এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে গণদাবীতে তাঁর বিভিন্ন রচনার অংশ আমরা প্রকাশ করছি। এবার ১৯১৯-এ প্রাভদায় প্রকাশিত তাঁর একটি রচনা।
সোভিয়েত সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শিরোনামে যে বিষয়টি আছে, তা নিয়ে আমার একটা ছোট পুস্তিকা লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দৈনন্দিন কাজের চাপে এই পুস্তিকার কয়েকটি অধ্যায়ের প্রাথমিক প্রস্তুতির কাজ ছাড়া আমি কিছুই করতে পারিনি। তাই ঠিক করেছি, এই বিষয় সম্পর্কে আমার মূল ভাবনা-চিন্তার একটা সংক্ষিপ্ত সারাংশ লিখব। সন্দেহ নেই, সংক্ষিপ্ত সারাংশের অনেক অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতা আছে। অবশ্য একটা পত্রিকায় ছোট একটা প্রবন্ধ লেখা যেতেই পারে। এই প্রবন্ধ সমস্যা সম্পর্কে খানিকটা আলোকপাত করতে পারবে এবং বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্টরা যখন এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তখন এই লেখা তাঁদের আলোচনার ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে।
তত্ত্বগতভাবে কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না যে, পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যে একটা উত্তরণকালীন পর্যায় আছে। এই পর্যায় এই দুই ধরনের সমাজব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলিকে এক সূত্রে গ্রথিত না করে পারে না। এই উত্তরণকালীন পর্যায় হল, মুমূর্ষু পুঁজিবাদ ও সবে জন্ম নেওয়া সাম্যবাদের মধ্যে সংগ্রামের যুগ। অন্য কথায় বলতে গেলে, যে পুঁজিবাদ পরাজিত হয়েছে কিন্তু এখনও ধ্বংস হয়নি, তার সাথে যে সাম্যবাদ জন্ম নিয়েছে কিন্তু এখনও দুর্বল– এই দুইয়ের মধ্যে সংগ্রাম।
শুধু মাক্সর্বাদীরাই নন, বিকাশের তত্ত্ব সম্পর্কে কম-বেশি পরিচয় আছে, এমন সমস্ত শিক্ষিত মানুষই জানেন, এই জন্য উত্তরণকালীন পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন একটা সমগ্র যুগের প্রয়োজন রয়েছে। তবুও সমাজতন্ত্রে উত্তরণ প্রসঙ্গে যে সমস্ত কথা আমরা বর্তমান দিনের পেটি বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রতিনিধিদের মুখে শুনতে পাই তা এই নিশ্চিত সত্যের একেবারে সম্পূর্ণ বিপরীত। আবছা আবছা সমাজতন্ত্রের ছাপ থাকলেও, এরা সবাই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিনিধি। এদের মধ্যে আরও আছেন ম্যাকডোনাল্ড, জাঁ লঙ্গউয়েট, কাউটস্কি এবং ফ্রেডরিক অ্যাডলার।
পেটিবুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের বিশেষত্ব হল, তাঁরা শ্রেণি সংগ্রামকে একেবারে সহ্য করতে পারেন না। তাঁরা আশা করেন শ্রেণি সংগ্রাম ছাড়াই তাঁরা কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন। তাঁরা আপস মীমাংসার মসৃণ পথ ধরে হাঁটবেন এবং শ্রেণি সংগ্রামের কষ্টকঠিন পথ এড়িয়ে চলবেন। তাই এই ধরনের গণতন্ত্রের পূজারীরা পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের জন্য একটা সমগ্র ঐতিহাসিক যুগের প্রয়োজনীয়তার কথা হয় এড়িয়ে চলেন, আর না হয় এক শ্রেণির সাথে আর এক শ্রেণির সংগ্রামের পরিবর্তে এই দুই বিরোধী শ্রেণির মধ্যে আপস মীমাংসার পথ খোঁজার কাজকেই নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করেন।
