ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতি সম্পর্কে যাঁরা জেনেছেন তাঁরা এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। আর এক দল মানুষ আছেন যারা এই দুর্নীতি সম্পর্কে ওপর ওপর কিছু খবর শুনেছেন। তার ফলে এটিকে তাঁরা আর পাঁচটি দুর্নীতির মতোই একটি দুর্নীতি ভেবে নিয়ে অতখানি মাথা ঘামাচ্ছেন না। বুঝে উঠতে পারছেন না, একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে এই দুর্নীতি তাঁর জীবনকেও কতখানি সঙ্কটগ্রস্ত করছে এবং করবে।
সংসদীয় দলগুলি প্রায় সবাই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন পুঁজিপতি গোষ্ঠী থেকে টাকা নিয়েছে। ২০১৯ থেকে ’২৪ পর্যন্ত বন্ডের মাধ্যমে নেওয়া টাকার যে হিসাব পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ১২,৭৬৯ কোটি টাকা চাঁদার প্রায় অর্ধেক, ৬০৬০ কোটি চাঁদা পেয়েছে বিজেপি। ১৬১০ কোটি পেয়েছে তৃণমূল, কংগ্রেস পেয়েছে ১৪২২ কোটি। অর্থাৎ যারা কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় রয়েছে তারা বেশি পেয়েছে, অন্যরাও নানা অঙ্কের টাকা পেয়েছে।
এ কথা স্পষ্ট যে, সংসদীয় তথা ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলি পুঁজিপতি শ্রেণির টাকাতেই চলে। অর্থাৎ তাদের পার্টির খরচ চালানো, নেতাদের বিলাস-বৈভব এবং নির্বাচনে অঢেল যে খরচ তারা করে তা সবই আসে পুঁজিপতি শ্রেণির থেকে। ফলে বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এই সব দলগুলি পুঁজিপতিদের কথাতেই ওঠে-বসে। তাদের স্বার্থেই কাজ করে, নীতি-নিয়ম-পদক্ষেপ সব তাদের স্বার্থেই গ্রহণ করে। এর ফলে জলাঞ্জলি যায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থ। ইলেক্টোরাল বন্ডের মধ্যে দিয়ে এই পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়াটাকেই আড়াল করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে যা শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্যে এসেছে। এখন দেখা যাক, এই গোপন লেনদেন কী ভাবে জনজীবনকে প্রভাবিত করে।
বন্ড দুর্নীতি ও ওষুধের দামবৃদ্ধি
ওষুধ কোম্পানিগুলির কথাই ধরা যাক। নির্বাচন কমিশনের ১৪ মার্চ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ৩৫টি ওষুধ কোম্পানি বন্ডের মাধ্যমে তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলগুলিকে দিয়েছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি পেয়েছে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি। কেন দিয়েছে? সম্প্রতি ৮০০টি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের দাম বাড়ানোর ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওষুধের দাম যথেচ্ছ বাড়ানোর সুযোগ কোম্পানিগুলি দিয়েই রেখেছে তারা। এ ছাড়া দেখা যাচ্ছে, ৭টি বড় কোম্পানি ওষুধের গুণমান পরীক্ষায় ফেল করার পরেই বন্ড কিনে টাকা দিয়েছে এবং যথারীতি ফেল করা ওষুধগুলো বাজারে রমরমিয়ে চলছে। এ নিয়ে বিস্তৃত ভাবে লেখা হয়েছে গত সংখ্যা গণদাবীতে।
