শিবদাস ঘোষ
লেনিনবাদ হচ্ছে এই যুগে দেশকাল ভেদে যে পার্থক্য, সেই পার্থক্যকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অধীন প্রত্যেকটি দেশের বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে অনুধাবন করবার একটি বিচার পদ্ধতি, দেখবার একটি দৃষ্টিভঙ্গি৷ এ যুগে প্রত্যেকটি দেশের বিপ্লবের মূল নীতি কী হবে, তা লেনিনবাদ তুলে ধরেছে৷ তাই লেনিনবাদকে বলা হয়, এই যুগের, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ৷ এ কথার মানে হল, বর্তমান যুগে যখন পুঁজিবাদ ক্ষয়িষ্ণু–মরণোন্মুখ, যখন সে তার বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দিয়ে চরম প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেছে, দেশে দেশে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে গলা টিপে মারছে, তখন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অধীন পুঁজিবাদী এবং ঔপনিবেশিক ও আধা–ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে অনুধাবন করবার এবং সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করবার মূল নীতিগুলো তুলে ধরেছে লেনিনবাদ৷
এই লেনিনবাদকে হাতিয়ার করেই, বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণি বিপ্লব করেছে৷ নভেম্বর বিপ্লবের চরিত্র জাতীয় ছিল না, তার চরিত্র আন্তর্জাতিক৷ নভেম্বর বিপ্লব এ যুগের সকল দেশের সামনেই বিপ্লবের একটা পরিপ্রেক্ষিত ও মূল নীতিকে তুলে ধরেছে৷ নভেম্বর বিপ্লব দেখিয়ে দিয়েছে, শ্রমিক শ্রেণি বিপ্লব করতে পারে৷ এই বিপ্লব নিঃসংশয়ে প্রমাণ করেছে যে, বিশ্বপুঁজিবাদী বিপ্লবের যুগ খতম হয়ে গিয়ে বিশ্বপুঁজিবাদ ক্ষয়িষ্ণু, ধ্বংসোন্মুখ, প্রগতিবিরোধী হয়ে পড়েছে, জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের বিরোধী হয়ে পড়েছে৷ তাই সমাজপ্রগতির দ্বার সে রুদ্ধ করছে৷ প্রযুক্তির বিকাশ ও আধুনিকীকরণ সত্ত্বেও পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় চরম সংকট দেখা দিচ্ছে, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দূর করতে পারছে না৷ পুঁজিপতিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং জনসাধারণের উপর দেশের ও দেশের বাইরের পুঁজিপতিদের, অর্থাৎ, দু’দিকের শোষণের ফলে বর্ধিত উৎপাদিকা শক্তির তুলনায় বাজারের সংকোচন ক্রমাগত উৎপাদনে সংকট ডেকে আনছে৷ আর, এই সংকট ইন দ্য রিভার্স অর্ডার (উল্টো দিক থেকে) মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প–দর্শন–সাহিত্য্ যে বিকাশ ঘটে– সেই প্রক্রিয়ার উপরও প্রভাব ফেলছে, তাকে খর্ব করছে৷ তা হলে, সমস্ত দিক থেকে পুঁজিবাদ হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু এবং প্রগতিবিরোধী৷ ফলে, তাকে বিপ্লবের আঘাতে হটাতে হবে৷ এই বিপ্লবে অবশ্যই সর্বহারা শ্রেণি নেতৃত্ব দেবে৷ তাই বর্তমান আন্তর্জাতিক বিপ্লবের স্তর হচ্ছে, শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর৷
