লাইব্রেরিতে ঢুকে মেরে তাদের হাত–পা ভাঙে, মাথা ফাটায়, চোখ নষ্ট করে দেয়৷ উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকারের পুলিশ নিজেরা ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়ে জনসাধারণের উপর সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিপূরণের দায় চাপায়৷ অথচ শাসক দল আশ্রিত সশস্ত্র দুষ্ক্তীরা যখন সমস্ত রকম নজরদারিকে থোড়াই কেয়ার করে জেএনইউতে ঢুকে ছাত্র–শিক্ষকদের উপর নির্মম আক্রমণ চালায় তখন পুলিশ কাঠের পুতুলের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে দেখে৷ মোদি সরকারের স্বৈরাচারী নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করা আইএএস গোপীনাথন কান্নান এনআরসি–সিএএ–র বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক সভায় যোগ দিতে গেলে পুলিশ তাঁকে বিমানবন্দরেই আটকে দেয়৷ লখনৌতে প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যে ধরনায় বসা মানুষের থেকে কম্বল এবং খাবারের প্যাকেটগুলিও জোর করে কেড়ে নিয়ে যায় যোগী সরকারের পুলিশ৷

২০ জানুয়ারি এনআরসির বিরুদ্ধে মানব-বন্ধন পার্ক সার্কাস, কলকাতা

দিল্লি জুড়ে বিজেপি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে যাতে এনআরসি–সিএএর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য কেউ জমায়েত হতে না পারে৷ এতেও ভয় ঘোচেনি৷ জারি করেছে নতুন কালা আইন এনএসএ৷ এই আইনে পুলিশ কোনও কারণ না দেখিয়েই যে কোনও ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে এবং এক বছর বিনা বিচারে আটকে রাখতে পারে৷

২০ জানুয়ারি এনআরসির বিরুদ্ধে মানব-বন্ধন আলিপুরদুয়ারে

বাস্তবে, যত অন্যায়ই হোক, মোদি সরকার তার নীতির বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে তাদের মত প্রকাশ করতে দিতে রাজি নয়৷ কিন্তু এ তো মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সে অধিকারটাই কেড়ে নিচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সরকার৷ কিন্তু মানুষের স্বাধীন মতামতকে কেন এত ভয় বিজেপি নেতাদের? কেন ভয় গণতান্ত্রিক অধিকারকে? আসলে তাঁরা জানেন, তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন অন্যায়ের উপর৷ ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের যে নীতি তাঁরা পার্লামেন্টে শুধুমাত্র সংখ্যার জোরে পাশ করিয়ে নিয়েছেন তা অন্যায়, গণতন্ত্র বিরোধী৷ তার পিছনে আসল মতলব একটি বিশেষ ধর্মের মানুষকে আলাদাভাবে চিহ্ণিত করে বিচ্ছিন্ন করা এবং এই পথে হেঁটে শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগুরু অংশের ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করা৷ দেশজুড়ে শুভবুদ্ধির মানুষমাত্রেই এই স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট নীতির প্রতিবাদ করছেন৷ প্রতিবাদ–আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ থেকে ছাত্র–শিক্ষক–চিকিৎ সব স্তরের মানুষের মধ্যেই৷