আমাদের দেশ রাশিয়া একটা খুবই পশ্চাদপদ দেশ। এর চরিত্র হল পেটি বুর্জোয়া। এই কারণে, এই দেশের সর্বহারা একনায়কত্বের চরিত্র বৈশিষ্ট্য উন্নত দেশগুলোর তুলনায় খানিকটা আলাদা হবে। কিন্তু মূল শ্রেণিসমূহ ও মূল সামাজিক উৎপাদনের রূপ, অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশেও যা, রাশিয়াতেও তাই। এই কারণে, এই সব বিশেষ বৈশিষ্ট্য মূল বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারবে না।
এই সব মূল সামাজিক উৎপাদনের রূপ হল পুঁজিবাদ, ক্ষুদ্রপণ্য উৎপাদন এবং সাম্যবাদ। মূল শ্রেণিগুলো হল বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া (বিশেষ করে কৃষক সম্প্রদায়) এবং সর্বহারা শ্রেণি।
সর্বহারা একনায়কত্বের যুগে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হল শ্রমের যৌথতার প্রাথমিক রূপের সাথে পুঁজিবাদ ও ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদনের মধ্যে সংগ্রাম। শ্রমের এই যৌথতা কাজ করছে বিশাল রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে। আর পুঁজিবাদ টিকে আছে এবং শক্তি সঞ্চয় করছে ক্ষুদ্রপণ্য উৎপাদনের মধ্য দিয়ে।
রাশিয়ায় শ্রম যৌথতার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ। কারণ, প্রথমত উৎপাদন উপকরণের উপর ব্যক্তি মালিকানা অবলুপ্ত। এবং দ্বিতীয়ত সর্বহারা রাষ্ট্র সারা দেশ জুড়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমি ও কলকারখানায় বৃহদায়তন উৎপাদনকে সংগঠিত করছে, উৎপাদনের বিভিন্ন শাখায় শ্রমশক্তি বণ্টন করছে এবং বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভোগ্যপণ্য শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বণ্টন করছে।
আমরা রাশিয়ায় ‘প্রথম স্তরের সাম্যবাদের’ কথা বলি (১৯১৯ সালের মার্চে গৃহীত পার্টি কর্মসূচিতেও আমরা এইভাবে বলেছি)। কারণ রাশিয়ায় আমরা এই সব বিষয় আংশিকভাবে অর্জন করতে পেরেছি বা অন্য ভাবে বলতে গেলে, এই সব বিষয়ে আমাদের সাফল্য প্রাথমিক স্তরের। বিপ্লবের একটা আঘাতে তৎক্ষণাৎ যা করা যায়, সাধারণভাবে আমরা তা করেছি। যেমন, সর্বহারা একনায়কত্বের প্রথম দিন, ৮ নভেম্বর, ১৯১৭ সালে, বৃহৎ ভূস্বামীদের জমি আমরা বিনা ক্ষতিপূরণে কেড়ে নিয়েছি। কয়েক মাসের মধ্যেই আমরা সমস্ত বড় পুঁজিপতিদের কল-কারখানা, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, ব্যাঙ্ক, রেল এবং এই ধরনের নানা জিনিসের মালিকদের সম্পত্তি আমরা বিনা ক্ষতিপূরণে কেড়ে নিয়েছি। শিল্পে বৃহদায়তন উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সংগঠন এবং মিল, কলকারখানা, রেল পরিবহণে ‘শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ’ থেকে ‘শ্রমিকের প্রশাসন’- এ উত্তরণ– এই কাজ মূলত আমরা সম্পাদন করেছি। কিন্তু কৃষির ক্ষেত্রে এই কাজ আমরা সবে শুরু করেছি (শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্রের মালিকানাধীন জমিতে বৃহদায়তন রাষ্ট্রীয় খামার)। একইভাবে, কৃষিতে ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদন থেকে যৌথ কৃষিতে উত্তরণের জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট সমবায় সংগঠন গড়ে তুলতে শুরু করেছি। একইভাবে বলা যায়, ব্যক্তি ব্যবসার জায়গায় আমরা দ্রব্য বণ্টনের রাষ্ট্রীয় সংগঠন গড়ে তুলছি। অর্থাৎ, শহরে শস্য এবং গ্রামাঞ্চলে শিল্পদ্রব্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা রাষ্ট্রীয় সংগ্রহ ও বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তুলছি।
