এ বছরটি বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও রুশ বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিনের মৃত্যুশতবর্ষ। এই উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে বর্ষব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অঙ্গ হিসাবে ভি আই লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। অনুবাদ সংক্রান্ত যে কোনও মতামত সাদরে গৃহীত হবে। এ বার দ্বাদশ কিস্তি।
‘‘কমিউন আর যথার্থ অর্থে রাষ্ট্র ছিল না’’
বেবেলকে লেখা চিঠি
রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্ক্স ও এঙ্গেলসের রচনাসম্ভারের মধ্যে সর্বাপেক্ষা না হলেও অন্যতম উল্লেখযোগ্য মন্তব্য রয়েছে ১৮৭৫ সালের ১৮-২৮ মার্চ, বেবেলকে লেখা এঙ্গেলসের চিঠির নিচের অনুচ্ছেদে। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, যতদূর আমরা জানি এই চিঠি বেবেল ১৯১১ সালে তাঁর স্মৃতিকথায় (‘আমার জীবন’) সর্বপ্রথম প্রকাশ করেন, অর্থাৎ চিঠিটি লেখার ও ডাকে দেওয়ার ৩৬ বছর পরে।
ব্র্যাকেকে লেখা বিখ্যাত চিঠিতে মার্ক্স গোথা কর্মসূচির যে খসড়ার সমালোচনা করেছিলেন, এঙ্গেলসও সেই খসড়ারই সমালোচনা করে বেবেলকে চিঠি লিখেছিলেন। রাষ্ট্রের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করে এঙ্গেলস বলেছিলেনঃ
‘‘মুক্ত জনগণের রাষ্ট্র রূপান্তরিত হয়েছে মুক্ত রাষ্ট্রের। ব্যাকরণগত অর্থ অনুযায়ী, স্বাধীন রাষ্ট্র হল এমন যেখানে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিষয়ে স্বাধীন, অর্থাৎ যে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী সরকার আছে। বিশেষ করে কমিউনের পর থেকে, যথার্থ অর্থে যা আর রাষ্ট্র ছিল না, রাষ্ট্র সম্পর্কে সমস্ত আলোচনা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। নৈরাজ্যবাদীরা ‘গণরাষ্ট্রকে’ আমাদের মুখের উপর ছুঁড়ে মেরেছে।যদিও প্রুধোঁর বিরুদ্ধে মার্ক্সের বই এবং পরে ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-তে ইতিমধ্যে সরাসরি ঘোষণা করা হয়েছে যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের পর থেকে রাষ্ট্র আপনা থেকেই ভেঙে পড়বে এবং বিলুপ্ত হয়ে যাবে। রাষ্ট্র যেহেতু কেবলমাত্র একটি উত্তরণকালীন প্রতিষ্ঠান, প্রতিপক্ষকে বল প্রয়োগে দমন করার জন্য যাকে ব্যবহার করা হচ্ছে সংগ্রামে, বিপ্লবে, তাই মুক্ত জনগণের রাষ্ট্রের কথা বলা নিছক অর্থহীনঃ সর্বহারা শ্রেণি যতদিন রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে, সে তা করে প্রতিপক্ষকে দমন করতে, স্বাধীনতার স্বার্থে নয়। এবং যখনই স্বাধীনতার কথা বলা সম্ভব হয়, তখনই রাষ্ট্র হিসেবে রাষ্ট্রের আর অস্তিত্ব থাকে না। তাই আমরা প্রস্তাব করছি, সর্বত্র ‘রাষ্ট্র’-এর বদলে ‘গেমেইনওয়েসেন’ (কমিউনিটি) শব্দটি ব্যবহার করা হোক। এই শব্দটি চমৎকার একটি পুরনো জার্মান শব্দ, যেটা ফরাসি শব্দ ‘কমিউন’-এর বদলে খুব ভালো ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।’’ (পৃষ্ঠা ৩২১-২২, মূল জার্মান সংস্করণ)
মনে রাখতে হবে, চিঠিটি যে পার্টি কর্মসূচি নিয়ে, এই চিঠির মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরের এক চিঠিতে মার্ক্স (চিঠির তারিখ, ৫ মার্চ, ১৮৭৫) সেই কর্মসূচিরই সমালোচনা করেছিলেন।ওই সময়ে এঙ্গেলস মার্ক্সের সাথে লন্ডনে থাকতেন। তাই, শেষের বাক্যে ‘আমরা’ বলতে তখন এঙ্গেলস নিঃসন্দেহে নিজের ও মার্ক্সের পক্ষ থেকে জার্মান শ্রমিক পার্টির নেতার কাছে কর্মসূচি থেকে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘কমিউনিটি’ বসানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
কর্মসূচির এই ধরনের অদল বদলের প্রস্তাব করা হলে সুবিধাবাদীদের স্বার্থে কারচুপি-করা আজকের দিনের ‘মার্ক্সবাদে’র পাণ্ডারা ‘নৈরাজ্যবাদ’ নিয়ে কী শোরগোলই না তুলত!