এর ফল কী হয়েছে? আমরা যারা দেশের সাধারণ মানুষ তাঁরা বাজার থেকে চড়া দামে কিনে নিম্নমানের ওষুধ খেতে বাধ্য হচ্ছি। ফলে হয় রোগ সারছে না, না হলে সারতে দীর্ঘদিন সময় লাগছে। বহু মানুষ এই সব নিম্নমানের ওষুধ খেয়ে মারা যাচ্ছেন। মানুষের চিকিৎসা খরচের ৭০ থেকে ৮০ ভাগই খরচ হয়ে থাকে ওষুধ বাবদ। দেশের বাজার ইতিপূর্বেই নিম্নমানের এবং ক্ষতিকর ওষুধে ভর্তি হয়ে রয়েছে। পৃথিবীর মধ্যে এইসব ক্ষতিকর ওষুধের বৃহত্তম বাজার হিসেবে ভারত চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। সেখানে নির্বাচনী তহবিলে ঘুরপথে ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বিপুল অঙ্কের টাকা ঘুষ দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের কমপক্ষে ৩৫টি বৃহৎ ওষুধ কোম্পানির অসাধু ব্যবসার লাইসেন্স আজ আরও পাকাপোক্ত হল। পাশাপাশি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ওষুধ সরবরাহ বিপুল ভাবে কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মানুষকে আজ বাধ্য করা হচ্ছে চড়া দামে বাজার থেকে নিম্নমানের ওষুধ কিনতে। ফলে আজ আমরা কেউ মনে করতে পারি না যে, ও ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে যা হচ্ছে হোক, আমার তাতে কিছু যায় আসে না।
বন্ড দুর্নীতি ও বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি
এ বার আসা যাক বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলির বন্ড কেনার কথায়। এ রাজ্যে বিদ্যুতের একচেটিয়া ব্যবসা করছে সিইএসসি। এই সংস্থাটি আরপিজি-সঞ্জীব গোয়েঙ্কা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছিল সিপিএম সরকার। এই গোয়েঙ্কা গোষ্ঠী তাদের নানা শাখা-কোম্পানিগুলি মিলিয়ে বন্ডে তৃণমূলকে দিয়েছে ৪৪৪ কোটি টাকা। এই গোষ্ঠীর বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি হলদিয়া এনার্জি তৃণমূলকে দিয়েছে ২৮১ কোটি টাকা। আর এক শাখা কোম্পানি ধারিওয়াল ইনফ্রাস্ট্রাকচার দিয়েছে ৯০ কোটি, পিসিবিএল দিয়েছে ৪০ কোটি, ক্রিসেন্ট পাওয়ার দিয়েছে ৩৩ কোটি টাকা। এই টাকা দেওয়ার ফল কী, পশ্চিমবঙ্গবাসী তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল সরকার নানা কায়দায় গ্রাহকদের বিলের অঙ্ক ১৪ বার বাড়িয়েছে। তাই বিদ্যুতের দাম দেশের মধ্যে এ রাজ্যে এতখানি চড়া। আবার কয়লার দাম যখন অর্ধেক হয়ে গেল এবং জিএসটি কমে ৫ শতাংশ হল, এর ফলে যখন বিদ্যুতের দাম কমে অর্ধেক হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, তখনও দ্বিগুণ দাম জনগণের ঘাড় ভেঙে দিব্যি আদায় করে চলেছে সিইএসসি। অর্থাৎ শাসক দলের ফান্ডে টাকা ঢালো আর যত খুশি দাম বাড়াও। আবার যেহেতু গোয়েঙ্কারা দেশ জুড়ে এবং বিদেশেও ব্যবসা করে তাই বিজেপিকেও তারা বঞ্চিত করেনি। হলদিয়া এনার্জি বিজেপিকে দিয়েছে ৮১ কোটি টাকা।
লটারির রমরমা
লটারি ব্যবসার ‘মুকুটহীন সম্রাট’ স্যান্টিয়াগো মার্টিনের সংস্থা ফিউচার গেমিংয়ের কথাই ধরা যাক। এই সংস্থাটিই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে সবচেয়ে বেশি টাকা দিয়েছে (১৩৬৮ কোটি টাকা)। এরা তৃণমূলকে দিয়েছে সব চেয়ে বেশি– ৫৪২ কোটি টাকা। উল্লেখ্য এ রাজ্যে ফিউচার গেমিংয়ের লটারির রমরমা ব্যবসা। অন্য যে রাজ্যগুলিতেও তারা চুটিয়ে ব্যবসা করছে সে রাজ্যের শাসক দলগুলি যেমন তামিলনাড়ূর ডিএমকে পেয়েছে ৫০৩ কোটি, অন্ধ্রপ্রদেশের শাসক দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস পেয়েছে ১৫৪ কোটি টাকা। অন্য দিকে ফিউচার বিজেপিকে দিয়েছে ১০০ কোটি টাকা, কংগ্রেসকে ৫০ কোটি টাকা।
এ কথা আজ কে না জানে যে, একেবারে দরিদ্র মানুষটি পর্যন্ত তার আয়ের একটা ভাল অংশ লটারির পিছনে খরচা করে। সবাই জানেন, সামান্য কয়েক জন লটারিতে টাকা পায়, বহুগুণ বেশি মানুষ টাকা হারায়। লটারি ব্যবসা থেকে যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করলে শাসক দলগুলিকে এমন দেদার ঘুষ দেওয়া যায় সেই টাকা তো বাস্তবে দেশের গরিব-সাধারণ মানুষেরই টাকা।
ঘুষের বিনিময়ে অযোগ্য সংস্থাও কাজের বরাত পেয়েছে
নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, কর্পোরেট সংস্থাগুলি শাসক দলগুলিকে টাকা দিয়ে বিপুল পরিমাণ কাজের বরাত জোগাড় করেছে। প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, ৩৮টি কর্পোরেট গোষ্ঠী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে অনুদান দিয়ে ১৭৯টি বড় কাজের বরাত বা প্রকল্পে কাজ শুরুর অনুমতি পেয়েছে। সেই কাজের অর্থমূল্য ৩.৮ লক্ষ কোটি টাকা। তার বদলে তারা বন্ডের মাধ্যমে ২,০০৪ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছে। আর একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ৪১টি কর্পোরেট সংস্থায় ৫৬ বার ইডি, সিবিআই ও আয়কর দফতর হানা দিয়েছে। তারা বিজেপিকে বন্ডের মাধ্যমে ২,৫৯২ কোটি টাকা দিয়েছে। তার মধ্যে ১,৮৫৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা হানার পরে। রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলি যে সরকারি প্রকল্পের বরাত পেয়েছে, সেই প্রকল্পের টাকা সাধারণ মানুষের দেওয়া করের টাকা থেকেই এসেছে। তা ছাড়া এ ভাবে টাকা দিয়ে বহু অযোগ্য সংস্থা কাজের বরাত জোগাড় করেছে। এর ফল হিসাবে, সংস্থাগুলি যে কাজ করছে তা যেমন নিম্নমানের তেমনই রাস্তা, ব্রিজ, অন্যান্য নানা নির্মাণ কাজ করতে করতে বা কাজ শেষ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই ভেঙে পড়ছে।
স্বচ্ছ ভোট প্রক্রিয়া ব্যাহত করছে পুঁজিপতিদের টাকা
সব শেষে আসা যাক, ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা ভোটে খরচ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে। বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল সহ শাসক দলগুলি ভোটের সময় যে দেদার টাকা প্রচারের পিছনে খরচ করে, টাকা ছড়িয়ে ভোট কেনে, উপহারের নাম করে বহুমূল্যের সামগ্রী ভোটারদের হাতে তুলে দেয়, সেই টাকা তো পুঁজিপতিদের থেকে এই ভাবে পাওয়া। দেখা যাচ্ছে, একটি দল যত দুর্নীতিগ্রস্ত হোক, তার নেওয়া নীতিগুলি যত জনস্বার্থবিরোধী তথা মালিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী হোক, ভোটের সময় টাকা দিয়ে টিভিতে, খবরের কাগজে, সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের জৌলুসে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে, মদ-মাংস থেকে শুরু করে নানা অঙ্কের টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিতে যাচ্ছে। এর ফলে ভোটে প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটছে না। আবার এই ভাবে টাকা ছড়িয়ে যুব সমাজের একটি অংশকে তারা যেমন ভোটের প্রচারে ব্যবহার করছে, তেমনই ভোটের দিন জাল ভোট দিতে, বুথ জ্যাম করতে, এলাকায় সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করতে ব্যবহার করছে। এর ফলে যে নির্বাচনকে গণতন্ত্রের উৎসব বলা হয়, সেখানে জনগণের অংশগ্রহণই সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হয়। অন্য দিকে, যে দল সততার সঙ্গে, নীতির ভিত্তিতে জনগণের স্বার্থ নিয়ে লড়াই করতে করতে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, প্রচারের জৌলুসে তারা চাপা পড়ে যাচ্ছে। ফলে জনগণ না চাইলেও জনস্বার্থের প্রতিনিধিদের পরিবর্তে দুর্নীতিগ্রস্ত, জনস্বার্থবিরোধী প্রতিনিধিরাই নির্বাচিত হচ্ছে। তাই সচেতন প্রতিটি নাগরিক ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতিতে গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। এই দুর্নীতিতে জড়িত প্রতিটি দলকে পরাস্ত করা আজ সচেতন নাগরিক মাত্রেরই দায়িত্ব।