২০ জানুয়ারি এনআরসির বিরুদ্ধে মানব-বন্ধন দক্ষিন ২৪ পরগণার দেউলবাড়ি

ধর্ম–বর্ণ–লিঙ্গ–বয়স অবস্থান নির্বিশেষে এই প্রতিবাদকেই ভয় পাচ্ছে বিজেপি৷ তারা এক ভারতের নামে কাশ্মীরি মানুষের সাথে ঐতিহাসিক চুক্তিকে গায়ের জোরে লোপ করেছে৷ প্রতিবাদকে স্তব্ধ করতে ১৪৪ ধারা জারি করেছে, ইন্টারনেট সংযোগ বাতিল করেছে৷ অযোধ্যায় কোনও নীতি, যুক্তি কিংবা ঐতিহাসিক প্রমাণের তোয়াক্কা না করে শুধু বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে রামমন্দির নির্মাণকে আইনসিদ্ধ করেছে৷ দেশের বেশির ভাগ মানুষ নীরব থেকেছে৷ এই নীরবতাকে সমর্থন ভেবেছে বিজেপি৷ ভেবেছে মানুষ মেনে নিয়েছে, সংখ্যালঘুরা ভয় পেয়েছে৷ মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখার অন্যায়–জোরের উপর ভর করে আরও এক কদম এগিয়ে যখন বিজেপি নেতারা সীমাহীন ঔদ্ধত্যে ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের মূল সূরকে, সম্প্রীতির দীর্ঘ ঐতিহ্যকে দু’পায়ে মাড়িয়ে হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনের কর্মসূচি অনুযায়ী দেশজোড়া মানুষকে ধর্মের নামে ভাগ করতে উদ্যত হল তখন আর মানুষ চুপ করে থাকতে পারল না৷ ফুঁসে উঠল আসমুদ্রহিমাচল৷ এমন সব স্তর থেকে প্রতিবাদ উঠে এল যাঁরা ইতিপূর্বে কোনও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদে নামেননি৷ ইতিমধ্যেই দেশ জুড়ে যে প্রবল অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে শাসক বিজেপি এবং সংঘ পরিবার, তাতে প্রতিবাদে মুখর হওয়া সহজ কাজ নয়৷ পুলিশ–প্রশাসন, শাসক দলের ভাড়াটে বাহিনীর শারীরিক–মানসিক লাঞ্ছনা–নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে তাঁদের৷ তা সত্ত্বেও মানুষ সর্বত্র দলে দলে পথে নামছেন প্রতিবাদে৷

৯ জানুয়ারি এনআরসির বিরুদ্ধে জাকারিয়া স্ট্রীটে অবস্থান, কলকাতা

সরকার হিসাবে বিজেপির ব্যর্থতা আজ সর্বব্যাপক৷ জনগণকে দেওয়া কোনও প্রতিশ্রুতি বিজেপি রক্ষা করতে পারেনি৷ মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া, বেকারি অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে৷ লক্ষ লক্ষ শ্রমিক–কর্মচারী ছাঁটাই হয়ে চলেছে৷ কৃষকের আত্মহত্যা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে৷ পুঁজিপতিরা জনগণের সম্পত্তি অবাধে লুঠ করে চলেছে৷ দুর্নীতি আজ বিজেপির নীতির সমার্থক হয়ে গিয়েছে৷ বিজেপির আর্থিক নীতিতে জনজীবনে চরম সংকট নেমে এসেছে৷ এই নীতি শুধুমাত্র পুঁজিপতিদের স্বার্থই রক্ষা করছে৷ এই অবস্থায় শোষিত–বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ যাতে সংগঠিত বিক্ষোভের আকার না নেয়, তার জন্য মানুষকে ‘বিভক্ত করে শাসন করা’র শাসক শ্রেণির অতি পুরাতন কায়দাকেই বিজেপি আঁকড়ে ধরেছে৷ একদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার, অন্য দিকে পুঁজিপতি শ্রেণিকে গণবিক্ষোভ থেকে রক্ষা করার শেষ আশ্রয় হিসাবে এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতির আশ্রয় নিয়েছে৷ তার জন্যই ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্বের নীতি নিয়ে এসেছে তারা৷ নিয়ে এসেছে এনআরসির মতো নীতি যাতে আতঙ্কিত মানুষ জীবনের সমস্যাগুলির কথা ভুলে গিয়ে নিজেকে দেশের নাগরিক প্রমাণ করার জন্যই ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷

