অনাহারে চটশিল্পের লক্ষাধিক শ্রমিক পরিবার, সরকার উদাসীন

ফাইল চিত্র

পশ্চিমবঙ্গের শতাব্দী প্রাচীন শ্রমনিবিড় চটশিল্পের ১৬টি মিল আজ ‘সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক’-এর ফলে বন্ধ হয়ে রয়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক। করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন লকডাউনের মতো বিধিনিষেধে জনজীবন স্তব্ধ, সাধারণ মানুষ গৃহবন্দি, তখন একের পর এক জুটমিল বন্ধ হচ্ছে। মিল মালিকরা কাঁচা পাটের অভাবের অজুহাত দেখিয়ে মিল বন্ধ করে দিচ্ছে। এর জন্য সরকার অথবা শ্রমিক সংগঠনগুলির সাথে কোনও আলোচনাও করছে না। চাল, গম, ডাল ইত্যাদি খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য চটের বস্তা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসাবে গণ্য হয়। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ৩০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে জুটমিল লকডাউনেও চালু থাকার কথা। পরবর্তী সময় শ্রমিক সংখ্যা বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করেছে সরকার। এ ক্ষেত্রে ৩০ বা ৪০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে চলার ক্ষেত্রে তথাকথিত কাঁচা পাটের অভাবের অজুহাত টেকে না। কারণ এর জন্য মিল চালু রাখতে পূর্ণ ক্ষমতার ৩০ বা ৪০ শতাংশ কাঁচা পাট সরবরাহই যথেষ্ট।

একথা ঠিক ভারতে কাঁচা পাটের উৎপাদন গত বছর অবশ্যই কম হয়েছে। এর জন্য দায়ী কিন্তু সরকারি নীতি। চট শিল্পের সাথে যুক্ত দেশের ৪০ লক্ষ পাটচাষি পরিবার সরকারি সংস্থা অথবা বেসরকারি ফড়েদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্য পায় না বলেই তারা পাট চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বস্ত্রমন্ত্রকের অধিন জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার দায়িত্বে রয়েছে কাঁচা পাটের উৎপাদন প্রয়োজন মতো বাড়ানো, নিয়ন্ত্রণ এবং বন্টন করা। কিন্তু বিশ্বায়নের নীতির অনুসারী সরকার বেসরকারি ব্যবসায়ী এবং ফাটকাবাজদের হাতেই কাঁচা পাটের মজুত এবং নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছে। তাই অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হলেও কাঁচা পাট আজ খোলা বাজারে কালোবাজারি এবং মজুতদারির কবলে। আজ মালিকরা কাঁচা পাট নেই বলে শোরগোল তুলছে, এটাকেই মিল বন্ধের অজুহাত করছে। অথচ বেশি টাকা দিয়ে খোলাবাজারে পাট পাওয়া যাচ্ছে কেন? তা ছাড়া সব মিলের ক্ষেত্রে এই অজুহাতটাও তো খাটছে না! কারণ, বন্ধ মিলগুলির মধ্যে প্রায় চার-পাঁচটা জুটমিল বহুদিন যাবৎ অন্য কারণে বন্ধ রয়েছে। মালিকরা কাঁচা পাটের অভাবের কথা মিল বন্ধের নোটিশে উল্লেখ করলেও তারা একই সাথে শ্রমিক ছাঁটাই, শ্রমিকদের ওপর কাজের বোঝা চাপানো, কাজগুলি কন্ট্রাক্টে দেওয়া ইত্যাদি নানা বেআইনি শর্ত চাপানোর কথা বলছে। এতেই তাদের আসল অসাধু উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যায় না কি!

কাঁচা পাটের সঙ্কট থাকলে কেন্দ্রীয় সরকার তা অন্য দেশ থেকে আমদানি করার ব্যবস্থা করুক। এ দায়িত্ব তো তাদেরই! অন্যদিকে শ্রমিকের স্বার্থ দেখার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের উপর বর্তায়। পাট শিল্পের সংকট মেটাতে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন এবং হস্তক্ষেপ কোনও সরকার করছে না। দুই সরকারই উদাসীন। ফলে বাড়ছে জুট শ্রমিকদের জীবনের ভয়ানক সঙ্কট। চটশিল্পের প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিকই প্রায় পরিযায়ী শ্রমিক। এঁরা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা বা পশ্চিমবঙ্গের দূরবর্তী জেলা থেকে হুগলি নদীর দুইপারের মিলগুলিতে কাজ করতে আসেন। লকডাউন পরিস্থিতিতে তাঁরা পরিবহণের অভাবে ফিরে যেতেও পারছেন না। রোজগারহীন অবস্থায় তাঁরা দুর্বিষহ অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছেন। সরকার প্রথমে ৩০ শতাংশ তারপর ৪০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে মিল চালাতে বলেছে। কিন্তু বাকি ৬০-৭০ শতাংশ শ্রমিক কী করে দিন চালাবেন? রোজগারহীন হয়ে পড়া এই শ্রমিকদের নিয়ে সরকারের কোনও পরিকল্পনা বা নির্দেশ নেই। এর প্রতিবাদ করেছে এআইইউটিইউসি সহ শ্রমিক ইউনিয়নগুলি।

এই পরিস্থিতিতে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য, শ্রমিক সংগঠন এআইইউটিইউসি-র রাজ্য সম্পাদক কমরেড অশোক দাস এবং এআইইউটিইউসি অনুমোদিত বেঙ্গল জুটমিলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কমরেড অমল সেন রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে বন্ধ হওয়া মিলগুলি অবিলম্বে খোলার দাবিতে চিঠি দিয়েছেন। রোজগারহীন শ্রমিকদের মাসিক ৭,৫০০ টাকা করে অনুদান এবং বিনামূল্যে মাথাপিছু ১০ কেজি করে চাল, আটা ইত্যাদি রেশন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

গণদাবী ৭৩ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা