ভোটকেন্দ্রিক রাজনীতিতে রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দলের বাদানুবাদ বহু দিন ধরেই পরস্পরের প্রতি নোংরা কাদা-ছোঁড়াছুড়িতে পরিণত হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, এই বিরোধিতা যেন কদর্যতার শেষ সীমাটুকুও ছাড়িয়ে যেতে বসেছে।
সম্প্রতি রাজনৈতিক বিরোধিতার নামে আবারও কু-কথার লড়াইয়ের সাক্ষী হতে হল রাজ্যবাসীকে। কলকাতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সভার পরপরই বিজেপির নেতারা বিধানসভা চত্বরে এসে ধর্নায় বসে পড়েন। সেখানে আগে থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের ধর্না চলছিল। শুরু হয়ে যায় একে অপরের প্রতি গালিবর্ষণ, উগ্র বিদ্বেষবর্ষী কামান দাগা। পরিস্থিতি এমন চেহারা নেয় যে পুলিশকে দুই বিবদমান পক্ষের মাঝে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে হয়। কয়েকদিন ধরেই দুই দলেরই নেতা-মন্ত্রীরা পরস্পরবিরোধিতার নামে এই নির্লজ্জ আচরণ চালিয়ে যান। ঘটি-বাটি-থালা বাজিয়ে হল্লা করা, এক দলের অবস্থানস্থলকে ‘অপবিত্র’ ঘোষণা করে অপর দলের সেই জায়গা গঙ্গাজলে ‘শোধন’ করা থেকে শুরু করে এর ওকে ‘চোর’ এবং ওর একে ‘পকেটমার’ আখ্যা দেওয়া– কিছুই বাদ দেননি ‘গণতন্ত্রে’র তথাকথিত এই মুখপাত্রেরা। এই আচরণের দ্বারা তাঁরা শুধু যে সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকেই নির্বিচারে দুক্সপায়ে মাড়িয়ে গেলেন তাই নয়, সভ্যতা, শালীনতা, ভদ্রতাবোধের যে সংস্কৃতি সমাজে আজও খানিকটা টিকে আছে, সে সবের তোয়াক্কাটুকুও করলেন না।
সভ্য মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, গণতন্ত্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ‘নির্বাচন’কে ঘিরেই যাদের যাবতীয় কার্যক্রম, সেই নেতারা সুস্থ বিতর্কের পরিবর্তে এ ভাবে অর্থহীন ও নোংরা ‘কলতলার কোন্দলে’ সামিল হচ্ছেন কেন? আসলে এ ছাড়া তাঁদের ঝুলিতে কার্যত আর কিছুই নেই। লক্ষ করলে দেখা যাবে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে, কিংবা রাজ্যে, শাসক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মৌলিক নীতি-আদর্শগত প্রশ্নে পার্থক্য নেই বললেই চলে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি-রাজনীতির এই দেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রতিটি রাজনৈতিক দলই পুঁজিপতি শ্রেণিস্বার্থের অনুগত সেবক। কেউ একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজিগোষ্ঠীর, কেউ বা তারই সঙ্গে আঞ্চলিক পুঁজির স্বার্থের রক্ষক। আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি প্রণয়ন থেকে শুরু করে এই দলগুলির যাবতীয় সরকারি ও বেসরকারি কার্যক্রমের লক্ষ্য পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার সুরক্ষা ও বৃদ্ধি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের জন্য মাঝে মাঝে কিছু দান-খয়রাতি আর শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতি বর্ষণ ছাড়া এঁদের রাজনীতি আর কিছুই নেই। এ দিকে, ভোটে জিতে সরকারি ক্ষমতা পেতে পুঁজিপতি শ্রেণির আশীর্বাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সমর্থনও এই দলগুলির কাছে জরুরি। তাই জনস্বার্থের ভেক ধরে মাঝে মাঝেই এক দলকে গলা ফাটাতে হয় অপর দলের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে দিয়ে শাসক দল ও বিরোধী উভয় দলই মানুষের উদ্দেশে বার্তা দিতে চায়– ‘ওদের নয়, আমাদের সরকারে বসাও।’ আর জনসাধারণ বাধ্য হয় এই কুৎসিত কুনাট্যের দর্শক হতে।
নিজেদের যারা বামপন্থী বলে পরিচয় দেয় সেই সিপিএম-ও ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধীদের সঙ্গে সঙ্গে এমন আচরণই করেছে। বিরোধীদের প্রতি কুকথা বর্ষণে, ব্যক্তিগত নোংরা আক্রমণ হানতে তারাও কম যায় না।