কৃষি উৎপাদন এখনও ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদন। এখানেই পুঁজিবাদের বিস্তৃত, ব্যাপক ভিত্তি অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। এই ভিত্তির উপর পুঁজিবাদ দাঁড়িয়ে আছে, শক্তি সঞ্চয় করছে, এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই পুঁজিবাদ সাম্যবাদের বিরুদ্ধে তিক্ত সংগ্রাম পরিচালনা করছে। এই সংগ্রামের রূপ হল রাষ্ট্রীয় সংগ্রহ ও সাধারণভাবে দ্রব্যের রাষ্ট্রীয় বণ্টন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য ও মুনাফা করা।
(এর পর লেনিন রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাষ্ট্রের ফসল সংগ্রহের পরিমাণ কিভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তার পরিসংখ্যান পেশ করেছেন।)
শ্রমজীবী মানুষ যুগ যুগ ধরে চলে আসা ভূস্বামী ও পুঁজিপতিদের শোষণ নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। স্বাধীনতা ও সাম্যের দিকে এ হল যথার্থ পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ গুণের দিক থেকে, চরিত্রের দিক থেকে, বিস্তৃতি ও দ্রুততার দিক থেকে দুনিয়ায় অতুলনীয়। যারা স্বাধীনতা ও সাম্যের কথা বলে সেই বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়াদের অনুগামীরা একে এতদিন অবহেলা করে এসেছে। অবশ্য স্বাধীনতা ও সাম্য বলতে এরা বোঝে বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্র। এরা একে সাধারণভাবে বলে ‘গণতন্ত্র’ বা ‘খাঁটি গণতন্ত্র’– যা মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়।
কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের দরকার যথার্থ সাম্য, যথার্থ স্বাধীনতা (ভূস্বামী ও পুঁজিপতিদের হাত থেকে মুক্তি)। এই কারণে তারা দৃঢ়চিত্তে সোভিয়েট রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে।
কৃষক প্রধান এই দেশে কৃষকরাই সর্বহারা একনায়কত্ব থেকে সবচেয়ে প্রথম, সবচেয়ে দ্রুত, সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। ভূস্বামী ও পুঁজিপতিদের অধীনে কৃষকরা অনাহারে থাকত। আমাদের দেশে শত শত বছর ধরে কৃষকরা কখনও নিজেদের জন্য কাজ করেনি। তারা অনাহারে থেকেছে। আবার শত শত কোটি পুদ (ওজন পরিমাপের রুশ একক) শস্য পুঁজিপতিদের হাতে, শহরে এবং বিদেশে রপ্তানির জন্য দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। সর্বহারা একনায়কত্বের অধীনে এই প্রথম কৃষকরা নিজেদের জন্য কাজ করছে এবং শহরবাসীর তুলনায় বেশি খাবার পাচ্ছে। এই প্রথম কৃষকরা যথার্থ স্বাধীনতা কী তা অনুভব করতে পারছে। এই প্রথম তারা নিজেদের রুটি খাওয়ার স্বাধীনতা পেয়েছে, অনাহার থেকে মুক্তি পেয়েছে।
আমরা জানি জমি বণ্টনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পরিমাণে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খাওয়ার লোকের অনুপাতে কৃষকরা জমি ভাগ করে নিয়েছে।
সমাজতন্ত্রের অর্থ হল শ্রেণি অবলুপ্তি।
শ্রেণি অবলুপ্তির জন্য প্রথমেই দরকার ভূস্বামী ও পুঁজিপতিদের উচ্ছেদ করা। করণীয় কর্তব্যের এই অংশটা আমরা করেছি। কিন্তু তা একটা অংশ মাত্র। এবং তা ছাড়াও এই কাজটা করা খুব কঠিন নয়। দ্বিতীয়ত, শ্রেণি অবলুপ্তির জন্য যা করা দরকার তা হল শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে পার্থক্য দুর করা, সবাইকে শ্রমিকে পরিণত করা। এই কাজ এক ধাক্কায় করা যায় না। তুলনামূলকভাবে এই কাজ আরও কঠিন এবং বাস্তবে এই কাজ করতে বহুদিন লেগে যাবে। একটা শ্রেণিকে উৎখাত করে এই কাজ করা যাবে না। সমগ্র সমাজের অর্থনীতির সাংগঠনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত, অসংগঠিত ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থাকে বৃহৎ সামাজিক উৎপাদন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেই এই কাজ করা যেতে পারে। এই উত্তরণের জন্য অনেক দিন দরকার। তাড়াহুড়ো করে অসতর্ক প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিলে এই উত্তরণের কাজে দেরি হবে এবং তাতে জটিলতার সৃষ্টি হবে। কৃষকদের এমন ধরনের সাহায্য করা দরকার যাতে তারা কৃষির সমস্ত প্রযুক্তিকে প্রভূত উন্নত করতে পারে, মৌলিকভাবে তার সংস্কার সাধন করতে পারে। এই ভাবেই কেবলমাত্র উত্তরণকে দ্রুততর করা যায়।
সমস্যার এই দ্বিতীয় ও সবচেয়ে কঠিন অংশটি সমাধান করার জন্য, বুর্জোয়াদের পরাজিত করার পর, সর্বহারা শ্রেণিকে দ্বিধাহীন চিত্তে কৃষকদের প্রতি তার কর্মনীতি নিম্নোক্ত মৌলিক পথে পরিচালনা করতে হবে।
সর্বহারা শ্রেণির কাজ হবে মালিক কৃষক থেকে শ্রমজীবী কৃষকদের পৃথক করা, যে কৃষক শ্রম দেয় আর যে কৃষক মুনাফা লোটে, সেই শোষক কৃষক থেকে শ্রমজীবী কৃষকদের পৃথক করা।
এই পৃথকীকরণের মধ্যেই রয়েছে সমাজতন্ত্রের সমগ্র মর্মবস্তু।
যারা সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ায়, কিন্তু কাজে বুর্জোয়া গণতন্ত্রী (মার্তভপন্থী, চার্নভপন্থী, কাউটস্কিপন্থী ইত্যাদি) তারা সমাজতন্ত্রের এই মর্মবস্তু বোঝে না। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
যে পৃথকীকরণের কথা আমরা এখানে বললাম, তা করা খুব কঠিন। কারণ বাস্তব জীবনে, যতই পৃথক হোক, যতই বিরোধী হোক, কৃষকদের সমস্ত বৈশিষ্ট্য একে অপরের সাথে মিলে মিশে আছে। তা হলেও, পৃথকীকরণ সম্ভব। শুধু সম্ভব বললে চলবে না, কৃষি অর্থনীতি ও কৃষক জীবন থেকে এটা অবশ্যম্ভাবী রূপে ঘটবে। শ্রমজীবী কৃষকরা যুগ যুগ ধরে ভূস্বামী, পুঁজিপতি, শোষক ও মুনাফাখোর এবং তাদের রাষ্ট্রের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে। এমনকি, সবচেয়ে গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রেও এই নির্যাতন চলছে। যুগ যুগ ধরে এই শ্রমজীবী কৃষকরা শোষক নির্যাতকদের সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে, তাদের শত্রু মনে করে। তাদের জীবনের বাস্তব পরিস্থিতি থেকেই এই মনোভাবের জন্ম হয়েছে। এর ফলে তারা পুঁজিপতি, মুনাফাখোর ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হচ্ছে। আবার সাথে সাথে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য, পণ্য উৎপাদনের জন্য এই কৃষকরা শোষক ও মুনাফাখোরে পরিণত হচ্ছে। (সব ক্ষেত্রে হচ্ছে তা নয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হচ্ছে।)
আমরা সংবিধান সভা ভেঙে দিয়েছি। আমরা উদ্বৃত্ত শস্য জোর করে কেড়ে নেওয়া সহ এই ধরনের নানা কাজ করেছি। আমাদের সংবিধানে শ্রমিক ও কৃষকের মধ্যে পার্থক্য আছে। এই সব দেখিয়ে ওরা তারস্বরে বলে, তোমরা গণতন্ত্র, সাম্য ও স্বাধীনতাকে ধ্বংস করেছ। জবাবে আমরা বলি, শত শত বছর ধরে শ্রমজীবী কৃষকরা যে প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সেই প্রকৃত অসাম্য দূর করার জন্য দুনিয়াতে কোনও দিন কোনও রাষ্ট্র এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। শোষক ও শোষিতের, অনাহারক্লিষ্ট ও ভরপেট খাওয়া মানুষের সাম্য আমরা কখনই স্বীকার করি না, স্বীকার করি না একের দ্বারা অপরের লুট করার স্বাধীনতা। যে সব শিক্ষিত মানুষ এই পার্থক্য স্বীকার করতে চায় না, তারা নিজেদের গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী, কাউটস্কিপন্থী, চার্নভ ও মার্তভপন্থী বললেও আমরা তাদের সাথে হোয়াইট গার্ডের মতো ব্যবহার করি।
