২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন থেকে বিজেপি যে বিপুল পরিমাণ টাকা ঢেলে জনমতকে প্রভাবিত করে আসছে তা সবাই জানেন। কিন্তু সেই টাকা তো জনগণ তাদের দেয়নি! তা হলে কোথা থেকে সেই টাকা তারা পেল, তা দেশের মানুষের কাছে একটি গুরুতর প্রশ্ন হিসাবে ছিল। নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতি সেই প্রশ্নের উত্তরটি প্রকাশ্যে এনেছে। এখনও পর্যন্ত নির্বাচনী বন্ডের তথ্য থেকে বিজেপির অন্তত পাঁচ রকম দুর্নীতির কৌশল প্রকাশ পেয়েছে।
১। কুইড প্রো কুও বা লেনা-দেনা পদ্ধতিঃ
বেশ কিছু কোম্পানি নির্বাচনী বন্ডে দান করেছে এবং তারপরই সরকারের থেকে বিশাল সুবিধা পেয়েছে। যেমন–
ক। মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রা। এরা নির্বাচনী বন্ড মারফত দিয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এপ্রিল, ২০২৩-এ দিয়েছে ১৪০ কোটি এবং মাত্র এক মাস পরেই ১৪,৪০০ কোটি টাকার থানে-বরিভালি টুইন টানেল প্রকল্প হাতে পেয়েছে।
খ। জিন্দাল পাওয়ার। এরা ৭ অক্টোবর ২০২২-এ দিয়েছে ২৫ কোটি টাকা, এবং মাত্র তিন দিন পর ১০ অক্টোবর গারে-পালমা কয়লা খনির বরাত পেয়েছে। এমন আরও আছে।
২। তোলা আদায় পদ্ধতিঃ
এই কৌশলটি চিরপরিচিত। প্রথমে ইডি-সিবিআই-আইটি-র মাধ্যমে টার্গেট কোম্পানিতে অভিযান চালানো হয়, তারপর কোম্পানি ইলেক্টোরাল বন্ড মারফত অনুদান দেয় নিজেদের বাঁচাতে। দেখা যাচ্ছে, শীর্ষ ৩০ জন দাতার মধ্যে অন্তত ১৪ জনের বিরুদ্ধে এ রকম অভিযান হয়েছে।
ক। হেটেরো ফার্মা এবং যশোদা হাসপাতালের মতো কোম্পানি ইডি-সিবিআই-আইটির ক্রমান্বয় আক্রমণের পর অনেক বার অনুদান দিয়েছে। যতবার হানা, ততবার অনুদান।
খ। আইটি বিভাগ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শিরডি সাই ইলেক্ট্রিক্যালসে অভিযান চালায়। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তারা নির্বাচনী বন্ডে ৪০ কোটি টাকা দেয়।
গ। ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেলস দিয়েছে ১২০০ কোটি টাকা। এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তারা সবচেয়ে বড় দাতা। এখানে ঘটনাক্রম এ রকম–
২ এপ্রিল ২০২২- ইডি ফিউচারে অভিযান চালায়। ৫ দিন পরে (৭ এপ্রিল) তারা দেয় ১০০ কোটি টাকা। অক্টোবর ২০২৩- আইটি বিভাগ ফিউচারে অভিযান চালায় এবং একই মাসে তারা দেয় ৬৫ কোটি টাকা। এমন উদাহরণ আরও আছে।
৩। কিকব্যাক পদ্ধতি-
তথ্য থেকে আরও একটি নকশা উঠে এসেছে, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে কিছু সুবিধা পাওয়ার পরপরই কোম্পানিগুলি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজানুগ্রহের দাম চুকিয়েছে।
ক। বেদান্ত- ৩ মার্চ ২০২১-এ রাধিকাপুর পশ্চিমে কয়লা খনি পেয়েছিল। পরের মাস এপ্রিলে তাঁরা দিলেন নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকা।
খ। মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রা- ২০২০ সালের আগস্টে পেয়েছে ৪৫০০ কোটি টাকার জোজিলা টানেল প্রকল্প। অক্টোবরে জোজিলা বন্ডে দিয়েছে ২০ কোটি টাকা। মেঘা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিকেসি বুলেট ট্রেনস্টেশনের চুক্তি পায়। একই মাসে ৫৬ কোটি টাকা দেয়। উদাহরণ আরও আছে।
৪। শেল কোম্পানির মাধ্যমে বন্ডে টাকাঃ
আগে কোম্পানির লাভের একটি ছোট শতাংশই দান করা যেত। ইলেক্টোরাল বন্ড এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দূর করেছে। শেল কোম্পানিগুলির কালো টাকা দান করার পথ প্রশস্ত করেছে। শেল কোম্পানি মানে খোলস কোম্পানি। মানে খোলস আছে, শাঁস নেই। নাম আছে, কিন্তু আসলে কোম্পানিটির কোনও অস্তিত্ব নেই।
এ রকম অনেক সন্দেহজনক ঘটনা পাওয়া গেছে। যেমন, ৪১০ কোটি টাকা দান করেছে কুইক সাপ্লাই চেন লিমিটেড, যার সম্পূর্ণ শেয়ার মূলধন মাত্র ১৩০ কোটি! দানের টাকা যে আসলে অন্য কোনও বৃহৎ পুঁজিমালিক জোগাচ্ছে, বুঝতে অসুবিধা হয় কি?
৫। একের নামে অন্যের টাকা দেওয়ার পদ্ধতিঃ
যেমন, লক্ষ্মীদাস বল্লভদাস মার্চেন্ট। ইনি একাই ২৫ কোটি দিয়েছেন। কোত্থেকে পেলেন? ইনি ব্যবসায়ী নন। লিংকডিনে ফেলে দেখা যাচ্ছে, ইনি রিলায়েন্সের ছটি কোম্পানির ডাইরেক্টর। তা হলে টাকা কি ইনি দিয়েছেন, নাকি আম্বানিরা? এ রকম আরও বহু ধনকুবের রয়েছেন গৌরী সেনের ভূমিকায়।
নির্বাচনী বন্ডের তথ্য বিশ্লেষণ চলতে থাকলে বিজেপির আর্থিক দুর্নীতির এ রকম আরও অনেক প্রকরণস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
(সূত্রঃ রিপোটার্স কালেক্টিভ)