ব্যাঙ্কের লক্ষ কোটি টাকা ইচ্ছামতো লুঠ করতে পারো, রক্ষা করবে সরকার

ঋণের নামে ব্যাঙ্কের টাকা মেরে দেওয়া কর্পোরেট লুঠেরাদের বাঁচানোর জন্য এবার নতুন পথ বার করছে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। ৮ জুন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে পরামর্শ দিয়েছে, তারা যেন ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের সাথে আপসের মাধ্যমে বিষয়টির ফয়সলা করে নেয়। এ জন্য এমনকি এই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপ বা ব্যাঙ্ককে ঠকানোর জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনও ক্রিমিনাল কেস দায়ের হয়ে থাকলেও এই আপস করার পরামর্শ দিয়েছে দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক। শুধু তাই নয় ১২ মাস ‘কুলিং পিরিয়ডে’র পর আবারও এই গ্রাহকদের ঋণ দিতে পারবে ব্যাঙ্কগুলি।

এই পরামর্শটি যে আসলে নির্দেশিকা এবং তা যে সরকারের ইচ্ছানুসারেই জারি করা হয়েছে, তা দেশবাসীর না বোঝার কোনও কারণ নেই। বিশেষত নরেন্দ্র মোদি জমানায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদে জো-হুজুর আমলাদের নিয়োগের যে কার্যক্রম চালু হয়েছে, তাতে এমন একটি নির্দেশ সরকারের ইচ্ছা ছাড়া জারি করার কথা শীর্ষব্যাঙ্ক কর্তাদের ভাবাই অসম্ভব। এর মানে দাঁড়াল প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় ‘মেহুল ভাই’, নীরব মোদি, বিজয় মালিয়া সহ যে সমস্ত পুঁজি মালিকরা ভারতের ব্যাঙ্কের টাকা গায়েব করে দিয়ে নিশ্চিন্তে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সাথেও আপস-মীমাংসা করে আবার এদের ঋণ দিতে শুরু করতে পারে ব্যাঙ্কগুলি।

ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকাগুলি কাদের? কোন সম্পদ থেকে ব্যাঙ্ক পুঁজিপতিদের ঋণ দেয়? যে কোনও মানুষই জানেন, এর প্রতিটি পয়সা আসে দেশের কোটি কোটি মানুষের ঘাম ঝরানো রোজগার থেকে তিল তিল করে বাঁচানো আমানত থেকে। পুঁজিপতিরা তাদের পিতৃ-মাতৃ উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্ত কোনও সম্পদ থেকে এই ঋণ নেয় না। এখন থেকে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ব্যাঙ্কলুঠ আইনসঙ্গত হয়ে গেল। এর জন্য ব্যাঙ্কের ক্ষতির বোঝা বইবে গরিব, মধ্যবিত্ত, সাধারণ করদাতা জনগণ। অথচ মাত্র দু’বছর আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ঘোষণা করেছিল ঋণখেলাপিরা মূলধনী বাজারে ঢুকতে পারবে না। নতুন করে তারা ব্যাঙ্কঋণও পাবে না।

তা হলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হঠাৎ উল্টো রাস্তায় হাঁটল কেন? এ কি মোদি সরকারের চাপ ছাড়া হতে পারে? এই নরেন্দ্র মোদির ভারতে ব্যাঙ্কের দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী থাকা ঋণ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। ব্যাঙ্কিং পরিভাষায় একে বলা হয় অনুৎপাদক সম্পদ বা ‘নন পারফরমিং অ্যাসেট’ (এনপিএ)। ২০১৪-তে মোদি সরকার ক্ষমতায় বসার পর থেকে ২০২২-এর মার্চ পর্যন্ত এনপিএ-র পরিমাণ ৬৬.৫ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাধারণ মানুষ বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নেওয়া ঋণ খুব বেশি নয়। এর অধিকাংশটাই নিয়েছে বৃহৎ পুঁজির মালিকরা। ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের একটি সংগঠন দেখিয়েছে কীভাবে সরকার দেউলিয়া আইনে ১৩টি কোম্পানির এনপিএ উদ্ধারের নামে তার ৬৪ শতাংশ মকুব করে দিয়ে সেগুলি আম্বানি, টাটা, মিত্তাল, এসারের মতো বৃহৎ মালিকদের উপহার দিয়েছে। অনিল আম্বানি গোষ্ঠীর ১ লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে তাদের আবার ঋণ দিতে বাধ্য করছে। আদানি গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিকা একই রকম। কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী রাজ্যসভায় জানিয়েছিলেন, এনপিএ-র ১৩ শতাংশ মাত্র আদায় করা গেছে। ২০২২-এর ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, ২০১৭ থেকে পাঁচ বছরে ব্যাঙ্কগুলি ১০.৯ লক্ষ কোটি টাকা ‘রাইট অফ’ বা খাতা থেকে মুছে দিতে বাধ্য হয়েছে। যদিও সরকারেরই নানা হিসাব থেকে বোঝা যায় এই পাঁচ বছরে মুছে দেওয়া ঋণের আসল পরিমাণ হল এনপিএ-র ২২.৩৪ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে ১৪ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী জোরগলায় দাবি করে থাকেন রাইট অফ করা মানেই ঋণ মকুব করা নয়, এই টাকা আদায় করা হবে। বাস্তবে এনপিএর ১ টাকা আদায় হলে ৮ টাকা রাইট অফ করতে বা চিরতরে খাতা থেকে মুছে দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি বাধ্য হচ্ছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাঙ্কের সাথে পুঁজিপতিদের ক্রমবর্ধমান প্রতারণা। মোদি সরকারের আমলে এই প্রতারণার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে আগের তুলনায় ১৭ গুণেরও বেশি। ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ঋণ নিয়ে ব্যাঙ্ককে ঠকানো বা প্রতারণার জন্য ক্ষতি হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। আর ২০১৫ থেকে ২০২৩-এ এই ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৫.৮৯ লক্ষ কোটি টাকা। একা মেহুল চোক্সিই গায়েব করেছেন, ব্যাঙ্কের ৯২ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। গুজরাটের এবিজি শিপইয়ার্ড কোম্পানি ২৮টি ব্যাঙ্কের কনসর্টিয়ামের থেকে নেওয়া ২২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা গায়েব করে দিয়েছে। মোদি সরকারের প্রথম পাঁচ বছরেই মেহুল চোক্সি, নীরব মোদি, বিজয় মালিয়ার মতো অন্তত ৭২জন পুঁজিমালিক ব্যাঙ্কের টাকা গায়েব করে নিশ্চিন্তে বিদেশে পালিয়েছে। সরকার আটকানোর কোনও চেষ্টাই করেনি। কিন্তু কোনও ছোট ব্যবসায়ী, স্বনিযুক্তি প্রকল্পে কিছু রোজগারের আশায় কোনও বেকার যুব, বেতনভোগী ছা-পোষা মানুষ, ছাত্ররা ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করতে সামান্য দেরি করলেই পুলিশ থেকে শুরু করে ব্যাঙ্কের আদায়কারী গুন্ডাবাহিনী তাদের পিছনে ছুটতে থাকে।

