৫ আগস্ট, বিশাল জনসমুদ্র ব্রিগেডে। কোথা থেকে এল এত মানুষ? এই জনসমুদ্রে মিশেছিলেন শুধু এস ইউ সি আই (সি)-র কর্মী সমর্থকরা নন– তার বাইরেও এক বিরাট অংশের জনগণ এসেছিলেন কমরেড প্রভাস ঘোষের বক্তব্য শোনার জন্য। এঁদের মধ্যে রয়েছেন বড় অংশের বামপন্থী মানুষ, যাঁরা তাঁদের দলের নেতাদের আপস এবং নীতিহীন আচরণ দেখতে দেখতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন এবং অপেক্ষা করছিলেন এমন একটি কর্মসূচির জন্য যা তাঁদের মনের আকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপ দেবে। তেমনই ছিলেন অন্য দলগুলির শুভবুদ্ধির এবং গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষেরা। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর ব্রিগেড সমাবেশের ডাক এবং তার প্রচার তাঁদের সবাইকে টেনে নিয়ে এসেছে ব্রিগেডে। ব্রিগেড সমাবেশ থেকে ফিরে তাঁদের যে প্রতিক্রিয়া তার যতটুকু সংগ্রহ করা গেছে তার সামান্য অংশ পাঠকদের কাছে আমরা তুলে ধরছি।
আপনার কোনও অসুবিধা হবে না
ব্যারাকপুরের বাসিন্দা পার্টির এক দৃঢ় সমর্থকের বাবা মারা যাওয়ায় ৫ আগস্ট থাকতে পারেননি বলে খুব মনোকষ্টে ছিলেন। কিন্তু ওনার পরিচিত দু’জন, যাঁদের উনি গণদাবী দেন তাঁদের ব্রিগেডে আসতে বলেছিলেন। তাঁদেরই একজনের অভিজ্ঞতা– এত লোক এস ইউ সি আইয়ের! রাস্তা দিয়ে স্রোতের মতো লোক যাচ্ছে। কোথা দিয়ে মাঠে ঢুকব, কী করব বুঝতে না পেরে এক পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, কোনও চিন্তা করবেন না। এরা অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ। আপনার কোনও অসুবিধা হবে না। তারপরই বললেন এই দলটা খুব লড়াকু, প্রতিবাদী। এরা যখন আন্দোলন করে তখন আমাদের লাঠি মারতে হয়। কিন্তু তার পর আমরাও খুব কষ্ট পাই।’ একজন পুলিশ অফিসারের মুখে এমন কথা শুনে উনি অবাক।
যৌবনের দামামা বুকের ভিতর
এক সময়ের শাসক বামপন্থী দলের এক বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ব্রিগেড থেকে ফিরে এক কর্মীকে জানিয়েছেন, অসামান্য জমায়েত। তরুণ-তরুণীদের মার্চপাস্ট, দীর্ঘকাল বাদে যৌবনের দামামা বুকের ভিতর। বললেন, সত্যবান বড় সভার উপযুক্ত বক্তা। শ্রী ঘোষ অনেক বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকতে আঁকতে সাবলীল, কিন্তু তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ করছিলেন সাম্প্রতিক রাজনীতির। অনেকদিন পর টাটকা তাজা জেদি এত মানুষের সঙ্গে একটা অপরাহ্ন– বড় প্রাপ্তি। ধন্যবাদ আপনাকে ও আপনার সহযোদ্ধাদের।
কমরেড প্রভাস ঘোষের বক্তব্য আমাকে কাছে টেনে নিয়েছে
বাঁকুড়ার এক শিক্ষক দলের এক কর্মীকে ডেকে বলেছেন, আমি এবং আমার মতো কয়েক জন বামপন্থী মানুষ আপনাদের থেকে দূরেই থাকি। কিন্তু এক বছর ধরে কমরেড শিবদাস ঘোষের জন্মশতবার্ষিকী পালনের কর্মসূচি, বিশেষত ৫ আগস্টের ব্র্রিগেড সমাবেশ, কমরেড প্রভাস ঘোষের সুচিন্তিত বক্তব্য আমাকে কাছে টেনে নিয়েছে। এবার থেকে আপনাদের দলের কাগজ গণদাবীর গ্রাহক হব। আপনাদের শিক্ষা আন্দোলন, বিদ্যুৎ আন্দোলনে সব রকম ভাবে সাহায্য করব।
ছাত্রীর জেদে পিছিয়ে গেল পরীক্ষা
দলের কমসোমল সদস্যরা কিশোর বয়স থেকেই বিপ্লবী দায়িত্ব পালনের জন্য উন্নত চরিত্র অর্জনের সংগ্রাম করে। যে কাজ যুক্তির বিচারে করা উচিত বলে স্পষ্ট হয়, সে কাজে ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এমনকি প্রথাগত পড়াশোনাও তাদের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এমনই বেশ কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের সাক্ষী রইল ৫ আগস্ট।