করুক ওরা হইচই। বুর্জোয়ারা এর জন্য তাদের প্রশংসা করবে।আমরা কিন্তু আমাদের কাজ করে যাব। পার্টির কর্মসূচি পরিমার্জন করার সময় মার্ক্স ও এঙ্গেলসের পরামর্শ আমাদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে যাতে সত্যের আরও কাছাকাছি পৌঁছনো যায়, বিকৃতির হাত থেকে মুক্ত করে মার্ক্সবাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা যায়, যাতে আরও সঠিকভাবে আমরা শ্রমিক শ্রেণির মুক্তিসংগ্রামের দিকনির্দেশ দিতে পারি। বলশেভিকদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যিনি এঙ্গেলস ও মার্ক্সের পরামর্শের বিরোধী।একমাত্র অসুবিধা হয়ত দেখা দিতে পারে পরিভাষা নিয়ে। জার্মান ভাষায় ‘কমিউনিটি’ বোঝায় এমন দুটো শব্দ আছে।এর মধ্যে এঙ্গেলস যেটি ব্যবহার করেছেন তা কোনও একটি কমিউনিটিকে বোঝায় না, সামগ্রিকভাবে কমিউনিটি ব্যবস্থাকে বোঝায়।রুশ ভাষায় এমন কোনও শব্দ নেই এবং আমাদের হয়ত ফরাসি ‘কমিউন’ শব্দটিকে বেছে নিতে হবে, যদিও সেটিরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।
‘‘কমিউন আর যথার্থ অর্থে রাষ্ট্র ছিল না’’– তত্ত্বের দিক থেকে এই হল এঙ্গেলসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উক্তি। আগে যা বলা হয়েছে, তারপরে এই উক্তির অর্থ সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে পারা যায়। কমিউনকে যেহেতু জনসাধারণের অধিকাংশকে নয়, সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশকে (শোষকদের) দমন করতে হয়েছিল, সেই অর্থে কমিউনের রাষ্ট্রসত্তা লোপ পাচ্ছিল। বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করেছিল কমিউন। একটা বিশেষ দমনকারী শক্তির বদলে খোদ জনসাধারণই কার্যক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছিল। রাষ্ট্রের যথার্থ অর্থ থেকে এই সবকিছুই আলাদা।কমিউন যদি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারত, এর মধ্যে থাকা রাষ্ট্রের সমস্ত চিহ্নই আপনা থেকেই ক্রমশ ক্ষয় পেতে পেতে বিলুপ্ত হয়ে যেত। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলিকে উচ্ছেদ করার প্রয়োজন হত না– যে অনুপাতে তাদের করার কিছু থাকত না, সেই অনুপাতে তারা কাজ করাও বন্ধ করে দিত।
‘‘নৈরাজ্যবাদীরা ‘জনগণের রাষ্ট্রকে’ আমাদের মুখের উপর ছুঁড়ে মেরেছে।’’ এই কথা বলার সময়ে এঙ্গেলসের মনে ছিল বিশেষভাবে বাকুনিন ও জার্মান সোসাল ডেমোক্র্যাটদের উপর তাঁর (বাকুনিনের) আক্রমণের কথা। এই আক্রমণকে এঙ্গেলস ততদূর ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকার করেছেন যতটা পরিমাণে ‘জনগণের রাষ্ট্র’ হল ‘মুক্ত জনগণের ‘রাষ্ট্র’র মতোই সমান অর্থহীন ও সমাজতন্ত্র থেকে একই রকম ভাবে বিচ্যুত। এঙ্গেলস চেষ্টা করেছেন নৈরাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জার্মান সোসাল ডেমোক্র্যাটদের সংগ্রামকে সঠিক পথে আনতে, সেই সংগ্রামকে নীতির দিক থেকে নির্ভুল করে তুলতে, ‘রাষ্ট্র’ প্রসঙ্গে সুবিধাবাদী কুসংস্কার থেকে তাকে মুক্ত করতে। কিন্তু হায়!এঙ্গেলসের চিঠি ছত্রিশ বছর ধরে ধামাচাপা পড়ে থাকল।এই প্রসঙ্গে আমরা পরে আরও দেখব যে, এই চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পরেও এমনকি, কাউটস্কি একগুঁয়ের মতো মূলত ঠিক সেই ভুলগুলিরই পুনরুক্তি করেছেন যার বিরুদ্ধে এঙ্গেলস হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।
১৮৭৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে বেবেল এঙ্গেলসের চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। সেই চিঠিতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে তিনি লিখেছিলেন, খসড়া কর্মসূচির যে সমালোচনা এঙ্গেলস করেছিলেন, তার সাথে তিনি পুরোপুরি একমত এবং আপসমুখিতার জন্য তিনি লিবনেক্টকে তিরস্কার করেছেন (বেবেলের স্মৃতিকথার জার্মান সংস্করণ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৩৪)। কিন্তু আমরা যদি বেবেলের ‘আমাদের লক্ষ্য’ পুস্তিকাটিকে দেখি, সেখানে রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা লক্ষ্য করা যায়। সেখানে বলা হয়েছেঃ
‘শ্রেণিশাসনের ভিত্তিতে তৈরি রাষ্ট্রকে জনগণের রাষ্ট্রের রূপান্তরিত করতে হবে।’ (উনসেরে জেইলে, জার্মান সংস্করণ, ১৮৮৬, পৃষ্ঠা ১৪) বেবেলের পুস্তিকার নবম সংস্করণে (নবম!) এই কথা ছাপা হয়েছিল!এঙ্গেলসের বিপ্লবী ব্যাখ্যা যখন নিরাপদে বাক্সবন্দি করে ফেলে রাখা হয়েছিল, জীবনের সমস্ত পরিস্থিতিই যখন জনসাধারণকে দীর্ঘকালের জন্য বিপ্লব থেকে ‘দূরে সরিয়ে রাখা’র উপযোগী ছিল, সেই সময়ে রাষ্ট্র সম্পর্কে নাছোড়বান্দার মতো বারবার প্রচারিত সুবিধাবাদী ধারণা যে জার্মান সোসাল ডেমোক্র্যাটরা গলাধঃকরণ করবে, তাতে আর আশ্চর্য কী। (চলবে)