দ্বিতীয়ত, বিশ্বের পিছিয়ে–পড়া পুঁজিবাদী দেশগুলোতে, অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিকাশের অর্থে যে দেশগুলো বনেদি পুঁজিবাদী দেশগুলোর থেকে পিছিয়ে আছে, যেখানে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কায়েম রয়েছে, যেখানে বুর্জোয়াদের প্রগতিশীল ভূমিকা শেষ হয়ে গিয়েছে, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক–চাষির ঐক্য সাধন করে বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করতে হবে৷
তৃতীয়ত, যেসব দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবই হয়নি, বা যেসব দেশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী উপনিবেশবিরোধী জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন বা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের স্তরে রয়েছে, সেইসব দেশেও শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমিক–চাষি এবং জাতীয় বুর্জোয়াদের কোনও অংশ যদি সেই লড়াইতে আসতে চায়, আসবার মতো জায়গায় থেকে থাকে, তবে তাদের নিয়ে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সংগঠিত করতে হবে৷ কিন্তু, তাকে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বা সর্বহারা বিপ্লবের অংশ ভাবতে হবে এবং অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণির, সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বেই সেগুলো পরিচালনা করতে হবে৷ এভাবে যদি কেউ না ভাবে, তবে তারা ভুল করবে এবং ভুলের মাশুল তাদের দিতে হবে এই অর্থে যে, এই বিপ্লব সফল পরিণতিতে পৌঁছবে না৷ কারণ, শ্রমিক শ্রেণি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে, সেই দেশের বুর্জোয়ারা তার নেতৃত্ব দখল করবে এবং সেই বুর্জোয়ারা আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়ার অংশ হিসাবে বিপ্লবের পথ ও গতি রুদ্ধ করবে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব আধ–সেঁকা রুটির মতো ও খণ্ডিতভাবে সমাপ্ত হবে৷ এর ফলে গণমুক্তি আসবে না, বরং, পুঁজিবাদ সংহত হবে, এমনকী জাতীয় স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরও তা বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকবে৷ আজ যে নিও–কলোনিয়ালিজম (নয়া–উপনিবেশবাদের্) কথা বলা হচ্ছে, লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত ব্যাখ্যাতেও তার স্বীকৃতি রয়েছে৷ তিনি নিজেই এটা বলে গেছেন৷ নয়া–উপনিবেশবাদ শব্দটা লেনিন ব্যবহার করেছেন কি করেননি, সেটা আমার কাছে খুব বড় কথা নয়৷ কিন্তু নয়া–উপনিবেশবাদের মূল বৈশিষ্ট্য বা মূল কথাটা লেনিনেই পাওয়া যাবে যে, এ যুগে সাম্রাজ্যবাদীরা অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব বিস্তার করার মধ্য দিয়ে পিছিয়ে–পড়া স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক, এমনকী সামরিক কর্তৃত্ব পর্যন্ত কার্যত নিজেদের অধীনে এনে ফেলবে৷ সাম্রাজ্যবাদ পুরনো ঢঙে থাকবে না, নতুন ঢঙে আসবে অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে৷ তাই এযুগে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনগুলোতে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে, তবেই সেগুলো সঠিক ও সফল পরিণতিতে পৌঁছবে, সেগুলোকে মূল লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া যাবে৷ অর্থাৎ, এই সমস্ত দেশের বিপ্লবগুলোকে ক্রমে ক্রমে উত্তরণ ঘটানোর মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে নিয়ে যাওয়া যাবে, জাতীয় স্বাধীনতাও পুরোপুরি অর্জিত ও রক্ষিত হতে পারবে৷ …
… আমাদের দেশে মার্কসবাদ–লেনিনবাদের নামে বড় বড় সব পার্টি তৈরি হওয়ার পর কত যুগ পার হয়ে গেল৷ কত আন্দোলন তাদের নেতৃত্বে হল৷ কিন্তু, কী হল? তারা বিপ্লব সফল করেছে কি করেনি, বিপ্লবের পথে বেশিদূর এগোতে পেরেছে কি পারেনি– এই প্রশ্ন আমি তুলছি না৷ বিপ্লব করা যায়নি মানেই বিপ্লবের চিন্তা বা তত্ত্বটা ভুল ছিল, তা প্রমাণিত হয়ে যায় না৷ কারণ, শুধুমাত্র চিন্তার সঠিকতাই বিপ্লব করে দেয় না৷ বিপ্লবের জন্য সঠিক পদ্ধতিতে এগোবার সাধনাই সমাজে একমাত্র শক্তি নয়৷ সমাজে বিপ্লবের সপক্ষে যেমন শক্তি থাকে, তেমনি বিপ্লবকে রোখবার পারিপার্শ্বিক শক্তিগুলোও থাকে, যেটা নানাভাবে বিপ্লবকে ক্রমাগত বাধা দেয়৷ বিপ্লববিরোধী এই পরিবেশ ও শক্তিটা কোন সময়ে কতটা প্রবলভাবে কাজ করছে, সেটা বিচারে রাখতে হয়৷ বিপ্লবী তত্ত্বের সারবত্তা ঠিক থাকলেই যদি বিপ্লবী মতের পক্ষে হু হু করে সংগঠন বাড়ত, দ্রুত বিপ্লব হয়ে যেত, তাহলে, মার্কসের পক্ষে নিজের হাতেই তাঁর দেশে বিপ্লব করে যাওয়া সম্ভব ছিল৷ তাহলে, কোনও বড় বিপ্লবীর জীবনে সঠিক তত্ত্ব ও পদ্ধতিতে সংগ্রাম করা সত্ত্বেও পরাজয় বরণ করার প্রশ্ন ইতিহাসে দেখা দিত না৷ এগুলো ছেলেভুলোনো কথা৷ যাঁরা তত্ত্বটাকে ঠিক উপলব্ধি করেন তাঁরা জানেন যে, বিপ্লবের তত্ত্ব সঠিক ও নির্ভুল হলেও বিপ্লবের অগ্রগতি দ্রুত হবে কি মন্থর হবে, শুধু তত্ত্বের উপর তা নির্ভর করে না৷
ফলে, আমার প্রশ্ন এ জায়গায় নয়৷ আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে উপলব্ধির ভিত্তিতে তারা সব বড় বড় পার্টি গঠন করে ফেলল, তাদের সেই উপলব্ধি ও তাদের পার্টির গঠন প্রক্রিয়াটা কি লেনিনবাদসম্মত? ভারতের বিশেষ পরিস্থিতির যে ব্যাখ্যা তারা রেখেছে এবং তার ভিত্তিতে বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করেছে, সেটা কি যথার্থ মার্কসবাদ–লেনিনবাদসম্মত, বিজ্ঞানসম্মত? এইটাই মূল প্রশ্ন৷ এগুলো সঠিক থেকেও যদি তাদের পক্ষে বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কষ্টকর হত, তাহলে বোঝা যেত, তাদের তত্ত্ব ও রাস্তাটা ঠিকই আছে, কিন্তু বিরুদ্ধ পরিবেশ আটকাচ্ছে৷ তখন সেই বিরুদ্ধ পরিবেশের বিরুদ্ধে কীভাবে কতটা সংগ্রাম করে বিপ্লবী আন্দোলনের গতিবেগটা বাড়ানো যায়, সেটাই হত মূল প্রশ্ন৷ কিন্তু এখানে তো তা নয়৷