সমাজতন্ত্রের অর্থ হল শ্রেণি অবলুপ্তি। শ্রেণি অবলুপ্তির জন্য সর্বহারা একনায়কত্ব যা করার তা করছে। কিন্ত এক ধাক্কায় শ্রেণি অবলুপ্তি ঘটানো যায় না। সর্বহারা একনায়কত্বের যুগে শ্রেণি বিভক্তি আছে এবং শ্রেণি বিভক্তি থাকবে। যখন শ্রেণি বিভক্তি থাকবে না, তখন সর্বহারা একনায়কত্বের প্রয়োজনও থাকবে না। সর্বহারা একনায়কত্ব ছাড়া শ্রেণি অবলুপ্তি ঘটবে না।
শ্রেণি থাকবে, কিন্তু সর্বহারা একনায়কত্বে সমস্ত শ্রেণির ও শ্রেণি সম্পর্কের পরিবর্তন হবে। সর্বহারা একনায়কত্বে শ্রেণি সংগ্রামের অবসান হবে না, তার রূপ হবে আলাদা।
পুঁজিবাদে সর্বহারা শ্রেণি, নিপীড়িত শ্রেণি, উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা থেকে বঞ্চিত। এই শ্রেণিই একমাত্র শ্রেণি যে পুঁজিবাদের সরাসরি ও সর্বাত্মক বিরোধিতা করে এবং এই কারণে তার পক্ষেই সম্ভব শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী হিসাবে ভূমিকা পালন করা। বুর্জোয়াদের উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর, এই সর্বহারা শ্রেণি শাসক শ্রেণিতে পরিণত হয়, তার হাতেই চলে যায় রাষ্ট্রক্ষমতা, তার হাতেই চলে যায় উৎপাদন উপকরণ। এই উৎপাদন উপকরণের চরিত্র হয়ে যায় সামাজিক। মধ্যবর্তী দোদুল্যমান শ্রেণি ও লোকজনদের সে নেতৃত্ব দেয়। সে শোষকদের ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের শক্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে। শ্রেণি সংগ্রামের এই হল সুনির্দিষ্ট কর্তব্য। এ এমন কর্তব্য যা সর্বহারা শ্রেণি আগে করেনি বা করতেও পারত না।
সর্বহারা একনায়কত্বে শোষক শ্রেণি, ভূস্বামী ও পুঁজিপতি শ্রেণি অবলুপ্ত হয়নি, এক মুহূর্তে তা অবলুপ্ত হতেও পারে না। শোষকেরা ধ্বংস হয়েছে কিন্তু অবলুপ্ত হয়নি। আন্ত়র্জাতিক পুঁজি হিসাবে তার আন্তর্জাতিক ভিত্তি আছে। রাশিয়ার পুঁজি এই আন্তর্জাতিক পুঁজির শাখা। উৎপাদন উপকরণের একটা অংশ এখনও তাদের দখলে, তাদের এখনও অর্থবল আছে, আছে বিস্তৃত সামাজিক যোগাযোগ। যেহেতু তারা পরাজিত হয়েছে, তাই তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা শত গুণ, হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে, অনেক এগিয়ে। তাই তারা সংখ্যায় কম হলেও তাদের গুরুত্ব অনেক বেশি। উৎখাত হয়ে যাওয়া শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিতদের বিজয়ী অগ্রগামী অংশ অর্থাৎ সর্বহারাদের শ্রেণি সংগ্রাম তাই অনেক বেশি তিক্ত। বিপ্লবের ক্ষেত্রে এ ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। যদি এই ধারণাকে কেউ সংস্কারবাদী চিন্তার দ্বারা প্রতিস্থাপিত না করে (যেমনভাবে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বীরেরা করেছেন)।
সবশেষে, সাধারণভাবে পেটি বুর্জোয়াদের মতো কৃষকরাও সর্বহারা একনায়কত্বেও মাঝপথে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে, এরা সংখ্যায় অনেক (পশ্চাদপদ রাশিয়ায় এরা সংখ্যায় বিশাল)। শ্রমজীবী এই কৃষকরা ভূস্বামী ও পুঁজিপতিদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অভিন্ন লক্ষে্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে আছে। অপর দিকে এরা বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট সম্পত্তির মালিক ও