অথচ এই দলগুলির একের বিরুদ্ধে অপরের কিছু বলার ছিল না, তা কিন্তু নয়। তৃণমূল কংগ্রেস দলটি যখন চুরি-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে আছে, রাজ্যে যখন বেকার সমস্যা ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে, চাকরিপ্রার্থীরা মাসের পর মাস ধরে আন্দোলন চালাচ্ছেন, শিক্ষা নেই, চিকিৎসা নেই, দারিদ্র, নারী নির্যাতন বাড়ছে তখন বিরোধী দল হিসাবে বিজেপি জনস্বার্থ রক্ষা করতে চাইলে এই বিষয়গুলি নিয়েই আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত, জনস্বার্থবাহী দল হলে এ রাজ্যে বিজেপির তো সেই পথেই হাঁটা উচিত ছিল। আসলে সেই চরিত্রই তার নয়। তাই যে সব রাজ্যে তারা ক্ষমতায়, সেখানে খোদ বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরাই চূড়ান্ত চুরি-দুর্নীতির পাঁকে হাবুডুবু খাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলের নেতা স্বয়ং চুরি-দুর্নীতির অনেকগুলি অভিযোগে অভিযুক্ত। তা ছাড়া, এই ক’দিন আগেও যিনি নিজেই তৃণমূলের নেতা হিসাবে দলটির দুর্নীতিচক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তাঁর পক্ষে চুরি-দুর্নীতি বন্ধে কার্যকরী বিরোধীতা কি আদৌ সম্ভব? তাই গলাবাজি ছাড়া বিরোধিতার অন্য পথ নেই তাঁদের। আবার একই কারণে বিজেপির বিরুদ্ধে নীতির ভিত্তিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয় তৃণমূল কংগ্রেসের। বিজেপি বিরোধিতাকে তাই বাধ্য হয়েই প্রায় নোংরা ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন তাদের নেতারা। এভাবেই রাজনৈতিক বিরোধিতা আজ এমন চরম অপসংস্কৃতির রূপ নিয়েছে। নেতাদের এই রুচিহীন আচরণ সামগ্রিকভাবে সমাজের রুচি-সংস্কৃতির মানটিকেও টেনে নামাচ্ছে।
শাসক-শোষক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাতের লক্ষ্যে ভারতে যে রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা, এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্ক্সবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ সেই রাজনীতিকে বলেছিলেন ‘উচ্চ হৃদয়বৃত্তি।’ বলেছিলেন বিপ্লবী রাজনীতি হৃদয়বৃত্তির দিক দিয়ে আরও উচ্চতর। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে ব্রিটিশকে পরাস্ত করার বদলে আপস-হস্তান্তরের মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা এল। ব্রিটিশের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিল দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণি। কায়েম হল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা। কিন্তু ততদিনে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিকাশের যুগ পার হয়ে ঢলে পড়েছে অস্তের দিকে। মরতে বসা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হারিয়ে ফেলেছে তার সমস্ত প্রগতিশীল নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, উদারতা। আর এই পচা-গলা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটির সেবা করে চলেছে ভোটসর্বস্ব যে সব রাজনৈতিক দল, স্বাভাবিক কারণেই সেখানে আজ আর হৃদয়বৃত্তির ছিটেফোঁটাও যেমন খুঁজলে মেলে না, তেমনই সংস্কৃতিও কবেই হারিয়ে গেছে। তাই দুর্নীতি, ন্যক্কারজনক আচার-আচরণ, নিকৃষ্ট গলাবাজি, জোকারের মতো অঙ্গভঙ্গি, জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চরম মিথ্যাচার– এ সবই আজ প্রতিটি গদিলোভী রাজনৈতিক দলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যরই প্রকাশ দেখা গেল বিধানসভা চত্বরে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির সাম্প্রতিক জঘন্য দ্বৈরথে। নির্বাচনের মাধ্যমে এদেরই একদলকে হঠিয়ে আরেক দলকে সরকারে বসিয়ে এই জঘন্য পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। এই অবস্থা বদলাতে চাই উন্নত নীতি-নৈতিকতা ও রুচি-সংস্কৃতির ভিত্তিতে জনজীবনের দাবি নিয়ে সর্বব্যাপক সংগ্রামী বাম আন্দোলন। সঠিক বামপন্থী নেতৃত্বে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া জনসাধারণকে সংগঠিত করে দেশ জুড়ে এমন আন্দোলন গড়ে উঠলে তার উত্তাল স্রোতে ভেসে যাবে ক্ষমতালোভী রাজনীতির অঙ্গের ভূষণ এই কুৎসিত অশালীনতা, লজ্জাহীন কুকথা ও গলাবাজির সমস্ত আবর্জনা। সাগ্রহে সেই আন্দোলনের দিন গুনছেন দেশবাসী।