সি পি আই, সি পি আই(এম) এবং সি পি আই (এম–এল)–এর মতো দলগুলো আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের স্বীকৃতি নিয়ে ও তার সঙ্গে সাম্যবাদী আন্দোলনের যে বিশ্বজোড়া গৌরব তৈরি হয়েছিল, তাকে পুঁজি করে এদেশে দাঁড়িয়েছিল৷ মানুষের মধ্যে মুক্তির আকাঙক্ষা থেকে মার্কসবাদ–লেনিনবাদের প্রতি যে স্বাভাবিক দুর্নিবার আকর্ষণের কথা আমি আগেই বলেছি, তার ফলেই এইসব দলগুলোর নেতাদের মুখে মার্কসবাদ–লেনিনবাদের কথা শুনে দলে দলে মানুষ তাদের পিছনে জড়ো হয়েছে৷ আবার দেখবেন, পার্টির আকারটা বড় হয়ে গেলে, তাকে ভিত্তি করে মানুষের মধ্যে একটা মানসিকতা গড়ে ওঠে৷ পার্টিটার নেতৃত্ব সঠিক হোক, বেঠিক হোক, তার প্রভাবে প্রভাবিত মানুষগুলো শুধু পার্টিটা বড় বলেই নাচতে থাকে৷ তাদের মানসিক গঠন ও চিন্তা প্রক্রিয়াটা একটা ভিন্ন ধরনের হয়ে যায়৷ আর কোনও কিছু তারা বিচার করতে চায় না৷ লড়ে প্রাণ পর্যন্ত দেয়, তবু বিচার–বিশ্লেষণে আসতে চায় না৷ আবার, যদি কখনও বিচার–বিশ্লেষণে আসেও, তবে সেটাও হয়ে দাঁড়ায় মনগড়া বিচার–বিশ্লেষণ পদ্ধতি৷ কারণ, যে পার্টিটার রাজনীতির দ্বারা তারা প্রভাবিত, সেই পার্টিটা মার্কসবাদ–লেনিনবাদের নামে যে চিন্তাপ্রক্রিয়া, যে বিচারপদ্ধতি নিয়ে চলে, সেটা মার্কসবাদী–লেনিনবাদী চিন্তাপ্রক্রিয়া বা বিচারপদ্ধতিই নয়৷ ফলে, এসব দলের কর্মীদের এবং এদের রাজনীতির প্রভাবে প্রভাবিত মানুষগুলোর চিন্তা ও বিচারের পদ্ধতি অ–মার্কসবাদী হওয়ার জন্য যে সিদ্ধান্তগুলো তারা করে, সেগুলো সমাজ পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক নিয়মের প্রেক্ষাপটে হয়ে দাঁড়ায় মনগড়া৷ এরাই পরে যখন দেখে কিছুই হল না, তখন হতাশ হয়, আন্দোলন থেকেই সাময়িকভাবে হলেও মুখ ফিরিয়ে নেয়৷
তাই যে কথা বলছিলাম, তত্ত্ব সঠিক হওয়া সত্ত্বেও তাকে বাস্তবায়িত করার মতো উপযুক্ত সাংগঠনিক শক্তি পারিপার্শ্বিক নানা কারণে যদি অর্জন করা না যায়, তবে বিপ্লব হবে না৷ আবার, একটা দল মার্কসবাদ–লেনিনবাদের বুলি আউড়ে সুবিধাজনক পরিস্থিতি পেয়ে যদি ভাল শক্তি অর্জন করেও ফেলে, বড় পার্টি হয়ে যায়, বহু লোক তার পিছনে জড়ো হয়ে যায়, তা সত্ত্বেও সেই দলের তত্ত্বটা যদি ভুল হয়, চিন্তাপ্রক্রিয়া ভুল হয়, বিচার–বিশ্লেষণ পদ্ধতি ভুল হয়, তাহলে শুধু তারা শক্তির জোরে বিপ্লব করে দেবে, তা হয় না৷ বিষয়টা এত সোজা নয়৷
সুতরাং, দলের নেতৃত্বের বিচার–বিশ্লেষণ পদ্ধতি, নেতা–কর্মীদের চিন্তাপ্রক্রিয়া এবং ওই দলের প্রভাবে প্রভাবিত মানুষগুলোর চিন্তাপদ্ধতির যে কথা আমি বললাম, মনে রাখবেন, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ এখানে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথাও আপনাদের মনে রাখতে হবে৷ মার্কসবাদী–লেনিনবাদী বিজ্ঞান কথাটার মানে হচ্ছে, সঠিক বৈজ্ঞানিক বিচারপদ্ধতি, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাপ্রক্রিয়া৷ এটা আয়ত্ত করার ব্যাপারটা শুধুমাত্র একজন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করে না, বরং একজন মানুষের বুদ্ধি কীভাবে প্যাটার্নড হবে, অর্থাৎ কোন ধাঁচায় গড়ে উঠবে, সেটা নির্ভর করে সেই বিশেষ মানুষটির