Breaking News

সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতি রূপায়ণে আরও একধাপ এগোল রাজ্য সরকার

ইউজিসি–র নির্দেশ মেনে রাজ্যের উচ্চশিক্ষার পাঠক্রম প্রসঙ্গে রাজ্য শিক্ষা দপ্তর সম্প্রতি এক নির্দেশিকার মাধ্যমে ঘোষণা করেছে এখন থেকে স্নাতক ডিগ্রি কোর্সের পাঠক্রম হবে চার বছরের৷ নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, এই কোর্সের প্রথম বছরের পরই থাকবে ‘মাল্টিপল এন্ট্রি ও এক্সিট’–এর সুবিধা৷ অর্থাৎ ভর্তির প্রথম বছর সম্পূর্ণ করার পর দ্বিতীয় বছর চাইলে একজন ছাত্র অন্য কোনও কলেজে ভর্তি হতে পারবে৷ এমনকি বিভিন্ন কলেজ থেকে বিভিন্ন বছরে প্রাপ্ত নম্বর ক্রেডিট আকারে ব্যাঙ্কে সঞ্চিত করে চার বছর পর মোট ক্রেডিট অর্জন করা যাবে৷ এই পদ্ধতিতে ইচ্ছে করলে সাত বছর সময় নিয়ে একজন স্নাতক হতে পারেন৷ এই ভাবে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের দ্বারা পরিচালিত ইউজিসি নির্ধারিত স্নাতক স্তরের ‘কারিকুলাম অ্যান্ড ক্রেডিট ফ্রেমওয়ার্ক’ এই রাজ্যে চালু করছে৷ আসলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতিতেই এই নির্দেশিকা রয়েছে, যা তৃণমূল সরকার এ রাজ্যে বাস্তবায়িত করছে৷

এ বারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকেই চার বছরের কোর্স কার্যকর করতে চলেছে রাজ্য শিক্ষা দপ্তর৷ যা এ রাজ্যের শিক্ষাপ্রেমী জনসাধারণকে খুবই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে৷ আসলে রাজ্য সরকারের এই ঘোষণা ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা ব্যবসায়ীদের শিক্ষা বাজারের ক্রেতায় পরিণত করার এক সামগ্রিক পরিকল্পনার অঙ্গ৷ নতুন ব্যবস্থায় তিন বছরের ডিগ্রি কোর্সকে চার বছরের কোর্সে পরিণত করে ছাত্রছাত্রীদের উপর অতিরিক্ত এক বছরের বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হবে৷ উচ্চশিক্ষা আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে, যা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে বহন করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে৷ বাড়বে ড্রপ আউট৷

‘মাল্টিপল এন্ট্রি অ্যান্ড এক্সিট’ পদ্ধতিতে একজন ছাত্র বা ছাত্রী প্রথম বর্ষের দুটি সেমেস্টারের পর পড় ছেড়ে দিলে সার্টিফিকেট ডিগ্রি, দ্বিতীয় বর্ষের চারটি সেমেস্টারের পরে ছাড়লে ডিপ্লোমা, তৃতীয় বর্ষের ছয়টি সেমেস্টারের পরে সাধারণ স্নাতক ডিগ্রি ও চতুর্থ বর্ষের আটটি সেমেস্টারের পরে রিসার্চ অনার্স ডিগ্রি পাবে৷ কিন্তু আর্থিক কারণ সহ যে কারণগুলির জন্য একজন ছাত্র বা ছাত্রী মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, এই প্রক্রিয়ায় সেই সমস্যা সমাধানের কোনও পদক্ষেপের কথা না বলে বাস্তবে ড্রপ আউটকেই বৈধতা দেওয়া হয়েছে৷ প্রথম বর্ষের পর আরও অন্য একাধিক কলেজে ভর্তির সুযোগের মাধ্যমে একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে একাধিক শিক্ষা ব্যবসায়ীর ক্রেতায় পরিণত করতে চাইছে সরকার৷ এইভাবে সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থাটাই পরিচালিত হবে মুনাফার উদ্দেশ্যে৷ এই প্রক্রিয়ায় পছন্দমতো কলেজ পরিবর্তনের চটকদারি স্লোগান আসলে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের ডিগ্রি কেনাবেচার পেছনে ছুটে চলা৷ শুধু তাই নয়, স্বাধীন ভাবে যে কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তনের কথা বলা হলেও তার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই৷ নিম্ন গ্রেড বা মানের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পড়ে উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে যেতে চাইলে তারা দরজা যে খুলবে না তা যে কেউ বুঝবেন৷ ধরুন কেউ ফার্স্ট ইয়ারে গ্রামীণ কোনও ছোট কলেজে পড়ে সেকেন্ড ইয়ারে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে চাইলে সে কি সুযোগ পাবে? তার জন্য ছাত্রদের লাইন দিতে হবে বেসরকারি, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে৷

