মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, পঞ্চায়েতে তাঁর দলকে না জেতালে যে সব সুবিধা তাঁরা দিচ্ছেন সব বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি জনগণের যা কিছু অভিযোগ সব তাঁকে জানাতে বলেছেন। তাহলেই নাকি সমাধান হবে। মনে রাখা দরকার, তাঁর বক্তব্যের প্রসঙ্গটা ছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন। যে পঞ্চায়েতের উদ্দেশ্য নাকি গ্রামীণ মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া বা তথাকথিত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ।
তা হলে যে প্রশ্নটা উঠবেই, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণকে যদি ক্ষমতাবান করাটাই উদ্দে্যশ্য হয়, তা হলে সব সমস্যা মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে হবে কেন? গ্রামের মানুষ নিজেদের কথা বলার কোনও প্ল্যাটফর্ম পাবে না কেন? কেন কাটমানি খাওয়া নেতাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যও গ্রামীণ জনগণকে শাসকদলের সুপ্রিমোর ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে? তাদের ভোটে জিতে পঞ্চায়েত-বাবু হওয়া প্রতিনিধি চুরি করলে তাকে বাতিল করবার অধিকার কেন জনগণের হাতে থাকবে না? আইনের ভাষায় যাকে ‘রাইট টু রিকল’ বলে, জনগণকে সেই অধিকার দেওয়ার দাবি এস ইউ সি আই (সি) বহু বছর আগে থেকে তুললেও অন্য দলগুলো, তৃণমূলের কথা বাদ দিলেও যে বিরোধীরা দুর্নীতি নিয়ে উচ্চকণ্ঠ, তারাও কেন তা মানতে রাজি নয়? গ্রামের মানুষ খুব ভাল করে জানেন, পঞ্চায়েত যার বিকেন্দ্রীকরণ করেছে, যেটাকে একেবারে গ্রাম স্তরে ছড়িয়ে দিয়েছে তা হল– দুর্নীতি করার, মানুষকে মুঠোয় রাখার ক্ষমতা। কেন্দে্রর বড়-গদিতে যারা বসে তারা লক্ষ কোটি টাকার রাফাল কেলেঙ্কারি করে, নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মাল্যদের দেশ ছেড়ে পালাতে সাহায্য করে। রাজ্যের মেজো-গদিতে সমাসীনরা স্কুলের চাকরি বেচে শত কোটি টাকার দুর্নীতি করে। সেই সময় পঞ্চায়েতের ছোট-গদির বাবুরা এক-দুই কোটি টাকার প্রকল্পে কাটমানি খায়, আবাস যোজনা কিংবা ১০০ দিনের কাজের টাকা মারে। স্তরে স্তরে আয়তনের পার্থক্য নিয়ে দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণই হয়েছে এই দেশের প্রচলিত ভোট-ব্যবস্থায়, যার পোশাকি নামই সংসদীয় গণতন্ত্র!
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করবে কে? বিজেপির প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজ্যে রাজ্যে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার চাই। না হলে কেন্দে্রর উন্নয়নের টাকার ভাগ রাজ্যে পৌঁছবে না। রাজ্যে অন্য কোনও দলের সরকার থাকলে তারা পঞ্চায়েতের ভোটে বোঝায়, দেখ বাপু, আমরাই সরকারে আছি, আমাদের না জেতালে তোমাদের গ্রামের উন্নয়ন বন্ধ! সামান্য একটা রেশন কার্ড, বিপিএল কার্ড কোনও কিছুই শাসকদলের আনুগত্য ছাড়া মিলবে না। এই ব্যাপারে কোনও শাসকদলই কিছু কম যায় না। সিপিএম রাজ্য সরকারে থাকার সময় জয়নগর-কুলতলিতে বোঝাত ‘এসইউসিআই-কে ভোট দিয়ে কী হবে? আমরা রাজ্য সরকারে আছি, আমরাই তোমাদের সব সুবিধা পাইয়ে দেব।’ বিজেপি যেখানে রাজ্যে ক্ষমতায় আছে সেখানে এই ভাষাতেই পঞ্চায়েত ভোটের কথা মানুষকে বোঝায়। তৃণমূল হুবহু এক ভাষাই রপ্ত করেছে। এটাই ভোটের ব্র্যান্ড স্লোগান। এর মধ্যে কোথায় বিকেন্দ্রীকরণ? এ তো চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ। এই বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের হাড়ে-মজ্জায় কোথাও জনগণের জন্য ক্ষমতার কথাটাই নেই– তার বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্নটাই তাই ওঠে না। তাই ভোটবাজ সংসদীয় দলগুলিরও ভাষা সেই লাইনই অনুসরণ করে থাকে।