চিন্তাপ্রক্রিয়ার উপর৷ যেমন, বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের দৃষ্টান্তই ধরুন৷ যাঁরা ট্রটস্কি, বুখারিন বা তাঁদের শিবিরের অন্যান্যদের মতাবলম্বী ছিলেন, অথবা, পরবর্তীকালে যাঁরা ক্রুশ্চেভের কট্টর সমর্থক ছিলেন, তাঁরা অতি সহজেই বিশ্বাস করেছেন ও জোর গলায় বলেছেন যে, স্ট্যালিন সোভিয়েট ইউনিয়নের অপরিমেয় ক্ষতি করে গেছেন৷ এমন কথাও তাঁরা বলেছেন যে, স্ট্যালিনের মতো ‘ধুরন্ধর শয়তান’ আর হয় না৷ অন্যদিকে, যাঁরা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অনুগামী ছিলেন, লেনিন–স্ট্যালিন–মাও সে–তুঙের নেতৃত্বে যাঁদের দ্বিধাহীন আস্থা ও আনুগত্য ছিল, তাঁদের ট্রটস্কির ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে, অথবা ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে আধুনিক শোধনবাদীরা সমাজতন্ত্রের যে অপরিমেয় ক্ষতি করেছে, সে বিষয়ে বিশ্বাস ছিল সমস্ত তর্কের ঊর্ধ্বে৷ অথচ দেখুন, এই দুই শিবিরের লোকেরাই দাবি করেন যে, তাঁরা মার্কসবাদ–লেনিনবাদ এবং সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করেন৷ তাহলে, আপনারা দেখছেন, উভয়পক্ষই নিজেদের সাম্যবাদী বলছেন, সাধারণভাবে উভয়েই সাম্যবাদী আন্দোলনের পরিমণ্ডলের মধ্যে আছেন, তবুও এত গুরুত্বপূর্ণ বা একটা মূল বিষয়ের উপর উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত একেবারে বিপরীত৷ এরকম কেন হচ্ছে? …
… চিন্তাপ্রক্রিয়া এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতার সীমাটা এই জায়গায়৷ ব্যক্তির জিনিয়াস বা ট্যালেন্ট (প্রতিভা) যাই বলুন, কোনও কিছুই সীমাহীনভাবে স্বাধীন নয়, যেমন খুশি তিনি চলেনও না, চলতে পারেনও না৷ প্রত্যেকেই ভাবেন যে, তিনি খুব স্বাধীনভাবে মুক্তমনে চিন্তা করছেন৷ এ কথা ঠিক যে, মানুষের মনের একটা স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা সীমাহীন নয়, তা আপেক্ষিক৷ মনের স্বাধীনতারও একটা সীমা আছে৷ সেই সীমাটা দুটো জায়গায়৷ একটা হচ্ছে বাস্তব পরিবেশ, আর একটা হচ্ছে চিন্তাপ্রক্রিয়া৷ অর্থাৎ একজন ব্যক্তির ভিতরে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার অজান্তে বা জানিতভাবে তার চিন্তাপদ্ধতি গড়ে উঠেছে, সেই প্রক্রিয়াটির দ্বারা তার মনের বা চিন্তার স্বাধীনতা সীমায়িত৷ তাই আমরা একেক জন একেক রকমভাবে মার্কসবাদ বুঝছি, লেনিনবাদ বুঝছি এবং তা ব্যক্ত করছি৷ সমাজে অনেক ব্যক্তি যাঁরা মার্কসবাদকে সঠিক বলে মনে করেন, তাঁরাও মার্কসবাদকে বলছেন তাঁদের মতন করে৷ অনেকেই মনে করেন, মার্কসবাদের সমস্ত বই তিনি পড়েছেন, তিনি সব জানেন৷ মার্কসবাদ জানার তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি৷ সুতরাং, তাঁর বোঝায়ও কোনও গণ্ডগোল হয়নি৷ এভাবে যাঁরা ভাবেন, দেখা যাবে, মার্কসবাদ নিয়ে তাঁদের মধ্যে পরস্পর আলোচনায় হয়তো কোনও পয়েন্টে কোথাও দু–লাইনের ব্যাখ্যায় তাদের মধ্যে ঐক্য হচ্ছে, কিন্তু, তারপর তিন লাইনে গিয়ে বলে দিচ্ছে, তাদের মধ্যে ঐক্য হবে না৷ অথচ সবাই মনে করছেন, তাঁরা সব জানেন৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে, কারওর মনে করাটা এখানে আসল নয়, তা দিয়ে সমস্যার মূল জায়গাটা ধরা যাবে না৷ এখানেই প্রশ্ন আসে, মার্কসবাদ–লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধি৷
