কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের শ্রমমন্ত্রী ২৩ জুলাই দেশের শ্রমিক–কর্মীদের জন্য ন্যূনতম বেতন ঘোষণা করেছেন৷ মাসে ৪,৬২৮ টাকা৷ দৈনিক ১৭৮ টাকা৷ ২০১৭ সালের থেকে মাত্র ২ টাকা বেশি৷ গত দু’বছরে যা মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় মন্ত্রীর এই ঘোষণার দ্বারা বাস্তবে শ্রমিকদের বেতন বাড়ল না, অনেকটা কমল৷
কিন্তু কীসের ভিত্তিতে সরকার শ্রমিকদের জন্য এমন এক অবিশ্বাস্য বেতন কাঠামো ঘোষণা করল? সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলার রায়ে জানিয়েছিল দৈনিক ২৭০০ ক্যালরি খাবারের প্রয়োজন হিসেব করে ন্যুনতম মাসিক বেতন ঠিক হওয়া উচিত৷ সেই অনুযায়ী ২০১৬ সালে সপ্তম বেতন কমিশন হিসেব করে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন সুপারিশ করেছিল ১৮,০০০ টাকা৷ গত বছর জানুয়ারিতে মোদি–১ সরকারের শ্রমদপ্তরের তত্ত্বাবধানেই এক বিশেষজ্ঞ কমিটি নিযুক্ত হয়েছিল৷ সেই কমিটি শ্রমিকদের জন্য দিনে ২৪০০ ক্যালরি শক্তিসম্পন্ন খাবারের কথা বিবেচনা করে দৈনিক ৩৩৫ টাকা থেকে ৪৪৭ টাকা, অর্থাৎ মাসিক ৯৭৫০ টাকা থেকে ১১,৬২২ টাকা মজুরির প্রয়োজন সুপারিশ করেছে৷ বেতন কমিশন কিংবা সরকারের নিজস্ব বিশেষজ্ঞ কমিটি কারও সুপারিশই বিজেপি সরকারের মন্ত্রীরা মানলেন না৷
অথচ এই সরকারই তো মন্ত্রী কিংবা সাংসদদের মাইনে বাড়াতে এতটুকুও ইতস্তত করেনি৷ একজন এমপি–র মূল বেতন ছিল ৫০ হাজার টাকা৷ ১ লাখ টাকা৷ নানা সুবিধা সহ তাঁরা পান মাসে ২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা৷ লোকসভায় ৫৪২ জন সাংসদের মধ্যে ৪৭৫ জনই কোটিপতি৷ এর মধ্যে বহু কোটি টাকার মালিক রয়েছেন বহুজন৷ তবু তাঁদের মাইনে বাড়ছে৷ এই সরকারই এবারের বাজেটে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের জন্য কর্পোরেট ট্যাক্সে দেদার ছাড় ঘোষণা করেছে, ব্যাঙ্কে পুঁজিপতিদের না মেটানো ঋণ মিটিয়ে দিতে ৭০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে৷ অথচ সমস্ত সম্পদের স্রষ্টা শ্রমিকদের জন্য সরকার মজুরি বাড়ালো মাত্র ২ টাকা৷
দেশের শ্রমিক তথা সাধারণ মানুষকে কতখানি হীন চোখে দেখলে, তাদের সম্পর্কে কতখানি নির্মম এবং নির্লজ্জ হলে একটি সরকারের মন্ত্রীরা এমন কাজ করতে পারে
রিলায়েন্স–প্রধান মুকেশ আম্বানি মাসে কত টাকা বেতন বাবদ নেন? ১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা৷ দিনে ৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৬৬৭ টাকা৷ তাঁর দুই তুতো ভাইকে দিচ্ছেন দিনে যথাক্রমে ৫ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬৭১ এবং ৫ লক্ষ ৬৩ হাজার ৫৬১ টাকা৷ আর রিলায়েন্সের ঠিকা কর্মীরা, যাঁদের হাড়–চামড়া এক করে আম্বানিরা দেশের সেরা ধনকুবেরে পরিণত হয়েছেন, তাঁরা কত টাকা মাইনে পান? তাঁদের জন্য বরাদ্দ ওই ১৭৮ টাকা৷ আচ্ছা, শ্রমিকদের জন্য সরকারের এই অবিশ্বাস্য রকমের কম মাইনে ঘোষণার সাথে রিলায়েন্সদের পুঁজির পাহাড়ের কি কোনও সম্পর্ক আছে? আছে৷ বাস্তবে দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক গভীর৷ আপাতদৃষ্টিতে তা অনেকসময় চোখে পড়ে না৷