একচেটিয়া পুঁজিপতিদের জন্য বিপরীত ব্যবস্থা কেন? আইন কি তাদের জন্য আলাদা? তাহলে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ যাঁরা জীবনধারনের প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন এবং সততার সাথে সেই ঋণ শোধ করতে চেষ্টা করেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই নির্দেশিকা তাদের উদ্দেশে কোন বার্তা দিল? ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ ও পুঁজিপতি প্রতারকদের গায়েব করা টাকার চাপে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি ক্রমাগত লোকসানের সামনে পড়ছে, অথচ কিছুদিন আগেই তারা ছিল বিরাট লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় সরকার একাধিকবার এই ক্ষতি পূরণ করতে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যাঙ্কের তহবিলে টাকা ঢেলেছে। যা আসলে সাধারণ মানুষের দেওয়া করের টাকা।

ব্যাঙ্কের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পেট্রল-ডিজেল রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ানো থেকে শুরু করে জিএসটি বাড়ানো, একশো দিনের কাজ সহ সমস্ত জনকল্যাণমূলক খাতে খরচ কমানোর পথে হাঁটছে বিজেপি সরকার। এ ভাবেই মালিকদের ব্যাঙ্কলুঠের বোঝা কৌশলে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে বিজেপি সরকার। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিজেপির ভাণ্ডারে প্রাকাশ্যে ও গোপনে কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা কেন এত বিপুল টাকা ঢালে। তা হলে প্রধানমন্ত্রী যে ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’ স্লোগান তুলেছিলেন, এই বোধহয় তার আসল রূপ!

বাস্তবে একচেটিয়া পুঁজিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে নরেন্দ্র মোদি সরকার এমনি করেই বারেবারে নিয়ম নীতি আইন বদলে দিয়েছে। মোদি সরকারের এই কাজকে সাংবাদিকরাও ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ বা স্যাঙাৎতন্ত্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলছেন। বোঝা দরকার, আজকের দিনে গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই স্যাঙাৎতন্ত্রের রূপ নিয়েছে। সরকার এবং রাষ্ট্র পুঁজিপতিদের স্বার্থেই কাজ করলেও একটা ভাগরেখা এর মধ্যেও ছিল। এখন সরকার, রাষ্ট্র আর একচেটিয়া মালিকদের মধ্যেকার এই সীমারেখাটুকুও মুছে গেছে। আজ পুঁজিপতিরাই সরকার, তারাই আইন, তারাই সবকিছু। আগে যেটুকু নিয়ম-নীতির প্রশ্ন ছিল আজ সে বালাই আর নেই। আইন-কানুন সব কিছুকেই একেবারে খোলাখুলি মালিক শ্রেণির পায়ে বিসর্জন দিচ্ছে সরকার ও রাষ্টে্রর কর্তারা। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় এ দেশের সব সরকারই পুঁজিপতিদের সেবাদাস হিসাবে কাজ করে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি সরকার সেই দাসত্বের এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চক্ষুলজ্জার বালাইটুকুও তারা রাখছে না।

(তথ্যসূত্রঃ দ্য ওয়্যার, ১৬.০১.২০২৩ এবং দ্য টেলিগ্রাফ ১৫.০৬.২০২৩)