এখন, মার্কসবাদ–লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধি কথাটার মানে কী? এই ‘প্রকৃত’ বলতে আমরা কী বুঝি? যুক্তিসম্মত আলোচনায় পাওয়া যাবে যে, মার্কসবাদ–লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধি কথাটার যথার্থ মানে হচ্ছে, সঠিক বিজ্ঞানসম্মত বিচারপদ্ধতি, অর্থাৎ বিজ্ঞানসম্মত দ্বন্দ্বমূলক বিচারপদ্ধতি৷ এই সঠিক বিচারপদ্ধতি বাদ দিয়ে কোনও একটা বিষয়ে আলোচনায় যদি মনে হয়, এটাই ‘প্রকৃত’ এবং তাকে কেন্দ্র করে ঐক্যও হয়, তবে তাতে লাভ হয় না৷ আজ যেটা মনে হল প্রকৃত, কালই আবার একটা ঘটনায় দেখা যাবে, সমস্তটাই গোলমাল হয়ে গেল৷ এতে যেটা হয়, তা হচ্ছে সাময়িক ঐক্য৷ এর নামই হল সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছানো৷ কিন্তু এ ঘটনা তো দুটো সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ চিন্তাপদ্ধতির লোকের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে৷ তারাও তো অনেক সময় অনেক ইস্যুতে আপাতদৃষ্টিতে উপর উপর সাধারণ ঐক্যে আসে৷ একেবারে দুই বিপরীত মেরুর দর্শনের ব্যক্তিরাও একটা সাধারণ ইস্যুর উপর একটা মোটামুটি বিচারধারায় ঐক্যবদ্ধ হয়, একত্রে কাজ করে৷ না হলে, বিভিন্ন দল ও শক্তির যুক্তফ্রন্ট হয় কী করে? এইভাবে কোনও একটা সাধারণ ইস্যুর উপর ঐক্য করাটাই তো যুক্তফ্রন্ট রাজনীতির মূল কথা৷ কিন্তু, এই মাপকাঠিতে তো একটা পার্টি প্রকৃতই মার্কসবাদী–লেনিনবাদী পার্টি কি না, তার বিচার হয় না৷ একটা পার্টি প্রকৃতই মার্কসবাদী–লেনিনবাদী পার্টি কি না, তার মার্কসবাদ–লেনিনবাদের উপলব্ধিটা সঠিক কি না, তা যদি আমরা বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে সেই পার্টির বিচারপদ্ধতি কী, চিন্তাপ্রক্রিয়া কী রকম, অর্থাৎ সেটা সঠিক মার্কসবাদ–লেনিনবাদসম্মত বিচারপদ্ধতি এবং চিন্তাপ্রক্রিয়া কি না, সেইটা বোঝা অত্যন্ত জরুরি৷ অথচ এই ব্যাপারটা আমাদের দেশে মার্কসবাদী–লেনিনবাদী আন্দোলনে পরিষ্কার হয়নি৷ আমাদের দেশে প্রথমে সিপিআই, তারপর তা ভেঙে সিপিআই(এম), সেটাও ভেঙে পরে সিপিআই(এমএল) হল৷ অবশ্য, সিপিআই(এমএল) দ্রুত ভেঙে শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ সিপিআই এবং সিপিআই(এম) এই যে একই পার্টি ভেঙে দুটো পার্টি আমাদের দেশে মার্কসবাদ–লেনিনবাদের নাম নিয়ে দাঁড়াল, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের স্বীকৃতি ও গৌরবকে ভিত্তি করে বড় পার্টি হয়ে গেল, তাদের মার্কসবাদ–লেনিনব সম্পর্কে উপলব্ধি কী? এই আসল জায়গাটাই কেউ বিচার করে পরিষ্কার করে নিতে চায় না৷ তাদের রাজনৈতিক প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তগুলো বিচার করতে