Breaking News

ব্রডকাস্টিং বিল—ডিজিটাল মিডিয়াও মুঠোয় পুরতে চায় বিজেপি সরকার

বিজেপি নেতারা প্রচার করতেন ডিজিটাল দুনিয়ার প্রসার হলে একেবারে প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠও চাপা পড়ে থাকবে না, গণতন্ত্র আরও মজবুত হবে। কিন্তু সম্প্রতি পাশ হওয়া ডিজিটাল বিলে মোদি সরকার যা বলেছে তাতে সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের ব্যক্তিগত পরিসর আরও সংকুচিত হবে। জনসাধারণের বিরুদ্ধ মতপ্রকাশের কণ্ঠ আরও রুদ্ধ করে দেওয়া হবে। এর ফলে গণতন্ত্র সঙ্কুচিত হতে হতে যতটুকু অবশিষ্ট আছে, তাও চলে যাবে কবরে। এক কথায় এই বিল আইন হলে ডিজিটাল মিডিয়া শাসিতের উপর শাসকের নজরদারি চালানোর অস্ত্রে পরিণত হবে।

ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিয়ে এসেছে ব্রডকাস্টিং সার্ভিস (রেগুলেশন) বিল। এই বিলকে কার্যত কেন্দে্রর ডিজিটাল মিডিয়ায় সংবাদ সেন্সরের হাতিয়ার বলেই মনে করছে ডিজিটাল মিডিয়া সংগঠন ‘ডিজি পাব’। ৬০টি ডিজিটাল মিডিয়া সংগঠন নিয়ে গঠিত এই সংস্থা ইতিমধ্যেই এই বিল নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

এই বিলে কী রয়েছে? এতে এমন সব ধারা রয়েছে যাতে যারা সরকারে আছে তাদের বিরুদ্ধে কোনও সংবাদ বা মতামত বা সামান্য সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ হলে তা বন্ধ করার আইনি ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে। এই বিল নিয়ন্ত্রণ করবে ইন্টারনেটে প্রচারিত সবকিছুকেই– ওটিটি-র সিনেমা, ইউটিউবের ভিডিও, ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমকেও। ইতিমধ্যেই বহু সিনেমা সেন্সর বোর্ডের নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছে বা কাটছাঁট করা হয়েছে।

দেশে এমনিতেই সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের উপর যখন-তখন হামলা চালাচ্ছে কেন্দ্রের শাসক বিজেপি সরকার। বিরোধী মতামতের জন্য নানা এজেন্সিকে ব্যবহার করে বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করে দিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। সরকারের না-পসন্দ খবর করার অপরাধে জেলে ভরা হয়েছে বহু সাংবাদিককে, এমনকি জামিন-অযোগ্য ইউএপিএ আইনের ধারা দেওয়া হয়েছে।

অবস্থা এতই গুরুতর যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ বিচারবিভাগও এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে। সাংবাদিকদের অকারণ হয়রানির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বিচারপতিদের অনেকেই। গত এপ্রিলে বাতিল করে দেওয়া মালয়ালি চ্যানেল ‘মিডিয়া ওয়াল’-এর লাইসেন্স পুনরায় চালু করে সুপ্রিম কোর্ট বলে, সরকারের সমালোচনা প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা নয়। সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে কাশ্মীরের এক সংবাদ-ওয়েবসাইটের সম্পাদককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তাঁকে জামিন দিয়ে নভেম্বরে কাশ্মীরের হাইকোর্ট বলে, কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনাকে সন্ত্রাসবাদী কাজ বলে ধরা চলে না। কিন্তু তাতেও সরকারের দমন-নীতির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। এই অবস্থায় ব্রডকাস্টিং বিল আইন হলে নামী-দামি সংবাদপত্র, চ্যানেল ছাড়াও বহু ওয়েব-পোর্টাল যারা কিছুটা হলেও স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে পারত, তাদেরও কাজ মারাত্মক ভাবে সরকারি আক্রমণের মুখে পড়বে। ইজরায়েলের পেগাসাস স্পাইওয়ার ব্যবহার করে সাংবাদিকদের, মানবাধিকার কম¹দের উপর বিজেপি সরকারের গোপন নজরদারি চালানোয় ইতিমধ্যেই ব্যক্তিপরিসরের গণ্ডি আরও সংকুচিত হয়েছে। এ ভাবে গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকুও লুপ্ত হতে বসেছে।

২০১৪-তে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দেখা গেছে সাংবাদিক পেশার নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সরকারের ‘জো-হুজুর’-এ পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে। না হলে প্রাণহানির শাসানি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে সাংবাদিকদের। চাপের মুখে অনেক নামী সাংবাদিক সংবাদমাধ্যমের জগৎ থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিতে বাধ্য হচ্ছেন, অনেকে মগজে কুলুপ এঁটে তোতাপাখির মতো সরকার কিংবা শাসক দলের নেতাদের বয়ান আওড়ে চলেছেন। ফলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে এক লাফে ভারত পিছিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে পৌঁছেছে। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক।

প্রবীণদের অনেকেরই স্মৃতিতে রয়েছে ১৯৭৫-এ ইন্দিরা গান্ধী সরকারের ইমার্জেন্সির সময়ে খবর ‘সেন্সর’-এর ঘটনা। সংবাদপত্রগুলিতে কী ছাপা হবে আর কী হবে না, সেক্ষেত্রে সরকার নজরদারি চালাতো এবং সরকার-বিরোধিতার সামান্য সুর টের পেলে তৎক্ষণাৎ তা মুছে ফেলত। এখনও যেভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, তাতে কার্যত অঘোষিত জরুরি অবস্থাই চলছে। সম্প্রতি বিজেপি শাসনে আদানি ও আম্বানি গোষ্ঠী বহু সংবাদমাধ্যমের মালিকানার দখল নিয়েছে। ফলে সংবাদমাধ্যমের উপর বিজেপি-ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ বাড়ছে। তাই শোষক পুঁজিপতিদের শোষণ-বঞ্চনা এবং তাদের সেবাদাস সরকারগুলির দুর্নীতি ও জনবিরোধী কাজকর্ম নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের অধিকার হারিয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলি।

স্বৈরাচারী বিজেপি সরকারের পুঁজিপতি তোষণের নীতির ফলে নিত্যসমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষের সরকার-বিরোধী ক্ষোভকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই ফ্যাসিস্টসুলভ এই বিল নিয়ে আসছে। মরণোন্মুখ পর্যায়ে পুঁজিবাদের শেষ আশ্রয় যে ফ্যাসিবাদ– তাকেই আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ করে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সেবক বিজেপি সরকার সম্প্রচার বিল এনে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে। ইতিহাসের শিক্ষা– জার্মানিতে হিটলারের ফ্যাসিস্ট সরকার গণতন্ত্রকে টুঁটি টিপে মারতে চেয়েছিল, কিন্তু মানুষের সংঘবদ্ধ শক্তি তা প্রবলভাবে প্রতিরোধ করেছিল। এখানেও শোষিত-নিপীড়িত মানুষ আত্মরক্ষার তাগিদে সঠিক নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হবে এবং এই ফ্যাসিবাদী চেষ্টাকে প্রতিহত করবে।