বাংলাদেশে একটি সঠিক সাম্যবাদী দল গঠনের সংগ্রাম করছি আমরা (১)

কমরেড প্রভাস ঘোষের হাতে রক্তপতাকা তুলে দিচ্ছেন বাসদ মার্ক্সবাদীর সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানা, ৫ আগস্ট ২০১৩

সাক্ষাৎকারে বাসদ মার্ক্সবাদীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের সমন্বয়ক মাসুদ রানা

৫ আগস্ট মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষ জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে কলকাতায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের সভায় যোগ দিতে এসেছিলেন বাংলাদেশের বাসদ মার্ক্সবাদীর এক প্রতিনিধিদল। দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরামের সমন্বয়ক কমরেড মাসুদ রানার একটি সাক্ষাৎকার গণদাবীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হল। এবার প্রথম কিস্তি।

 

প্রশ্নঃ কমরেড মাসুদ রানা, আপনারা ৫ আগস্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ব্রিগেড সমাবেশে যোগ দিতে ১১৫ জন ভারতবর্ষে এসেছেন। আপনারা এতজনকে নিয়ে এই সমাবেশে এলেন কেন?

উত্তরঃ কমরেড শিবদাস ঘোষকে আমাদের দল আজকের যুগের একজন মার্ক্সবাদী অথরিটি মনে করে। অর্থাৎ লেনিন পরবর্তী যুগে মার্ক্সবাদের যে সংকটগুলো আমরা দেখি, লেনিনীয় শিক্ষার ভিত্তিতে সেই সংকটগুলোকে যথার্থ ভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা, দলীয় জীবনে রপ্ত করা, চর্চা করা এবং জীবন্তভাবে সেই সিদ্ধান্তগুলোকে উপস্থাপন করা, সেই বিষয়গুলোই কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় আমরা পাই। সেই জন্যই আমরা কমরেড শিবদাস ঘোষকে বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের একজন অথরিটি মনে করি। আমাদের দলের যিনি প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, মহান বিপ্লবী কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, তিনি শিবদাস ঘোষের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। আমরা আমাদের দেশের মাটিতে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে একটি সঠিক সাম্যবাদী দল গড়ে তোলার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি ভিন্ন ধারার রাজনীতির চর্চা করছি। আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা মনে করেন যে, এই মহতী সমাবেশে উপস্থিত থাকতে পারলে তাঁদের মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তার প্রতি আকর্ষণ বাড়বে, তাঁরা অনুপ্রাণিত হবেন।

প্রশ্নঃ এই ভিন্ন ধারার রাজনীতি বলতে কী বোঝায়?

উত্তরঃ অবিভক্ত ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি এবং পরবর্তীকালে তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে মস্কোপন্থী এবং পিকিংপন্থী যে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ছিল, তার থেকে পুরোপুরি নতুন একটি ধারারই সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে। আমাদের দেশে বিপ্লবের যে স্তর, আজকের দিনে উন্নত কিংবা অনুন্নত, যে কোনও দেশেই বিপ্লবটা সমাজতান্ত্রিক। আমাদের দেশে বিপ্লবের স্তর পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক, এ কথা কিন্তু কেউ বলত না। আমাদের পার্টি, আমাদের পার্টির নেতা সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে দেখান যে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশ একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তার বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক এবং জাসদের (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) অভ্যন্তরে যে সংগ্রামটা শুরু হয়েছিল, সেই জাসদের সংগ্রামের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়েছিল, কিন্তু তার বিপ্লবের রণনীতি কী হবে, তার রণকৌশল কী হবে, বিপ্লবের স্তর কী হবে, সে সম্পর্কে তাদের কোনও স্পষ্ট দিকনির্দেশ ছিল না। আবার শুধু মাত্র বিপ্লবের স্তর নির্ধারণই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্র ব্যাপ্ত করে তার সংগ্রামটা কেমন হবে, এই বিষয়গুলো কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতেই কিন্তু আমাদের দেশে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীই প্রথম তুলে ধরেন এবং সেই সংগ্রামটা শুরু করেন।

ফলে মার্কসীয় জ্ঞানভাণ্ডারে শিবদাস ঘোষের যে অবদান, সেগুলো আমরা যখন আলোচনা করি, তখন দেখি যে, বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের সংকটগুলো কী এবং সেই সংকটগুলো কেন হচ্ছে, এই বিষয়গুলো উনি পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন। যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে, যখন সমাজতন্ত্রের একটা ব্যাপক জোয়ার, তখন উনি আদর্শগত চর্চার যে গুরুত্ব বা যান্ত্রিকতার যে সমস্যা, সেইগুলোকে তুলে ধরছেন। বা পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি যে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসের রিপোর্টের যে আলোচনা উনি করলেন তখন দেখালেন যে এই কংগ্রেস কী ভাবে শোধনবাদের দ্বার উন্মোচিত করছে। বা স্ট্যালিনকে যখন কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে তখন তার বিরুদ্ধে উনি দাঁড়াচ্ছেন। ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে আলোচনাতেও কিন্তু শিবদাস ঘোষ দেখালেন যে এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদের আর একটা নতুন রূপ, যা আমাদের দেশের পরিস্থিতি আলোচনা করতে গেলে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি। এই আলোচনাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এর সাথে যুক্ত করে আমরা যা বলছি, তা হল, নিজেদের জীবনে এই সব তত্তে্বর প্র্যাকটিসটা কেমন হচ্ছে? এই প্রশ্নটা আজকের দিনের বিপ্লবী রাজনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খুব জরুরি। আমরাও আমাদের দল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দেখেছি, আজকের দিনে ব্যক্তিবাদের যে সঙ্কট, দল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যৌথ নেতৃত্বের নীতি যদি অনুসরণ না করা হয়, একটা দলের মধ্যে একটা জীবন্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নেতা-কর্মীদের আদর্শগত চর্চার মধ্যে দিয়ে একটা যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তোলার সংগ্রাম করা না হয়, তা হলে ব্যক্তিবাদকে কেন্দ্র করে দলে একটা ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হয়। এই জায়গা থেকে আমরা মনে করি, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা আমরা আমাদের দলে যতটুকু চর্চা করতে পেরেছি সেটা দলীয় জীবনে আমাদের যেমন সহযোগিতা করে, তেমনই আবার আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও কমিউনিস্ট হিসাবে গড়ে ওঠার জন্য আমাদের নিজেদের যে সংগ্রাম সেই সংগ্রামটাকেও তা প্রভাবিত করে।