গিয়েও আমরা প্রতিপদেই দেখছি যে, ছোটখাটো দু’চারটে বিষয় ছাড়া মূল বক্তব্য, রাজনৈতিক বক্তব্য তাদের আগাগোড়াই ভুল৷ ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিপ্লবের স্তর, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী নেতৃত্ব সম্পর্কে ধারণা ইত্যাদি যে কোনও মূল বিষয়ে বিচার করলেই দেখা যাবে, এ সম্পর্কে সিপিআই, সিপিআই(এম)–এর বক্তব্য, বিশ্লেষণ, তত্ত্ব সবই ভুল৷
কিন্তু আমি এর চেয়েও আর একটা মূল বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই৷ কারণ, মার্কসবাদী–লেনিনবাদী সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব বলতে কেবল বিপ্লবের স্তর নির্ধারণটা সাধারণভাবে সঠিক হওয়াই বোঝায় না৷ যদিও বিপ্লবের স্তরটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে যে দলকে জনগণের মধ্যে গিয়ে কাজ করতে হয়, জনগণকে সংগঠিত করতে হয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে টেনে আনতে হয়, তার কাছে রাষ্ট্রের চরিত্র কী, বিপ্লবের স্তর কী, কোন শ্রেণিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে কোন কোন শ্রেণি মিলে উচ্ছেদ করবে– এই প্রশ্নগুলো অত্যন্ত জরুরি, এগুলো অন্যতম মূল বিষয়৷ এগুলো ছাড়া একটা রাজনৈতিক আন্দোলন দাঁড়াতেই পারে না৷ এগুলো হল একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের সামনে বিপ্লবী তত্ত্বের বিশেষীকৃত রূপ৷ কিন্তু আমি বলতে চাইছি, এই জায়গায় যদি দুটো রাজনৈতিক দলের মিল হয়ে যায়, তাহলেই কি বলা যাবে, তত্ত্বের মিল হয়ে গেল? অনেকে বলবেন, মিল হল৷ আমি মনে করি, না৷ শুধু এই দিয়ে মিল হয় না৷ যেমন, আমরা এস ইউ সি আই বলি যে, ভারতবর্ষ একটি পুঁজিবাদী দেশ এবং এখানে বিপ্লবটা হবে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷ এই কথাটা আমাদের দেশে আর এস পি বলে, ওয়ার্কার্স পার্টি বলে, আর সি পি আই–ও বলে থাকে৷ এমন ব্যক্তিও দেশে পাওয়া যাবে, তত্ত্ব বোঝেন বলে যাঁদের অহমিকা আছে, তাঁদের প্রশ্ন করা হলে তাঁরাও বলে দেবেন, ভারতবর্ষ একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, এখানে ক্ষমতায় আছে বুর্জোয়া শ্রেণি, তাদের উচ্ছেদ করবে শ্রমিক–চাষি–নিম্নমধ্যবিত্ত, নেতৃত্ব দেবে সর্বহারা, বিপ্লবটা এখানে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব৷ ব্যস, তাহলেই কি এসব দল ও ব্যক্তির সাথে এস ইউ সি আই–এর মূল বক্তব্য মিলে গেল, তত্ত্ব মিলে গেল, একথা বলা যায়? না, বলা যায় না৷ এই মিল আছে কি না দেখতে গেলে দেখতে হবে, প্রত্যেকের বিচারপদ্ধতি, চিন্তাপ্রক্রিয়া, মার্কসবাদী–লেনিনবাদী মূল নীতিগুলোর সর্বব্যাপক ক্ষেত্রে উপলব্ধি, যৌথ চিন্তা বা যৌথ নেতৃত্ব এবং তার বিশেষীকৃত প্রকাশ– এইসব মূলগত বিষয়ে চিন্তাগত ভিত্তি এক কি না, অর্থাৎ মার্কসবাদ–লেনিনবাদ সম্পর্কে ধ্যানধারণাগুলো মূল যে চিন্তাগত ভিত্তি থেকে জন্ম নিচ্ছে, সেই ভিত্তিটা এক কি না৷
(‘বৈজ্ঞানিক দ্বন্দ্বমূলক বিচারপদ্ধতিই মার্কসবাদী বিজ্ঞান’ থেকে)