১৫ এপ্রিল কলকাতায় দলের কেন্দ্রীয় দফতরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেন, ১৯ এপ্রিল থেকে যে সাধারণ নির্বাচন হতে চলেছে তাতে আমরা এ রাজ্যে ৪২টি আসন সমেত ১৯টি রাজ্য ও ৩টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মোট ১৫১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি, যা একক বামশক্তি হিসাবে সবচেয়ে বেশি রাজ্যে সবচেয়ে বেশি আসন। কিন্তু সিপিএম ‘ইন্ডিয়া’ নামক জোটের অন্তর্ভুক্ত হয়ে দক্ষিণপন্থী শক্তির হাতেই মূলত নিজেকে সমর্পণ করেছে। একমাত্র আমরাই গণআন্দোলনের শক্তি হিসাবে গোটা দেশে বিপ্লবী বামপন্থার ঝান্ডাকে ঊর্ধ্বে তুলে রেখেছি।
এ রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস বাস্তবে নিম্নতম স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এই দল অতীতে কংগ্রেস, পরবর্তী কালে সিপিএমের ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করছে, আন্দোলনের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করছে, পুলিশ, প্রশাসন, সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনী ও টাকার জোরে ভোট জালিয়াতি করে এবং দল-বদলের নিকৃষ্টতম রাজনীতির মধ্যে দিয়ে পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে সংসদীয় গণতন্ত্রের সমস্ত স্তরকে বিরোধী-মুক্ত করার উন্মত্ত খেলায় নেমেছে। শিক্ষক নিয়োগ ও অন্যান্য নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, পঞ্চায়েতের সুযোগ-সুবিধা বণ্টনে দুর্নীতি, জব-কার্ডের মজুরি দুর্নীতি ইত্যাদি হাজার দুর্নীতিতে এই দলের নেতারা অভিযুক্ত।
বিজেপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভ্রষ্টাচার-মুক্ত’ ভারত প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন যে বিজেপি সমস্ত বৃহৎ বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে ইডি, সিবিআই, এনআইএ প্রভৃতি কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে নগ্নভাবে ব্যবহার করছে, সেই বিজেপি ইলেক্টোরাল বন্ডের ৬০৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ‘বিশ্বের বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারি’-তে জড়িত, ‘পিএম কেয়ারস’ ফান্ডের কোনও হিসাব দেয়নি, মধ্যপ্রদেশের ‘ব্যাপম’ কেলেঙ্কারির মতো নিকৃষ্টতম দুর্নীতির সঙ্গে এই দল জড়িত। অভিযোগ, ২০১৯-এ পুলওয়ামা বিস্ফোরণের ঘটনায় সিআরপিএফ জওয়ানদের প্রাণহানির আশঙ্কা জানা থাকা সত্ত্বেও বিজেপি সরকার চুপ করে ছিল যাতে এই ঘটনাকে ভোটে ব্যবহার করা যায়। তিনি বলেন, কালো টাকা উদ্ধারের কথা শুনিয়ে নোট-বন্দির নামে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির জন্য প্রধানমন্ত্রী সরাসরি দায়ী।
তিনি আরও বলেন, বিরোধীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে ব্যবহারের ধারা সৃষ্টি করার মূল হোতা কংগ্রেস। এই কংগ্রেস ’৭৫ সালে জরুরি অবস্থা সহ নানা কালাকানুন জারি করেছে। ভাগলপুর, নেলিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, শিখ-গণহত্যার মতা নিকৃষ্ট কাজে এরা যুক্ত ছিল। বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে বর্তমান রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ বপন রাজীব গান্ধীর উদ্যোগেই ঘটেছিল। এ রাজ্যে ’৭২-’৭৭ সালে সিপিআই(এম)-এর দাবি অনুযায়ী তাদের ১১০০ কর্মীকে খুন এবং দমদম-কাশীপুরে গণহত্যা কংগ্রেসই করেছে। এ দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েমের শুরু কংগ্রেসের হাত ধরেই। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ৩০ বছর দীর্ঘ অপশাসনের বিরুদ্ধে এ রাজ্যে বহু রক্তের বিনিময়ে বামপন্থী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সেই কংগ্রেসের গায়ে ‘গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ’ লেবেল লাগিয়ে কেবল কয়েকটি সিটের স্বার্থে সিপিআই(এম) তাদের সঙ্গে জোট করে বামপন্থাকে কালিমালিপ্ত করল। বিজেপি-কংগ্রেস-তৃণমূলের জনবিরোধী রাজনীতিকে পরাস্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী আন্দোলন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত ৫ এপ্রিল বর্ষীয়ান নেতা কমরেড বিমান বসু সাংবাদিক সম্মেলনে ‘ইলেক্টোরাল পলিটিক্সে বামফ্রন্টের সঙ্গে এসইউসি যাবে না’ বলে যা বলেছেন তা বিস্ময়কর। এমন কোনও ঘোষিত নীতি আমাদের নেই। এ কথা ঠিক, তিনি আমাকে এই নির্বাচনে একত্রে কিছু করা যায় কি না এই প্রসঙ্গে ফোন করলে আমি যেহেতু নিজে বাইরে ছিলাম তাই পরে আলোচনার কথা বলি। তারপরে কোনও রকম যোগাযোগ ওঁরা করেননি। অথচ তিনি প্রেসের সামনে এমন কথা বলে দিলেন যা তাঁর মতো প্রবীণ নেতার কাছে প্রত্যাশিত ছিল না।
তিনি বলেন, ভোটের বাজারে বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূলের মতো দলগুলি একে অপরের প্রতি কুকথা বর্ষণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বামপন্থী রাজনীতির পীঠস্থান এই রাজ্যে অতীতে নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক বিতর্কের একটা পরিবেশ থাকত। দিনের পর দিন সেই পরিবেশ কলুষিত হচ্ছিল। কিন্তু এ বছরের নির্বাচনে তা নজিরবিহীন তলানিতে নামল। অন্য দিকে শাসক তৃণমূল প্রশাসনকে ব্যবহার করে নানা কেন্দে্র ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে, দিনের পর দিন তা বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া সুষ্ঠু ভোট পরিচালনার প্রতিশ্রুতি ব্যাহত হচ্ছে। আমরা এই বিষয়ে কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেন, বামপন্থার নামে যে ভোটসর্বস্ব সুবিধাবাদী রাজনীতি চলছে সেই ‘রিফর্মিস্ট’ বামপন্থার বিপরীতে এস ইউ সি আই কমিউনিস্ট-ই একমাত্র বিপ্লবী বামপন্থার ঝান্ডাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। জনসাধারণ, বিশেষ করে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষের উদ্দেশে তিনি দলের এই বক্তব্য উপলব্ধি করা এবং এস ইউ সি আই কমিউনিস্ট প্রার্থীদের সমর্থন করার আহ্বান জানান।