২০১৪ সালে প্রথমবার কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন হওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদি বুক বাজিয়ে বলেছিলেন– ক্ষমতায় এলে বছরে ২ কোটি বেকারকে চাকরি দেবেন। সে বছর বিজেপির নির্বাচনী ঘোষণাপত্রেও লেখা হয়েছিল, সরকারে বসে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করাই হবে তাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। দশ বছর ধরে কেন্দ্রে বিজেপি শাসনের পর দেখা যাচ্ছে বেকারত্ব কমাতে তথা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নরেন্দ্র মোদির সরকার ডাহা ফেল করেছে। শুধু এটুকুই নয়, এই দশ বছরে প্রকৃত মজুরি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে আগের বছরের তুলনায় কমেও গেছে। আরও সমস্যার কথা হল, দেখা যাচ্ছে কর্মসংস্থান বা মজুরি সংক্রান্ত তথ্য সরকার অনেক সময়ই প্রকাশ করছে না, গোপন করার চেষ্টা করছে। যেটুকু তারা প্রকাশ্যে আনছে, সেগুলি আবার অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের তৈরি নানা রিপোর্ট বা খ্যাতনামা গবেষণাকেন্দ্রগুলির দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলছে না।
বেকারত্বের হার
কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় বসার পর ৩ বছরের মধ্যে গত ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে ২০১৭-’১৮-তে বেকারত্বের হার পৌঁছেছিল ৬.১ শতাংশে। এরপর কোভিড অতিমারির বছরে ২০২০-র এপ্রিল থেকে জুনে এই হার আরও ২০.৮ শতাংশ বেড়ে যায়। মোদি সরকারের দাবি– ২০২২-’২৩-এ বেকারত্বের হার কমে ৩.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যদিও ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’ (সিএমআইই), যার গবেষণালব্ধ রিপোর্টগুলিকে অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা প্রামাণ্য বলে ভরসা করেন, তাদের গবেষণা বলছে, সরকারি হিসাবের চেয়ে বাস্তবে বেকারত্বের হার অনেকটাই বেশি। দেশের ঘরে ঘরে আজ বেকার যুবক-যুবতীদের হাহাকার স্পষ্ট করে দেয় যে, সরকার এ বিষয়ে সঠিক তথ্য প্রকাশ করছে না।
তা ছাড়া এ প্রশ্ন না উঠে পারে না যে, বাস্তবে বেকারত্বের হার যদি সত্যিই কমে থাকে, তাহলে মোদি সরকার ২০১৭ সালের ‘এমপ্লয়মেন্ট আনএমপ্লয়মেন্ট সার্ভে’-র বার্ষিক রিপোর্ট চেপে দিয়েছিল কেন? কেনই বা তারা ২০১৮ সালে ‘লেবার ব্যুরো’-র ত্রৈমাসিক সমীক্ষা বন্ধ করে দিল?
কমছে উৎপাদন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান
২০১৪ সালে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প নিয়ে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়েছিলেন। ২০২০-তে তাঁরা আবার নিয়ে এলেন ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্প। দুটি প্রকল্পেরই নাকি উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদন ক্ষেত্রকে উৎসাহ দেওয়া। এই দুই প্রকল্পে শ্রমিক-নির্ভর কাজের ব্যবস্থা করে বেকারত্ব কমানোর ব্যবস্থা হবে বলে ২০১৪ ও ‘১৯-এর নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে দাবি করেছিল বিজেপি। বাস্তবে দেখা গেল, দুটি প্রকল্পই ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৬-র তুলনায় ২০২১-এ উৎপাদন ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ অর্ধেক হয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমনকি কোভিড অতিমারির সময়ের তুলনাতেও বর্তমানে এই ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ কম। যে ক’জন কাজ পেয়েছেন, ২০১৮-র একটি সমীক্ষা দেখাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগেরই মজুরি নিতান্ত কম।
পরিকাঠামো ক্ষেত্রেও কাজ নেই
দেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষ পরিকাঠামো ও গৃহনির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ করেন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হল, এখানে অধিকাংশ কর্মীরই কাজ স্থায়ী নয়। ‘লেবার সার্ভে রিপোর্ট’-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, এই ক্ষেত্রে ৮৩ শতাংশেরও বেশি কর্মী ঠিকা-শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন। অর্থাৎ আজ তাঁদের কাজ থাকলেও কাল থাকবে কি না, নিশ্চিত নয়।
কৃষি মজুরিতেই আটকে অধিকাংশ
বিজেপি সরকার এই বিষয়টি নিয়ে অবশ্য গর্ব করতেই পারে। ঢাক পিটিয়ে তারা বলতে পারে, ২০১৮-’১৯-এ ৪২.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১-’২২-এ কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার হয়েছে ৪৫.৫ শতাংশ। যদিও অর্থনীতিবিদদের মতে কৃষিক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া সার্বিক ভাবে অর্থনীতির অবনমনের চিহ্ন। তাঁরা বলছেন, শহরে কাজ করতে আসা মানুষ কাজের অভাবে গ্রামমুখী হওয়ার কারণেই এই বৃদ্ধি।
স্বনিযুক্তিঃ কাজ আছে মজুরি নেই
দেখা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের দশ বছরে দেশে স্বনিয়োজিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এঁদের অধিকাংশই নিজের ঘরে বসে কেউ হাতের কাজ করে, কেউ বা সবজি বিক্রি করে অথবা চায়ের দোকান খুলে কিছু রোজগারের চেষ্টা করেন। ২০১৩-’১৪-তে ৪৯.৫ শতাংশের তুলনায় ২০২২-’২৩-এ এমন স্বনিয়োজিত মানুষের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৭.৩ শতাংশ। অনেকখানি বৃদ্ধি সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা এতে আশঙ্কার কালো ছায়া দেখছেন। প্রথমত অন্য কোথাও কাজ না পেয়েই মানুষ সাধারণত এই ধরনের নিতান্ত কম আয়ের কাজে নিযুক্ত হন। তা ছাড়া এই ক্ষেত্রে এমন বহু মানুষ কাজ করেন যাঁরা অন্যকে মজুরি দেন না, নিজেও মজুরি পান না। এঁদের অনেকেই নিজেই উৎপাদক, নিজেই বিক্রেতা এবং এই কাজের জন্য তাঁদের কোনও মজুরি নেই। মজুরি ও মাস-মাইনের স্থায়ী কাজের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং স্বনিয়োজিত কর্মীর সংখ্যা হ্রাস– অর্থনীতির উন্নয়নের এ হল একটি প্রধান লক্ষণ। ফলে স্বনিয়োজিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির এই ঘটনাই গোটা দেশ জুড়ে কর্মহীনতার বিপুল সংকটের চেহারাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
প্রকৃত মজুরি একই জায়গায় থেকে যাওয়াও উদ্বেগজনক। হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০১৪-’১৫-র তুলনায় ২০২১-’২২-এ প্রকৃত মজুরি অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে মজুরির পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম বেড়েছে। বিজেপির ঘোষণাপত্রগুলিতে যে কৃষি ও নির্মাণশিল্পে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, এই সময়ে সেই দুটি ক্ষেত্রে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে মাত্র ০.৯ শতাংশ ও ০.২ শতাংশ। অথচ এই সময়কালে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির আগুনে পুড়েছেন, এখনও পুড়ে চলেছেন খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ। সব মিলিয়ে ২০২০-র একটি গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, বিজেপির শাসনকালে মজুরি বৃদ্ধির হার থমকে গেছে, বহু ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক ভাবে কমেও গেছে। ২০২২-’২৩-এর ইকনমিক সার্ভে রিপোর্টে খোদ কেন্দ্রীয় সরকারই জানিয়েছে, গ্রামীণ এলাকায় প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক।
‘ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’ (আইএলও)-র যৌথ গবেষণায় তৈরি ‘ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’ ও কর্মসংস্থানের বেহাল দশাটিকে তুলে ধরেছে। গবেষকরা হিসাব করে দেখিয়েছেন, ভারতে শ্রমের বাজারে অসংগঠিত ক্ষেত্রেরই রমরমা। তাঁদের রিপোর্ট বলছে, দেশের কর্মক্ষম মানুষের ৮১ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। অর্থাৎ দেশের সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান নেহাৎ নগণ্য। রিপোর্ট আরও দেখিয়েছে, ভারতে কাজের বাজারের একটা বড় অংশ দখল করে রয়েছে স্বনিয়োজিত মানুষ। ২০২৩-এর হিসাবে তা মোট কর্মে নিযুক্ত মানুষের ৫৭.৩ শতাংশ। ঠিকা কর্মী যারা মূলত দিনমজুর হিসাবে কাজ করেন, তাঁরা দখল করে রয়েছেন মোট কর্মে নিযুক্ত মানুষের ২১.৮ শতাংশ। নিয়মিত ও স্থায়ী কাজ রয়েছে মাত্র ২০.৯ শতাংশের।
বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরির প্রতিশ্রুতি যে আসলে ‘জুমলা’, তা বহুদিন আগেই দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। নরেন্দ্র মোদির দশ বছরের শাসনে এ কথাও আজ পরিষ্কার যে, কর্মসংস্থান বা কাজের সুযোগ সৃষ্টি সংক্রান্ত তাঁর সরকারের যাবতীয় প্রতিশ্রুতিও আসলে জুমলাই। কিছু বাগাড়ম্বর ছাড়া তাঁর সরকার দেশের কোটি কোটি কর্মহীন যুবকের যন্ত্রণা লাঘবের কোনও ব্যবস্থাই করেনি, করার চেষ্টাও করেনি। ঘরে ঘরে কর্মহীন, উপার্জনহীন তরুণ-তরুণীদের চাপা কান্না আর তাদের পরিজনদের দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ক্রমশ ভারি হয়ে উঠছে।
সম্প্রতি বিজেপি তাদের নির্বাচনী ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেছে। নাম– ‘মোদি কি গ্যারান্টি’। লক্ষণীয়, এই মুহূর্তে দেশের কঠিনতম সমস্যাগুলির অন্যতম বেকারত্ব নিয়ে এই ঘোষণাপত্র নীরব। বাস্তবে কর্মসংস্থান নিয়ে বিজেপির অতীতের সমস্ত প্রতিশ্রুতিই এমন ভাবে ব্যর্থ হয়েছে যে, নতুন করে একই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চেয়ে নীরব থাকাটাই বোধহয় তাঁরা ভালো মনে করেছেন।
(তথ্যসূত্রঃ স্ক্রোল ডট ইন, ২১ মার্চ ‘২৪ ও ইন্ডিয়া টুডে, ১৫ এপ্রিল ‘২৪)