এক কমসোমল সদস্যের কলেজের ষষ্ঠ সিমেস্টারের বর্ষশেষের পরীক্ষা। না দিতে পারলে এক বছর পিছিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু, ৫ আগস্ট প্যারেডের দায়িত্ব পড়েছে তাঁর। ব্যস্ত থাকতে হবে ২ তারিখ থেকেই। অতএব ২ তারিখের পরীক্ষা দিয়ে বাকিগুলি আর দেওয়া হল না। আরও বড় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এলেল তিনি।
অপর এক কমসোমল সদস্যের স্কুল জানায়, পরীক্ষা শুরু হবে ৩ আগস্ট। এ কথা জানার পর থেকেই শিক্ষকদের কাছে অনবরত চলতে থাকে তার আবদার–‘স্যার আর কয়েকটা দিন পরে নিন না পরীক্ষাটা’। এক জনের কথায় কি আর পরীক্ষা পিছোনো যায়! কিন্তু, নাছোড়বান্দা স্নেহের ছাত্রী যে একটানা বলতেই থাকে, পরীক্ষার দিন পাল্টানোর কথা। শেষে, শিক্ষকরা তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন এমন আবদারের কারণ কী? সে জানায়, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী, মানবমুক্তির দিশারি কমরেড শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষের বিপুল আয়োজনে তাকে যেতেই হবে। লাখো লাখো মানুষ একবুক প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এ দায়িত্ব যে অনেক বড়! মেধাবী ছাত্রীটির জেদ– দরকারে পরীক্ষা দেবে না, কিন্তু ব্রিগেডে যাবেই। কর্তব্যের প্রতি এই অবিচল নিষ্ঠা দেখে শুধু ওই ক্লাসের জন্য তিন দিন পিছিয়ে গেল পরীক্ষা।
এমন উদাহরণ অজস্র। আজকের এই নম্বর পাওয়ার ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতার বাইরে, নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার বিপরীতে এ ঘটনা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, আসাম, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, বিহার সর্বত্রই ঘটেছে।
এখানে কেউ ফেট্টি কিনবে না
এক টুপি বিক্রেতা টুপিতে দলের নাম ছেপে এনে ব্রিগেডের সমাবেশে বিক্রি করছিলেন। সমাবেশে উপস্থিত একজন টুপি কিনে জিজ্ঞেস করলেন, টুপি কেমন বিক্রি হচ্ছে? বললেন, ভাল। কিন্তু ফেট্টি একেবারেই বিক্রি হচ্ছে না কেন বলতে পারেন? পাশে একজন ছোলা বিক্রি করছিলেন। তিনি পাশ থেকে বলে উঠলেন, তুই শুধু শুধু ফেট্টি ছেপেছিস। এখানে কেউ ফেট্টি কিনবে না। ওরা অন্য রকম, অন্য দলের মতো নয়। দলটা চিনতে ভুল হয়নি ছোলা বিক্রেতার।
দলের এক নেতা মাঝরাতে ট্রেন থেকে নেমেছেন কলকাতা স্টেশনে। এক কর্মী উপস্থিত তাঁকে স্টেশন থেকে সল্টলেক স্টেডিয়ামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কর্মীটি এক ট্যাক্সি ড্রাইভারকে গিয়ে বললেন, আমরা স্টেডিয়ামে যাব। ইনি দিল্লি থেকে এসেছেন কালকের ব্রিগেড সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য। ট্যাক্সি স্টার্ট দিয়ে ড্রাইভার বললেন, আমি সমাবেশের কথা জানি। আমি দীর্ঘদিন তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করেছি। ভেবেছিলাম তারা সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করবে। কিন্তু এখন এটা আমার কাছে পরিষ্কার তারা কিছু করবে না। আমি বুঝতে পেরেছি, এস ইউ সি আই-ই একমাত্র মানুষের জন্য লড়াই করছে। আমি কাল দুপুরে তিন ঘণ্টা ফাঁকা রেখেছি মিটিং শুনতে যাব বলে। বললেন আমি রাজাবাজারে থাকি। ফোন নম্বর এবং ঠিকানা দিয়ে কর্মীটিকে যোগাযোগ রাখতে বললেন।
না এলে জানতেই পারতাম না আমরাও মানুষ
পরিচারিকা সংগঠনের এক কর্মী তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে পরিচারিকাদের বাড়ি বাড়ি গিয়েছিলেন ব্রিগেডে আসার জন্য অনুরোধ করতে। এক পরিচারিকা তাঁর হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললেন, দিদি তোমার ছেলেকে খাবার কিনে দেবে। কর্মীটি বলেন, আমার ছেলের খাবার জুটে যায়, আপনি বরং এই টাকাটা ব্রিগেডের খরচের জন্য দিন। পরিচারিকা মহিলা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, দিদি, তা হলে আরও একটু বেশি দিই, আপনি একশো টাকা নিন।