তা হলে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা কী করে? সরকারের প্রশাসন আমলা বাহিনীর যে কাজগুলো করার কথা ছিল, সেগুলিই তাদের হয়ে পঞ্চায়েত করে দেয়। পঞ্চায়েতের বাবুরা হয়ে ওঠেন এক একজন গ্রামীণ আমলা, যাদের দাপটে মাথা নিচু না করে সাধারণ মানুষের কোনও উপায় নেই। গ্রামীণ মানুষের জীবনে পাড়াগত সালিশি বিচার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এ ক্ষেত্রে থানাকে কন্ট্রোল করে সরকারি দল। তারা পুলিশকে দিয়ে চাপ দেয়, ভোট না দিলে পুলিশের ভয় দেখায়। পঞ্চায়েত আজ গ্রামীণ জনগণের ওপর শাসকশ্রেণির দাপট প্রতিষ্ঠার বড় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। মোদি সরকার এখন পশ্চিমবঙ্গে বলতে শুরু করেছে– টাকা যাবে ‘পিএম টু ডিএম’, মানে একেবারে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সরাসরি জেলাশাসকের হাতে টাকা পৌঁছে যাবে। মাঝখানে রাজ্য সরকারের কোনও ভূমিকাই থাকবে না। সেই টাকা এবার পঞ্চায়েত কোন খাতে, কী ভাবে কতটুকু খরচ করবে তাও একেবারে ছক বেঁধে দেওয়া আছে। নীতিগত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার এতটুকু ক্ষমতা পঞ্চায়েতের নেই। কোন রাস্তা তৈরি হবে, কোন কাজটায় অগ্রাধিকার হবে, তা ঠিক হওয়ার কথা ছিল গ্রাম সংসদের মিটিংয়ে। সেই সংসদও এখন খাতায় কলমে একটা ব্যবস্থা। খুব বেশি হলে ক্ষমতাবানদের পক্ষে হাত তোলাই এই সংসদের কাজ। পঞ্চায়েতের মধ্য দিয়ে একচেটিয়া মালিকদের স্বার্থবাহী নীতিগুলি কোন দল সবচেয়ে ভালভাবে বহন করতে পারে তার ভিত্তিতেই ঠিক হয় সংবাদমাধ্যম কখন কাকে প্রচার দেবে, কার পিছনে মালিকরা টাকা ঢালবে। তাই এখন পঞ্চায়েতের ভোট নিয়ে শুরু হয়েছে হরেক সমীক্ষা, কে জিতবে কে হারবে এই হাওয়া তুলে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে কে সঠিক কে বেঠিক এই প্রশ্নটাকেই। যেন যে জিতবে তার পিছনে থাকলেই সাধারণ মানুষের মোক্ষলাভ হয়ে যাবে! ন্যায় জিতবে না অন্যায় জিতবে এই প্রশ্নটাই যেন অবান্তর! সৎ, জনমুখী, কর্মঠ, সঠিক রাজনীতি নিয়ে চলা কোনও প্রার্থীকে জেতানোর চেয়ে দলের রং, টাকার জোর, সমাজবিরোধী কন্ট্রোল করার জোর কার বেশি সেই দেখেই তার দিকে মানুষের ঢলে পড়াটাকেই বলা হচ্ছে নির্বাচনী গণতন্ত্র।
পঞ্চায়েত ভোটে এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া নানা কিসিমের ঝান্ডাধারী দলের বক্তব্য শুনলে কী পাওয়া যায়? তৃণমূল বলছে তোমাদের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দিয়েছি, নানা ‘শ্রী’ নামে নগদ টাকা দিয়েছি, ক্লাবে টাকা দিয়েছি অতএব আমাদের ভোট দাও। বিজেপি বলছে কেন্দ্র আরও বেশি দিতে পারে তাই আমাকে দাও। সিপিএম বলছে আমরা ক্ষমতায় থাকার সময় তোমাদের পাইয়ে দিয়েছি, এবার ক্ষমতায় এলে আরও পাইয়ে দেব। একটা টিউবওয়েল, কয়েক ফুট রাস্তায় ইট ফেলা, কয়েকটি বিদ্যুতের খুঁটি, একটা জবকার্ড, আবাস যোজনার একটা ঘর, কোনও একটা লোন এই সব দেখিয়েই দলগুলো ভোট চায়। তারা মানুষের মনটাকে এমনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করে যেন সামান্য কোনও সুবিধা পাইয়ে দিয়ে নেতারা একেবারে কৃতার্থ করে দিয়েছেন! অথচ বলে না, এগুলো তোমার অধিকার, না পেলে