ব্যবসায়ী। এই ধরনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রেণির মধ্যে দোদুল্যমানতার জন্ম দেবেই। এই বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রেণির মধ্যে সংগ্রাম তীক্ষ রূপ ধারণ করার ফলে, তাদের মধ্যে সমস্ত সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে, পুরনো অচলায়তনের সাথে কৃষক ও পেটি বুর্জোয়াদের দীর্ঘদিনের সংযোগের ফলে আমরা দেখতে পাব এরা একবার এ দিকে যাচ্ছে আর একবার ও দিকে যাচ্ছে, দেখতে পাবো ওরা দোদুল্যমান, অনিশ্চিত, অস্থায়ী।
এই শ্রেণি বা এই সমস্ত সামাজিক স্তর সম্পর্কে সর্বহারা শ্রেণির কর্তব্য হল এদের পরিচালনা করা, এদের উপর প্রভাব সৃষ্টি করা। যারা দোদুল্যমান, যারা অস্থিরমতি– সর্বহারা শ্রেণির কর্তব্য হল তাদের পরিচালনা করা।
সর্বহারা একনায়কত্ব যেভাবে বিভিন্ন শ্রেণি ও শক্তিগুলোকে এবং তাদের আন্তঃসম্পর্ককে খানিকটা পরিবর্তিত করে নিয়েছে তা যদি আমরা তুলনা করি, তা হলে আমরা বুঝতে পারব– সাধারণভাবে ‘গণতন্ত্রের দ্বারাই’ সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব, এই ধারণা কতটা অর্থহীন এবং তত্ত্বগতভাবে ভিত্তিহীন। বুর্জোয়াদের চূড়ান্ত শ্রেণিহীন গণতন্ত্রের কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা থেকেই মূলগতভাবে এই ভ্রান্ত ধারণার উৎপত্তি। বাস্তবে, সর্বহারা একনায়কত্বে গণতন্ত্র নিজেই একটা নতুন স্তরে প্রবেশ করেছে, শ্রেণিসংগ্রাম উন্নত স্তরে পৌঁছেছে এবং সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রাধান্য বিস্তার করেছে।
স্বাধীনতা, সাম্য ও গণতন্ত্র সম্পর্কে সাধারণভাবে কথা বলার অর্থ হল পণ্য উৎপাদন সম্পর্কের মধ্য থেকে উদ্ভূত ধারণার গতানুগতিক পুনরাবৃত্তি। এই ধরনের সাধারণ ধারণার দ্বারা সর্বহারা একনায়কত্বের সুনির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান করার চেষ্টার অর্থ হল বুর্জোয়াদের তত্ত্ব ও নীতিকে গ্রহণ করা। সর্বহারার দৃষ্টিতে এই প্রশ্নকে এই ভাবে দেখা যেতে পারেঃ কোন শ্রেণির নির্যাতন থেকে স্বাধীনতা? কোন শ্রেণিগুলোর মধ্যে সাম্য? ব্যক্তিসম্পত্তির ভিত্তিতে গণতন্ত্র, না ব্যক্তি সম্পত্তি অবলুপ্তির সংগ্রামের ভিত্তিতে গণতন্ত্র? ইত্যাদি, ইত্যাদি। অনেক দিন আগে এঙ্গেলস তাঁর ‘অ্যান্টি ডুরিং’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেনঃ পণ্য উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেই উদ্ভূত হয়েছে সাম্যের ধারণা। এ কুসংস্কারে পরিণত হবে যদি তা শ্রেণি অবলুপ্তির প্রেক্ষিতে না বোঝা হয়। সাম্য সম্পর্কে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ধারণার পার্থক্যের এই প্রাথমিক বিষয়টা নিয়তই ভুলে যাওয়া হয়। যদি এটা ভুলে যাওয়া না হয়, তা হলে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাব, বুর্জোয়াদের ক্ষমতাচ্যুত করে সর্বহারা শ্রেণি, শ্রেণিঅবলুপ্তির পথে একটা সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এবং এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য সর্বহারাকে শ্রেণি সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। চালিয়ে যেতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে, সংগ্রামের সমস্ত পদ্ধতি ব্যবহার করে। এর দ্বারা উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া বুর্জোয়া ও দোদুল্যমান পেটি বুর্জোয়াদের উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে যেতে হবে।