সমাবেশ থেকে ফেরার সময়ে কেমন লেগেছে জানতে চাওয়ায় এক পরিচারিকা বললেন, সারা জীবন তো লোকের বাড়ি কাজ করি, রান্না করি। এখানে না এলে জানতেই পারতাম না যে আমরাও মানুষ। এর বাইরেও আমাদের কিছু করার আছে।
এ রকম সৎ মানুষ হতে পারে ভাবতেই পারিনি
সভা শেষে ব্রিগেডের পাশেই চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলেন এক দল কর্মী। ডিউটি করছিলেন এক পুলিশ অফিসার। বললেন, খুবই সুশৃঙ্খল মিটিং। আমাদের তো কোনও কাজই নেই। অন্য দলের মিটিংয়ে যে উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা যায়, তা অনেক সময় সহ্য করা যায় না। মনে হয় ধরে পেটাই, না হলে অ্যারেস্ট করি। এটা অন্য রকমের মিটিং। অফিসারের কথা শুনে দোকানদার বললেন, সত্যিই এঁরা অন্য রকমের। মিটিংয়ে আসা একটি দল চা খাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন, কত হয়েছে? আমি বললাম, ১৭টা চা। ওরা গুনে বললেন, না আমরা ২০ জন চা খেয়েছি। এ রকম সৎ মানুষ হতে পারে ভাবতেই পারিনি।
ব্রিগেড সমাবেশে চা বিক্রি করছিলেন এক ব্যক্তি। সভা কেমন হয়েছে জানতে চাওয়ায় তিনি উত্তর দিলেন, আমি ২৫ বছর ধরে ব্রিগেডে চা বিক্রি করছি। এমন মিটিং কখনও দেখিনি। অন্য মিটিংয়ে লোকে চা খেয়ে পয়সা দেয় না। জোর করে বিনা পয়সায় চা খেয়ে নেয়। অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করে। আজকের মিটিংয়ে একজনও চা খেয়ে পয়সা না দেওয়ার কথা বলেনি।
ভালবেসে নিঃস্বার্থভাবে এসেছে
শ্যামবাজারে থাকেন এক বাচিক শিল্পী। বললেন, আমি কোনও দিন কোনও রাজনৈতিক দলের সমাবেশে যাইনি। আমার বাবা, আমার দিদি রাজনীতি করতেন। বাবা পরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছেড়ে দেন। এই প্রথম ব্র্রিগেডের মতো জায়গায় কোনও রাজনৈতিক সমাবেশে আমি গেলাম এবং খুব ভাল লাগল। বাস থেকে নেমে হাঁটার পথে দেখছিলাম ভারি ব্যাগ নিয়ে গ্রামের মহিলারা হাঁটছেন। ভাবছিলাম, একেবারে সাধারণ সংসার করা ঘরের বৌ-রা এখানে এসেছেন কীসের টানে? পাশের জন বললেন, এদের কিন্তু কেউ কোনও পয়সাকড়ি দিয়ে বা প্রলোভন দেখিয়ে আনেনি। ভাবলাম, এতগুলো মানুষ ভালবেসে নিঃস্বার্থভাবে এসেছে, এটাই সব থেকে বড় পাওয়া। প্রথম কয়েক জনের বক্তব্য মাইকের জন্য তেমন শুনতে পাইনি। প্রভাসবাবুর বক্তব্য পুরোটাই স্পষ্ট শুনেছি, খুব ভাল লেগেছে।
সব কিছু দেখে আমি আপনাদের লোক হয়ে গেলাম
উত্তর চব্বিশ পরগণার অশোকনগর থেকে কমী-সমর্থক-দরদিরা মিলে বাসে করে ব্রিগেডে এসেছিলেন। সকালেই বেরিয়েছেন। দুপুরে খাবারের জন্য আগেই স্থানীয় এক দোকানে অর্ডার দিয়েছিলেন। দোকানের মালিক স্থানীয় নেতাকে বলেন, আমি যদি আরও কিছুটা খাবার নিয়ে আপনাদের সঙ্গে যাই এবং সেখানে বিক্রি করি আপনাদের অসুবিধা হবে কি? নেতাটি বলেন, কীসের অসুবিধা? ব্রিগেডে কর্মীদের হাতে বরাদ্দ খাবার তুলে দিয়ে তিনি সভার এক ধারে গিয়ে বসেন খাবার নিয়ে। বিক্রি শেষ করে সভায় ঢোকেন। সভা শেষে তিনি বলেন, আমি এমন অনেক সভাতেই খাবার বিক্রি করতে এসেছি। প্রতিবার আমার অনেক টাকা খোয়া যায়। খেয়ে টাকা দেয় না। এ বার আমার এক টাকাও খোয়া যায়নি। কিন্তু এমন মিটিং কখনও দেখিনি। প্রভাসবাবু বলার সময়ে দেখলাম গোটা মাঠ চুপ করে বক্তব্য শুনছে। আমিও শুনেছি। এমনটা আমি ভাবতেই পারিনি। সব কিছু দেখে আমি আপনাদেরই লোক হয়ে গেলাম। আমি ফিরে গিয়ে এই মিটিংয়ের কথা সবাইকে বলব। এমনই জানা অজানা অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী থাকল ৫ আগস্টের ব্রিগেড।