প্রথমত, যে বিজেপি সরকার শ্রমিকদের মাইনে দু’বছরে মাত্র দু’টাকা বাড়ায়, তারাই নির্বাচনে খরচ করে ২৭ হাজার কোটি টাকা, যার অঘোষিত পরিমাণ দু’লক্ষ কোটি টাকা৷ এই বিপুল পরিমাণ টাকা এল কোথা থেকে? জনগণের থেকে চাঁদা হিসাবে তো তারা নেয়নি৷ তা হলে? এল ধনকুবের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের থেকে৷ আম্বানি, আদানি, টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা, মাহিন্দ্রা প্রভৃতি দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিরাই এর জোগানদার৷ তারা কেন বিজেপিকে টাকা জোগায়? জোগায় এই কারণে যে, নির্বাচনে জিতে তাদের স্বার্থই এরা দেখবে– এটা অলিখিত চুক্তির শর্ত৷ শ্রমিকদের জন্য এই অবিশ্বাস্য কম মাইনে ঘোষণা ঠিক এই শর্তেরই অঙ্গ৷ সরকার এই ঘোষণার দ্বারা পুঁজিপতিদের বুঝিয়ে দিল তাদের যথেচ্ছ শ্রমিক শোষণে সরকার বাধা দেবে না৷ বরং সরকার তাতে সম্মতিই দিচ্ছে৷ মালিকরা তাদের ইচ্ছামতো কম মাইনে শ্রমিকদের দিতে পারে৷ নয়া উদারনীতিবাদের সমর্থক বিজেপি সরকারও মালিকদের সাথে একই মত পোষণ করে যে, শ্রমিকদের জন্য খরচকে একেবারে ন্যুনতম পরিমাণে নিয়ে গিয়েই উৎপাদন এবং বৃদ্ধিকে চাঙ্গা করা যেতে পারে, মালিকদের মুনাফা আরও বাড়তে পারে৷
ভারত একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র৷ সরকারের মন্ত্রীরা পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে৷ এই সত্যটা দেশের মানুষের থেকে, শ্রমিক–কৃষক–সাধারণ মানুষের থেকে আড়াল করতে, তাদের চোখে ধুলো দিতে শাসকরা স্লোগান তোলে সব কা সাথ, সব কা বিকাশ৷ কারণ বাস্তবে এই বিকাশে মালিকদের মুনাফা আকাশ ছুঁয়ে যায়, আর সেই মুনাফার স্রষ্টা শ্রমিকদের পরিবারে দু’বেলা পেট ভরানোর মতো অন্নটুকুও জোটে না৷
সরকারের এই মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে মন্ত্রীর আর এক ঘোষণায়৷ এতদিন শ্রমিকদের জন্য যতটুকু অধিকার, সুযোগ এবং সুবিধা ছিল সেটুকুকেও বিসর্জন দিয়ে সরকার মালিকদের হাতে এক তরফা শ্রমিক শোষণের অধিকার তুলে দিতে চলেছে৷ তাই তারা ঘোষণা করেছে শ্রম আইনের মোট ৪২টি ধারাকে ৪টিতে সংকুচিত করে আনবে৷ স্বাভাবিক ভাবেই এই সব কিছুকেই বিজেপি নেতাদের ‘কর্পোরেট ঋণ শোধ’ বলেই দেখছেন সচেতন মানুষ৷ কিন্তু শোষিত, নিপীড়িত শ্রমিক–কৃষক–সাধারণ মানুষের যে অংশটি বিজেপি নেতাদের মুখের বক্ততায় আর স্লোগানে ভুলে ভেবেছিলেন যে, এই নেতারা তাঁদের জীবনে আচ্ছে দিন নিয়ে আসবেন, এই সরকারের একের পর এক পদক্ষেপে তাঁদের সেই ভুল দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে৷ প্রতিদিন এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, শোষিত মানুষের ধর্ম যা–ই হোক, বর্ণ যা–ই হোক, তাতে মালিকদের, পুঁজিপতি শ্রেণির কিংবা তাদের রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে কাজ করা সরকারি মন্ত্রীদের চাপানো শোষণের মাত্রা, করের বোঝা, মূল্যবৃদ্ধির বোঝা এতটুকুও কমে না৷ বরং শোষিত–নিপীড়িত মানুষকে ধর্মে–বর্ণে–সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে শোষণ–নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধের শক্তিকেই দুর্বল করে দেয়৷