‘নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে, নৈতিক অধঃপতন হচ্ছে’, বলে বক্তৃতাবাজি করলেই কি এসব দূর হবে? না, দূর হয় না। তা হলে এ সবের কারণ কী? এক কথায় বললে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা, শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা এর মূল কারণ। কিন্তু তাই বলে এটা অদৃষ্টবাদ নয়, যেন তা ঘটবেই! শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা থেকেই এসব অধোগতি আসছে। এ সমাজ যারা শাসন করছে, চালাচ্ছে, তাদের এই সমাজ থেকে যথেষ্ট লাভ হচ্ছে, এর থেকে সবরকম সুবিধা ভোগ করছে, তাই তারা এটা আর পাল্টাতে চায় না। কাজেই জ্ঞান-বিজ্ঞান, নীতি-নৈতিকতার সাধনার তাদের দরকার নেই, বরং এগুলিকে তারা ভয় পায়। তারা এখন ‘ঐতিহ্য’ ‘ঐতিহ্য’ করে, আর যে করে হোক, লোককে ঠকিয়ে যে ক’দিন পারে লুঠ করে যেতে চায়। কিন্তু বিরুদ্ধ শক্তি যেটা সমাজের মধ্যে আছে, সেটার তো একটা ক্রিয়া থাকবে। সেই বিরুদ্ধ শক্তিটা যদি সঠিক রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলত এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ঠিক মতো পালন করত, তা হলে সমাজে এই যে নৈতিক অবনমন ঘটছে, তার ওপর সংযম রক্ষাকারী একটা প্রভাব পড়ত। যেমন, এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন। আমি বলব, এ স্বাধীনতা আন্দোলনে হাজার একটা ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। … সেই সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মোসাহেবি করে এক দল গোলামির মনোভাবকে বাড়িয়ে দিয়ে গেল। অন্য দিকে ছিল এ দেশের পুরনো ধুঁকে পড়া সামন্তী সমাজ– ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা, জাতপাত, কুসংস্কারে অন্ধ একটা সমাজ– যার মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও সেই জাতি, তার যুব সম্প্রদায়ের একটা বিরাট অংশ যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের ভাবধারা, অর্থাৎ মানবতাবাদী ভাবধারা, গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা, বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, সেই চেতনা যত আধখেঁচড়া অবস্থায়ই থাকুক, তার প্রভাব যতটুকু তাদের উপর পড়েছিল, তাতে এই যুবকেরা চনমন করে জেগে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একটা নতুন জীবনীশক্তির সৃষ্টি হয়েছিল। তারা ‘কেরিয়ার’ নষ্ট করে বেরিয়ে এসেছিল। তারা ফাঁসির ভয় করেনি। তারা লড়েছে সমাজের সামগ্রিক স্বার্থের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য, দেশের মুক্তির জন্য। …
স্বাধীনতা আন্দোলনের কত ত্রুটি, তা ছিল ধর্মভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলন, তা হিন্দু-মুসলমানকে এক করতে পারেনি, তা বিভিন্ন জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও গোষ্ঠীর মানুষকে একটা জাতি হিসাবে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। তাই আমরা রাজনীতির ক্ষেত্রে এক জাতি হলেও আজও বাঙালি, ওড়িয়া, বিহারি, তেলেগু, কানাড়ি, পাঞ্জাবি, হরিয়ানি– এইভাবে ভাগ হয়ে গেছি এবং এ এক ভীষণ ভাগ, কিছুতেই একে দূর করা যাচ্ছে না। … আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বিপ্লববিরোধী আপসমুখী ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের এতসব ত্রুটি সত্ত্বেও তদানীন্তন প্রচলিত ভাবধারাগুলোর মধ্যে এবং প্রচলিত সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর মধ্যে একটা আপেক্ষিক প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল বলে তার সংস্পর্শে কুঁকড়ে যাওয়া, মেরুদণ্ড বেঁকে ঝুঁকে-পড়া জাতির যুবকরাও অমিত তেজে খাড়া হয়ে গিয়েছিল। সেইসময় ‘পরীক্ষায় টুকতে দিতে হবে’ এ ধরনের অদ্ভুত দাবির কথা কেউ ভাবতে পারেনি। তা হলে সমাজে বিরুদ্ধ আদর্শে পরিচালিত আন্দোলনের শক্তির একটা ভূমিকা আছে বৈকি।
তাই কংগ্রেসি রাজনীতি ও পুঁজিবাদী শোষণের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ পুরনো ভাবনা-ধারণা, পরম্পরা, চিন্তা, ঐতিহ্যবাদ, জাতপাতের মানসিকতা জাতিকে যতই কূপমণ্ডুক করে তোলার চেষ্টা করুক এবং যতই অধঃপতন আনবার চেষ্টা করুক, কংগ্রেসবিরোধী বামপন্থী আন্দোলনের শক্তির আদর্শগত ভিত্তি যদি মজবুত থাকত, নীতি-নৈতিকতার ধারণা যদি উঁচু থাকত, শুধু বড় বড় ধার করা কথা যদি না থাকত, তা হলে তার উপর তো একটা সংযম নিশ্চয়ই থাকত। তাই আমি প্রশ্ন করেছিলাম যে, পশ্চিমবাংলায় যখন যুব সমাজের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের সমর্থক প্রবল বেড়ে গেল, তখন যুবকদের নৈতিক মানের অধোগতির় উপর তার তো একটা প্রভাব পড়বে। সেখানে তো একটা সংযম আসবে। বুঝে হোক, না বুঝে হোক, একটা বড় জিনিসের চর্চা করতে থাকলে তার প্রভাবে মানুষ খানিকটা উন্নত হয়। তা না হলে বুঝতে হবে, তাদের রাজনীতির মধ্যে কোথাও একটা বিরাট গলদ আছে। কারণ, এই রাজনীতিতে সকলে লাফাতে লাফাতে আসে, এসেই কোমর দোলাতে থাকে, উচ্ছৃঙ্খল হয়, কাপুরুষের মতো আচরণ করে, হিংসা মারামারির ঝোঁক বাড়ে, দায়িত্ববোধ চলে যায়, কর্তব্যে অবহেলা বাড়ে। এ কী কথা! তাদের সংস্পর্শে মানুষ যেমন লড়তে আসবে, তেমন কাপুরুষোচিত আচরণকে ঘৃণা করতেও তো শিখবে, তাদের রাজনীতির স্পর্শ নৈতিক অবনমনের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে। কই, তা তো হচ্ছে না! তা হলে? তা হলে কোথাও একটা বিরাট গলদ আছে। সেই গলদটা আমরা দেখাবার চেষ্টা করছি।
আমরা তার জন্য বলছি, শুধু পুঁজিবাদকে দোষ দিলে হবে না। পুঁজিবাদের এই যে অবক্ষয়, তাকে রোখবার জন্য বিরুদ্ধ শক্তির যে ভূমিকা সেটাও বিচার্য বিষয়। কারণ, যার বিরুদ্ধে লড়তে হবে, তার চরিত্র তো উদঘাটিত। তাই সচেতনভাবে কংগ্রেসও বলে না যে, সে পুঁজিবাদের সেবা করবে। সেও লজ্জা পায় এ কথাটা খোলাখুলি বলতে। তাকেও ঘোমটার আড়াল নিয়ে বলতে হয়, সে সমাজতন্ত্র আনবে, পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করবে, পুঁজিবাদের সেবা করবে না। তো এ হেন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ঘন্টার পর ঘন্টা বত্তৃতা করার দরকার নেই। যদিও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শুধু ভাসাভাসা দু-একটা কথা বুঝলেও হবে না। তাকে আঘাত করে ফেলে দিতে হলে তার সম্বন্ধে কতকগুলো কথা বুঝতে হবে। সে সম্পর্কেও আমি কিছু কথা বলব।