কিন্তু শাসকরা যা ভাবে তাই যদি ঘটত তবে সভ্যতার ইতিহাস আজ অন্য রকম হত৷ ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, সাময়িক ভাবে শাসকরা হয়ত কখনও কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদকে দমিয়ে দিতে পারে, কিন্তু তা বেশি দিনের জন্য নয়৷ তাই যতই বিজেপি সরকার জনগণের উপর দমন–পীড়ন নামিয়ে আনছে, নানা অজুহাতে জেলে ভরছে, সোসাল মিডিয়ায় তাদের সংগঠিত বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে মর্যাদাহানি করছে, হুমকি দিচ্ছে, সে সব কিছুকে উপেক্ষা করে মানুষ ততই বেশি বেশি করে পথে নামছে৷ এমনই হয়৷ মানুষের স্বাধীনচিত্ততাকে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর স্বাভাবিকতাকে কখনও চোখ রাঙিয়ে, অত্যাচার করে দমিয়ে রাখা যায় না৷ কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্যেই রয়েছে মনুষ্যত্বের যথার্থ প্রকাশ৷ পরাধীন ভারতে যখন বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা ক্ষমতায় ছিল সেদিনও তাদের শোষণ–নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে৷ অত্যাচার যত তীব্র হয়েছে ততই দেশজোড়া মানুষ জেগে উঠেছে৷ স্বাধীন ভারতেও শাসকদের জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বারে বারে আন্দোলনে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে মানুষ৷ শেষ পর্যন্ত ন্যায়ের পক্ষে মানুষের সঙঘবদ্ধতার কাছে শাসকদের হার মানতে হয়েছে৷

এবারের প্রতিবাদের একটি বিশিষ্টতা আছে, যা শাসক বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক নীতির গালে থাপ্পড় কষিয়েছে৷ হিন্দু–মুসলমানে বিভেদের প্রাচীর গড়ে দেওয়ার জন্য যে নীতি সরকার নিয়ে এসেছিল, সেই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনেই হিন্দু–মুসলমানের সংগ্রামী ঐক্য গড়ে উঠছে৷ দিল্লির শাহিনবাগে, লখনৌয়ে, কলকাতার পার্ক সার্কাসে, জাকারিয়া স্ট্রিটে, বেলগাছিয়ায়, আসনসোলে, এমন অজস্র জায়গায় যে গণবস্থান দিনের পর দিন চলছে, তাতে হিন্দু–মুসলমান দিনরাত পাশাপাশি বসে প্রতিবাদ ঘোষণা করছে৷ দীর্ঘদিন পাশাপাশি বাস করেও পরস্পরের মধ্যে অপরিচয়ের যে প্রাচীর স্থায়ী হয়েছিল, শাসকের আক্রমণের সামনে প্রতিরোধের নতুন প্রাচীর গড়তে গিয়ে সেই পুরনো প্রাচীর ভেঙে ভেঙে পড়ছে৷ জন্ম হচ্ছে নতুন মানুষের৷ যে মহিলারা বোরখার নিচে অসূর্যম্পশ্যা হয়ে জীবনের অনেকটা অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন, তাঁরাও আজ আন্দোলনের প্রকাশ্য ময়দানে এসে দাঁড়িয়েছেন, মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রতিবাদকে ধ্বনিত করছেন৷ একই মঞ্চে হিন্দু পুরোহিতের পাশাপাশি মুসলমান মৌলবি ঘোষণা করছেন, এই লড়াই শুধু মুসলমানের নয়, শুধু হিন্দুর নয়, এ লড়াই ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের৷ তাই ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের অংশগ্রহণে এই প্রতিবাদগুলি গণআন্দোলনের রূপ নিচ্ছে৷ ছড়িয়ে পড়ছে সমাজ জুড়ে৷ আজ দরকার এগুলিকে সংগঠিত রূপ দেওয়া, বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত আন্দোলনগুলিকে সঠিক নীতি এবং নেতৃত্বে একত্রিত করে দেশজোড়া ব্যাপক গণআন্দোলনের রূপ দেওয়া৷