চলো তোমাকে সঙ্গে নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে লড়ে এই অধিকার আদায় করব। পঞ্চায়েতে এই দলগুলোর ভূমিকা মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনকে চরম বাধাগ্রস্ত করছে। এ হল মানুষকে সমস্যা সমাধানের রাস্তা না দেখিয়ে তাকে সুবিধার মুখাপেক্ষী করে তোলার নোংরা রাজনীতি। ঠিক যেন একজন কুয়োয় পড়া মানুষকে উদ্ধার করার চেষ্টা না করে ওই কুয়োতেই তাকে আটকে রেখে জল, খাবার অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে কৃতিত্ব দেখানো! দুর্নীতির প্রশ্নেও দলগুলির দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় এক। নিজেদের ওপর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য তাঁরা সকলেই সাধারণত অন্যদের দুর্নীতির কথা তোলেন। যুব সমাজের বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে এরা গ্রামে গ্রামে যুবকদের অর্থের বিনিময়ে অনৈতিক পথে ঠেলে দেয়। তাদের অস্ত্রধারী সমাজবিরোধীতে পরিণত করে। তারাই হয়ে যায় পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা বিধানসভা সব ভোটে ক্ষমতাবানদের জেতার হাতিয়ার। যে যত টাকা ছড়াতে পারে, প্রশাসনকে কব্জা করতে পারে, সংবাদমাধ্যমের সমীক্ষায় নিজের কোলে ঝোল টানতে পারে সেই জেতে। এ হল জনসাধারণের ওপর দাপট জারি রাখার হাতিয়ার। এর নামই গণতন্ত্র!
পঞ্চায়েতে গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষমতায়ন কেমন ঘটেছে? মানুষের অভিজ্ঞতা, মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ চালু হওয়ার পর থেকে নানা সময় সরকারি ক্ষমতায় বসা ভোটবাজ দলগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতাশালী নেতাদের স্ত্রীদেরই পঞ্চায়েতে জিতিয়ে নিজেদের মৌরসীপাট্টা কায়েম রাখার চেষ্টা করে গেছে। পঞ্চায়েতে মেয়েরা জিতেছেন, প্রধানও হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের সামাজিক অবস্থানের উন্নতি, পরিবারের তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে গ্রামের জন্য প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কতটুকু বেড়েছে? যাঁরা খোঁজ রাখেন জানেন, বাড়েনি। গ্রামে গার্হস্থ্য হিংসা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন বন্ধ করা গেছে? মেয়েদের শিক্ষার হার, স্বাস্থ্যের উন্নতি বেড়েছে? তথ্য বলছে, একেবারেই না। মেয়েদের জীবন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আর পুঁজিবাদী শোষণের যৌথ জাঁতাকলে দ্বিগুণ নিষ্পেষিত। সব মিলিয়ে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা শোষণমূলক, দুর্নীতিগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই নিম্নতম ইউনিট।
বুর্জোয়া রাজনীতির এটাই আজকের পরিণতি। পঞ্চায়েত কিংবা বিধানসভা কিংবা লোকসভা কোথাও আজ মানুষের কণ্ঠস্বর এই রাজনীতি তুলে ধরে না। যত দিন যাচ্ছে এই রাজনীতির আরও কুৎসিত নোংরা রূপ বেরিয়ে আসছে।
এই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এস ইউ সি আই (সি) মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার আলোয় নিয়ে এসেছে এক সম্পূর্ণ আলাদা রাজনীতির পথ। মানুষের কাছে উপস্থিত করেছে তাদের অধিকারের কথা। গণকমিটির ভিত্তিতে পঞ্চায়েত পরিচালনা ও অধিকার আদায়ের জন্য গণআন্দোলন গড়ে তুলে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার রাস্তা শেখায় এই রাজনীতি। ভোটেও এই রাজনীতিকেই শক্তিশালী করা ছাড়া আজ রাস্তা নেই।