দেশ জুড়ে বিজ্ঞানী, ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে শেষপর্যন্ত ২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য গো-বিজ্ঞান প্রচার প্রসার পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হল রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ। ধাক্কা খেল কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মদতে চলতে থাকা অপবিজ্ঞানের চর্চা।
ক্ষমতায় বসার পর থেকে সুপরিকল্পিত ভাবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ধীরে ধীরে দেশে বিজ্ঞানচর্চার পরিসরটিকে ছোট করে আনার অপচেষ্টা শুরু করেছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা খাতে ক্রমাগত বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। মাসের পর মাস ধরে ভাতা মিলছে না গবেষকদের। পাশাপাশি বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা সংস্থাগুলির শীর্ষপদে দলীয় অনুগতদের বসিয়ে সেগুলির নিয়ন্ত্রণ দলীয় কব্জায় নিয়ে পৌরাণিক গল্পগাথা ও কুসংস্কারকে বিজ্ঞান বলে চালানোর এবং গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী পিছিয়ে-পড়া ধ্যানধারণার প্রসার ঘটানোর প্রবল অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজেপি-র তাবড় নেতা-মন্ত্রীরা। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দাবি করছেন গণেশের শুঁড় অতীত-ভারতবর্ষে প্লাস্টিক সার্জারির উৎকর্ষতার প্রমাণ। গুজরাটে বিজেপি সরকারের স্কুলপাঠ্য বইতে পড়ানো হচ্ছে– মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের জন্ম হয়েছিল অত্যাধুনিক স্টেম-সেল পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে। বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ এক লেখক মহাভারতের যুগে ভিনগ্রহে পাড়ি দেওয়ার বিমান থাকার উদ্ভট তত্ত্ব হাজির করছেন নির্দ্বিধায়, জোর গলায়।
এরই সঙ্গে দেশ জুড়ে অবাধে চলেছে গো-বন্দনা। বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন হওয়ার পর থেকে সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত জায়গা পাচ্ছে গোরু। কখনও প্রকাশিত হচ্ছে গোময়-গোমূত্রের উপকারিতা কিংবা গোরুর দুধে সোনা মেলার কথা প্রচার করে বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের অমৃতবাণী। করোনা নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো ঘটা করে চলেছে গোমূত্র-পার্টি। বহু মানুষের খাদ্যাভ্যাসের অঙ্গ হওয়া সত্তে্বও রাজ্যে রাজ্যে দলীয় দাপট খাটিয়ে গুণ্ডা লেলিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে গো-মাংসের বেচাকেনা। স্বঘোষিত গোরক্ষা বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৪৩ জন মানুষ, আহত প্রায় ১৫০ জন। ধিক্কার উঠেছে দেশ জুড়ে। অথচ প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাউকে নিন্দাসূচক একটি বাক্যও উচ্চারণ করতে শোনা যাচ্ছে না। ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির প্রথম দফার শাসনে কেন্দ্রীয় মৎস্য, পশুপালন ও দু*জাত পণ্য মন্ত্রকের অধীনে তৈরি করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ। সেখানকার চেয়ারম্যান বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের সুরে সুর মিলিয়ে গোরুর অশেষ গুণাগুণ প্রচারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। গোবর দিয়ে তৈরি চিপ প্রকাশ করে দাবি করেছেন, এই চিপ মোবাইলের ক্ষতিকর বিকিরণ রোধ করার ক্ষমতাসম্পন্ন। গোরু নিয়ে ‘চেতনা’ বাড়ানোর লক্ষে্য এই আয়োগই ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘কামধেনু গো-বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসার পরীক্ষা’ নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। ১২টি আঞ্চলিক ভাষায় ১০০ নম্বরের এই পরীক্ষার পাঠ্যসূচি ও অবৈজ্ঞানিক হাস্যকর তত্ত্বে ঠাসা স্টাডি মেটিরিয়ালস দেওয়া হয়েছিল আয়োগের ওয়েবসাইটে।
দেশের মানুষ এ হেন কাজ-কারবার বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবে না বুঝে শাসক দলের নির্দেশে কামধেনু আয়োগের পাশে দাঁড়িয়েছিল খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এর সচিব স্বয়ং চিঠি লিখে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে গো-বিজ্ঞান পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের বসার জন্য উৎসাহিত করা হয়। এতে দেশের চূড়ান্ত বিস্মিত ও বিরক্ত শিক্ষিত সমাজ ব্যাপক প্রতিবাদ জানায়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সাফ জানিয়ে দেয়, এ পরীক্ষা তারা নিতে পারবে না। প্রতিবাদ ওঠে অসংখ্য বিজ্ঞানসংস্থা ও ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-অধ্যাপক-অভিভাবক মহল থেকে। শেষে নতি স্বীকার করে কামধেনু আয়োগ ওয়েবসাইটে জানিয়ে দেয়, অনির্দিষ্টকালের জন্য এই পরীক্ষা স্থগিত রাখা হল।
আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন দেশের শিক্ষিত মহল। কিন্তু এ স্বস্তির মেয়াদ যে দীর্ঘস্থায়ী হবে না, তা বোঝা কঠিন নয়। কারণ, বিজেপির মতো দক্ষিণপন্থী গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী একটি দল, যাদের মডেল হিটলার, তাদের ভাবাদর্শের মূল ভিত্তিই হল বিজ্ঞানবিরোধী পিছিয়ে পড়া চিন্তাধারা, অ-বিজ্ঞান, অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কার। একটি ফ্যাসিবাদী দল হিসাবে এরা বিজ্ঞানের ততটুকুই গ্রহণ করে, যেটুকু প্রযুক্তির উন্নতির জন্য প্রয়োজন। উন্নত কারিগরি জ্ঞানের সঙ্গে কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীনপন্থী চিন্তাধারার মিশেলেই গড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদী দলগুলির চিন্তাজগৎ। বিজেপি এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তাই একদিকে মহাকাশ পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক রকেট, ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ বানানোর নামে অহঙ্কারী আত্মপ্রচারের পাশাপাশি পৌরাণিক গল্পগাথাকে অতীত-ভারতে বিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রগতি বলে নির্দ্বিধায় প্রচার করেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী। ব্যাপক সংখ্যক মানুষ গরিবি-বেকারি-অশিক্ষা-চিকিৎসাহীনতায় মরে মরুক, গো-মাতার উন্নয়নকল্পে একের পর এক প্রকল্প উদ্বোধনে ব্যস্ত থাকেন রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি সরকারের নেতা-মন্ত্রী ভক্ত সন্তানরা। এঁরা ‘গো-বিজ্ঞান’-এর প্রসারে উদ্বাহু হবেন না তো কারা হবেন!
যদিও এঁদের ‘গো-ভক্তি’-র ভিতরে সততা কতটা আছে তা নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠে গেছে। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান ইত্যাদি বিজেপিশাসিত রাজ্যে সরকারি গোশালায় অসংখ্য গোরু বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। খেতে না পাওয়া কঙ্কালসার গোরুর ছবি বেরিয়ে গেছে সংবাদমাধ্যমে। চাষিদের কাছে গোরু সম্পদ হলেও সময়মতো তাকে বিক্রি করতে না পারলে খরচ টানা দুষ্কর হয়ে ওঠে। এদিকে আইন করে গোরু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে বিজেপি। এই অবস্থায় অকেজো বৃদ্ধ গোরুর খরচ চালাতে না পেরে অনেকেই পোষা জীবগুলিকে ছেড়ে দিয়ে আসছেন যেখানে সেখানে। এইসব বেওয়ারিশ গোরুর চাষের খেতে ঢুকে পড়া আটকাতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কৃষকরা পর্যন্ত খেত ঘিরে ইলেকট্রিক তার পেতে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। গোভক্তির নামে এভাবেই নিরীহ পশুগুলিকে মর্মান্তিক দুর্দশায় ফেলেছে বিজেপি।
এ সব কিছুর পিছনে আসলে যে চিন্তা কাজ করছে, তা হল ভোটে কিছু সুবিধা পাওয়া। বেদের সুক্তগুলিতে ও পুরাণ-কাহিনিতে যতই সাধারণ মানুষ ও মুনি-ঋষিদের গো-মাংস ভক্ষণের উল্লেখ থাক, পরবর্তী সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের একটা অংশের কাছে গোরু দেবতা হিসাবে পূজিত হয়। মৃত্যুর পর গোরুর লেজ ধরে বৈতরণী পার হয়ে স্বর্গে যাওয়া যায় বলেও বিশ্বাস করেন অনেকে। নির্বাচনে এই অংশের মানুষের অন্ধ সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিজেপি গোভক্তির এমন পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছে। তাদের আরও উদ্দেশ্য গোরুকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিরোধিতা চাগিয়ে তোলা, যা ভোট-রাজনীতিতে মেরুকরণে সাহায্য করবে। সেই উদ্দেশ্যেই বিজ্ঞানের যথার্থ প্রসারকে পিছনে ঠেলে কামধেনু আয়োগের পিছনে রাজকোষের বিপুল টাকা ঢালছে বিজেপি সরকার। গো-চেতনা প্রসারে জনগণের ট্যাক্সের টাকার বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। কিন্তু গরিবি, বেকারি সহ জনজীবনের মূল সমস্যাগুলি যেভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে, যেভাবে ধনী ১ শতাংশ আর না খেতে পাওয়া ৯৯ শতাংশের মধ্যে চূড়ান্ত বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, বিক্ষোভ বাড়ছে, তাতে গোরুর লেজ ধরে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন বিজেপির অধরাই থেকে যাবে।