যে পুঁজিবাদী দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষ আজ ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হঠাতে চাইছে এবং জনগণের স্বার্থের অনুকূলে একটা রাজসত্তা কায়েম হওয়া দরকার বলে মনে করছে, সেখানে যেটা দেখা দরকার, সেটা হচ্ছে যে, যারা এটা করবে বলছে, তাদের রাস্তা ঠিক কি না। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করে, ‘বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, আপনি তো সি পি আই, সি পি আই (এম) প্রভৃতি বামপন্থীদের বেশি সমালোচনা করেন।’ আমি বলি, হ্যাঁ, করিই তো। করি এই কারণে যে, লড়াই কার বিরুদ্ধে করতে হবে, জনতা মোটামুটি তার অভিজ্ঞতা থেকে বোঝে। কিন্তু লড়াইয়ের রাস্তা কোন পথে, সেইখানে এই সমস্ত দলগুলো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
স্বাধীনতার পর দেশে কত লড়াই হল। একদিকে লড়াইয়ে মানুষ মরছে, কোরবানি হচ্ছে, তারপরে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে? হতাশা আসছে, আর সাময়িক সেই হতাশার সুযোগে পুঁজিবাদ এবং তার শাসক দল শক্তিশালী হচ্ছে। কংগ্রেস যখন ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেল, তখন যে বিরাট গণপ্রবাহ সারা ভারতবর্ষে এল, তাকে তারা ঠিক রাস্তায় প্রবাহিত করতে পারল না। কাজেই আন্দোলনের সামনে নেতৃত্বের প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু আন্দোলন করলে হবে না, শুধু বামপন্থী ঐক্য বললে হবে না। ঐক্য তো হয়, কিন্তু ঐক্য থাকে না কেন? ঐক্য কী করে থাকতে পারে? ঐক্য রাখবার জন্য সেই-ই চেষ্টা করবে, যে যথার্থ বিপ্লব চায়, পরিবর্তন চায়, লড়াইটাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তারা ‘বিপ্লব বিপ্লব’ খেলা করে, বিপ্লব করতে চায় না।
আমিও বিপ্লব বলি, তারাও বিপ্লব বলে, খাঁটিরাও বলে, মেকি বিপ্লবীরাও বিপ্লব বলে। সকলেই বলে, সংসদীয় রাজনীতিকে বিপ্লবের জন্য ব্যবহার করবে, তার জন্য তারা সরকারে যায়। বিচার তো করতে হবে যে, কে শুধুই বলছে, আর কে সত্যিই করছে! কে বিপ্লবটা সত্যিই মনে করে, আর কে বিপ্লবটা ভাঙিয়ে খেতে চায়! জনসাধারণের মধ্যে এই পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা তো তৈরি করতে হবে।
এইগুলো বিচারের জন্য এসে যায় নেতৃত্বের প্রশ্ন। সেটা বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রশ্ন, জনগণের আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রশ্ন। সেটা সংসদীয় গণতন্ত্রের নেতৃত্বের প্রশ্ন নয়। কাজেই এই আন্দোলনগুলোর সামনে এবং জনসাধারণের সামনে যারা নানারকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে রেখেছে, তাদের সম্বন্ধে সমালোচনা স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে। আমি তাদেরও বলি, আমাদের রাজনীতি সম্পর্কে সমালোচনা কর। বলি, রাজনীতি নিয়ে সমালোচনা কর, কিন্তু গালাগালি কোরো না। যা নয়, তা বোলো না। যা বলি, সেটাকে তুলে ধরে দেখিয়ে দাও, আমাদের কোথায় ভুল। যদি ভুল থাকে, মেনে নেব। যদি না মানি, আমাদের তারা পরিত্যাগ করবে, আর কোনও কথা শোনার দরকার নেই। আর আমরা তাদের রাজনীতি সম্পর্কে যে প্রশ্ন তুলেছি, তারা তার জবাব দিক। যদি জবাব দিতে না পারে, তা হলে তা মেনে নিক।
উন্নত নৈতিক মান ও সঠিক রাস্তায় লড়াই চাই, শিবদাস ঘোষ নির্বাচিত রচনাবলি, পঞ্চম খণ্ড