আর বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে কমরেড শিবদাস ঘোষের ভূমিকা ও অবদান তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দল ওনাকে সাম্যবাদী আন্দোলনের একজন অথরিটি মনে করে। এই বিষয় নিয়ে আমাদের দলের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে বহু সময়েই, বিশেষ করে ২০১৩ সালে। সেই সময়ে দলের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধেও আমরা সংগ্রাম করেছি। এই অবস্থান থেকে আমরা মনে করি কমরেড শিবদাস ঘোষের জন্মশতবষের্র এই যে আয়োজন তা খুবই প্রয়োজনীয় এবং সে জন্যই আমরা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছি।

প্রশ্নঃ কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা আপনারা যখন জনসাধারণের মধ্যে নিয়ে যান, তখন কী রকম সাড়া পান‍?

উত্তরঃ এটার একটা জীবন্ত প্রমাণ যদি আমরা বলি, তা হলে আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর জায়গা থেকে যদি আমরা দেখি, কারণ মুবিনুল হায়দার চৌধুরী কিন্তু আমাদের দেশে প্রধান নেতা ছিলেন না কখনও, জাসদে তো উনি কোনও পদেই ছিলেন না। বাসদেও উনি দলের প্রধান নেতা ছিলেন না, কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। কিন্তু জাসদের অভ্যন্তরে মতাদর্শগত সংগ্রামের ক্ষেত্রে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকেই সবাই মনে করতেন উনিই আদর্শগত নেতা। বাসদের সবাই মনে করতেন যে আমরা যে আদর্শগত সংগ্রাম করছি, সেই সংগ্রামের নেপথ্য নায়ক হলেন কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী।

সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছিল, তার প্রভাব আমাদের দেশের বামপন্থী আন্দোলনেও সঙ্কট তৈরি করেছিল। অথচ তখন আমাদের দলে হাজার হাজার যুবক-যুবতী এসেছেন, ঘর ছেড়েছেন, দলকেন্দ্রিক জীবনকেই তাঁরা গ্রহণ করবেন, এই জীবনের আহ্বানেই ঘর ছেড়েছেন। এই আকর্ষণটা কিন্তু কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী তৈরি করতে পেরেছিলেন এবং সেটা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে। এই জায়গাটা আমরা মনে করি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের দলের ক্ষেত্রে। অপরাপর বামপন্থী দলগুলো প্রত্যেকেই আমাদের দলের এই সংগ্রামটাকে স্বীকৃতি দেয়। আমাদের দলে এই যে ক্যাডার ভিত্তিক দলকেন্দ্রিক জীবন, বিপ্লবের জন্য একনিষ্ঠ কর্মী গড়ে তোলা, এই চর্চাটা আমাদের দলেই হয়, এটা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে আমরা করতে পারি। এমন ধারার জীবনসংগ্রামের একটা প্রবল আকর্ষণ আছে এটাও আমরা খেয়াল করি। এখন সেটা আমরা আরও ভাল ভাবে খেয়াল করছি। আমাদের দলে সেই অর্থে প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব নেই, খুব পরিচিত নেতৃত্ব নেই। তা সত্তে্বও প্রচুর ছেলেমেয়ে আমাদের দলের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর জীবনসংগ্রামের কথা যতটুকু আমরা নিয়ে যেতে পারছি, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা আমরা যতটুকু নিয়ে যেতে পারছি, আমরা দেখছি তা একটা প্রবল আকর্ষণ তৈরি করতে পারছে।

প্রশ্নঃ অর্থাৎ দলের বাইরেও জনসাধারণের মধ্যে, ছাত্র-যুবদের মধ্যে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাটা আপনারা নিয়ে যাচ্ছেন, তখন সেটা একটা আকর্ষণ তৈরি করছে।

 উত্তরঃ বিশাল আকর্ষণ তৈরি করছে এবং বাংলদেশে বিশেষ করে আমরা যদি বলি, আমরা একটা জায়গা তৈরি করতে পারছি, ইউনিক একটা জায়গা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের এই স্বীকৃতি আছে যে শিক্ষা আন্দোলনে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের বক্তব্য ইউনিক। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের যে বক্তব্য, সেটার যে গ্রহণযোগ্যতা তা প্রত্যেকের কাছে আছে। এই গ্রহণযোগ্যতার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দেশের অন্যান্য বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির সঙ্গে একটা ছেদ আনতে পেরেছি। তা কিন্তু আমরা পেরেছি কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা সম্পর্কিত যে দৃষ্টিভঙ্গি তার় আলোকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই। নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কিত তাঁর আলোচনাগুলো যখন আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়ে যাই, তা তাদের মধ্যে যথেষ্ট আকর্ষণ তৈরি করে এবং এগুলোর একটা স্বীকৃতি আছে।

(বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিষয়ে সাক্ষাৎকারের শেষাংশ নিচের লিঙ্কে দেওয়া হল)

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে বামপন্থীদের গণআন্দোলনই একমাত্র বিকল্প (২)