প্রতি বছর পছন্দমতো বিষয় পরিবর্তনের পোশাকি নাম ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি সিস্টেম’, অর্থাৎ বিষয় নির্বাচনের বিজ্ঞানভিত্তিক শৃঙ্খলাকে ধ্বংস করে কোনও ডিসিপ্লিন না মেনে যা কিছু বিষয় নিয়েই হোক ক্রেডিট সংগ্রহ করে নেওয়া৷ পদার্থবিদ্যা নিয়ে অনার্স পড়তে গিয়ে গণিত, রসায়ন যা ছিল এত দিন বাধ্যতামূলক, এখন আর তা না পড়লেও চলবে৷ পদার্থবিদ্যার সঙ্গে ফ্যাশন টেকনোলজি কিংবা মেরিন সায়েন্স বা অন্য কোনও বিষয় নিয়ে ক্রেডিট অর্জন করতে পারলেই হল৷ স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্রছাত্রীরা তখন অনার্সের বিষয়টিকে ভালো করে শেখার জন্য সহযোগী কোন বিষয় দরকার তা না ভেবে খুঁজবে কিসে বেশি নম্বর পাওয়া যায়৷ ফলে তারা শেখার ক্ষেত্রে কোনও শৃঙ্খলা মানার দরকারই অনুভব করবে না৷ এই পদ্ধতিতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার মান সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে, কলেজগুলি পরিণত হবে পরিকাঠামোহীন, ডিগ্রি কেনাবেচার জায়গায়৷ এইভাবে সমস্ত সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো ধ্বংস করা হবে, নয়ত তুলে দেওয়া হবে পুঁজিমালিকদের হাতে৷

কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সর্বনাশা শিক্ষা পরিকল্পনাকেই এ ভাবে রাজ্যে কার্যকর করছে তৃণমূল সরকার৷ তা হলে এই যে তৃণমূল সরকারের এত কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের বিরোধিতা, এমন একটি মারাত্মক, জনস্বার্থ বিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সেই বিরোধিতা কোথায়? বাস্তবে তৃণমূলের বিজেপি বিরোধিতার মধ্যে কোনও নীতিগত বিরোধ নেই৷ সবটাই সংসদীয় বিরোধিতা, ভোটের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার ততটুকুই৷ শ্রেণিগত ভাবে এই বিরোধিতার মূল্য শোষিত, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে নেই৷ এই বিরোধিতা দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে রুখতে পারবে না, বাস্তবে সে চায়ও না৷ তার লক্ষ্য  বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের গণতান্ত্রিক ভাবনাকে ভোটের স্বার্থে কাজে লাগানো৷ এই অবস্থায় বিজেপি এবং তৃণমূল উভয় সরকারের এই সর্বনাশা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষক অধ্যাপক অভিভাবক সহ সচেতন নাগরিকদেরই এগিয়ে আসতে হবে৷ সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটি ইতিমধ্যেই এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে৷ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে এই শিক্ষা নীতি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে৷ তেমনই এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছে ছাত্রসংগঠন এআইডিএসও৷ সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ২০ মার্চ জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শিক্ষাস্বার্থবিরোধী কালা সার্কুলার পুড়িয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়েছে৷