দর্শন বলতে কী বুঝি (২)

 

গত সংখ্যায় দর্শন সম্পর্কে যে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে সাধারণভাবে দর্শনের বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আলোচনা করে দেখানো হয়েছে যে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিশেষ বিশেষ সত্যগুলির অন্তর্নিহিত সাধারণ যোগসূত্রটি খুঁজে বের করে তার ভিতর থেকে জগৎ সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে যে সাধারণ ধারণা গড়ে ওঠে, সেই সামগ্রিক ধারণা, সেই সাধারণ সত্যের উপলব্ধিই হচ্ছে দর্শন। এর পরবর্তী আলোচনা প্রকাশ করা হল। –সম্পাদক গণদাবী

(২)

আমরা দর্শনের সংজ্ঞা ঠিক করতে গিয়ে বলেছি, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান বা মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যে তত্ত্ব (থিওরি) বা নিয়ম (ল) আবিষ্কৃত হচ্ছে, সেই সমস্ত তত্ত্ব এবং নিয়মগুলির মধ্য থেকে বস্তু জগতের সাধারণ (কমন) নিয়ম বা তত্ত্বগুলি খুঁজে বের করার কাজটি হচ্ছে দর্শনের এক্তিয়ারভুক্ত।

পদার্থবিদ্যা আমাদের কী দেখায়? এই দুনিয়ার যাবতীয় পদার্থ–তা সে ইট-কাঠ-লোহা-পাথর বা আলো-হাওয়া-জল-আগুন যাই হোক না কেন– এই সমস্ত জিনিসকে আমরা যেমনটি দেখেছি, ঠিক তেমনটি সামনে ধরে রেখে তাদের পদার্থগত রূপের বর্ণনা দেয়, শব্দ, আলো, তাপ চৌম্বক ও অপরাপর শক্তির চরিত্র এবং বস্তু জগতের গতির (মোশন) সন্ধান বাতলায় আর তাদের এই ব্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে একটাকে অন্যটা থেকে আলাদা করে চিনতে শেখায়।

পদার্থ বিজ্ঞানী যখন পদার্থের বাইরের চাল-চলন মেজাজ-মর্জির তত্ত্ব তালাশে ব্যস্ত, তখন রসায়ন শাস্ত্রী সেই সব পদার্থের অন্তরের মতিগতির হদিশ খুঁজে বেড়ান। সব খোঁজ খবর নেওয়া শেষ করে তিনি লিখতে বসেন রসায়ন শাস্ত্র– ছোটবড়, হাল্কা-ভারী, সব পদার্থের অন্তরের কথা; একের সঙ্গে অপরের বিরহ মিলনের অন্তহীন কাব্য কাহিনি। রসায়নের কারবার পদার্থ নিয়ে,  মৌলিক পদার্থগুলোর কোনটা বা নিজের খেয়াল খুশিতে একা একাই ঘুরে বেড়ায়, কখনও বা দল বেঁধে আর পাঁচটা ভিনজাতের মৌলের সঙ্গে জোট পাকিয়ে তৈরি করে নতুন পদার্থ–যৌগিক পদার্থ। আর সেই জোট বাঁধার উল্লাসে হারিয়ে ফেলে নিজের বৈশিষ্ট্য, নিজের পরিচয়। আর এই শতেক মৌলের শতেক কাহিনি রচনার মধ্য দিয়ে রসায়নশাস্ত্র তুলে ধরে বস্তু জগতের ভাঙাগড়ার আইন-কানুন, এক পদার্থ থেকে অপর পদার্থের আবির্ভাবের নিয়ম-নীতি।

জীব বিজ্ঞানের কাজ জন্তু-জানোয়ার, গাছ-পালা নিয়ে। জ্যান্ত মানুষ, জ্যান্ত প্রাণী, লতা-পাতা, গাছ-পালা ধরে কেটে-কুটে ছিঁড়ে-খুঁড়ে সবার ভিতরের প্রকৃতি বাইরের আকৃতি দেখে একের পর এক থাকের পর থাক সাজিয়ে রেখে জীব-বিজ্ঞান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জীবজগতের ক্রমবিকাশের ধারা, বুঝিয়ে দেয় কেমন করে সামান্য যৌগিক রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে থেকে ধাপে ধাপে পরিবর্তনের পথে ক্রমশ নতুনতর, জটিলতর, উন্নততর প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেছে, কেমন করে আঠার মতো এককোষী প্রাণী অ্যামিবা থেকে ক্রমাগত বিকাশ ও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমাদের এই মানুষ জাতি এই দুনিয়ার বুকে জন্ম নিয়েছে, কেমন করে মানুষ তার চারপাশের পরবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে ক্রমাগত নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টায় নিজের বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে।

মনস্তত্ত্বের কর্মক্ষেত্র মানুষের মন। কেমন করে মস্তিষ্কের ক্রমাগত বিকাশের পথে সামান্য জান্তব প্রবৃত্তিগুলি, যুক্তি বিবেকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত ও উন্নততর হয়ে এসেছে, কেমন করে প্রবৃত্তির সঙ্গে যুক্তির এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজের প্রবৃত্তিকে, নিজের স্বভাবকে, নিজের চরিত্রকে ক্রমাগত নিজের যুক্তিবোধ আর বিবেক বুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে, কেমন করে একদিন এই দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের পথেই মানুষের যুক্তিবোধ আর বিবেক বুদ্ধির সঙ্গে জৈব প্রবৃত্তির সম্পূর্ণ মিলন ঘটে এক নতুন মনের সৃষ্টি হবে, যখন মানুষকে আর তার বিবেক বুদ্ধিকে জোর করে প্রবৃত্তির ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দেওয়ার দরকার হবে না, যখন মানুষের জাগ্রত প্রবৃত্তিগুলিকে আর কড়া যুক্তির কঠোর শাসনে বেঁধে রাখার দরকার হবে না, যখন আদিম জান্তব প্রবৃত্তি রূপান্তরিত হবে নতুন যুক্তি-সিদ্ধ প্রবৃত্তিতে, মনস্তত্ত্বের দর্পণে মনের এই ভূত-ভবিষ্যতে ধরা পড়েছে, ধরা পড়েছে মনের বিকাশের রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন।

সমাজনীতি শেখায় কী ভাবে আদিম বর্বর গোষ্ঠী সাম্যবাদী সমাজ চাহিদার তুলনায় যোগানের অভাবে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেল এবং কী ভাবে পরবর্তীকালে এই দ্বিধা বিভক্ত সমাজে শোষক-শাসক শ্রেণি আর শোষিত-শাসিত শ্রেণির দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সমাজ ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হতে হতে এসে বর্তমান অবস্থায় দাঁড়িয়েছে এবং কী ভাবে বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিক শ্রেণি এবং ধনিক শ্রেণি সংঘর্ষের পথে ধনিক শ্রেণি তথা সর্বপ্রকার শোষক শ্রেণির শ্রেণি-শোষণকে ধ্বংস করে দিয়ে শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই ভাবে মানব সমাজের বিকাশের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সমাজ বিজ্ঞান তাঁর পরিবর্তনের নিয়ম কানুনগুলি তুলে ধরে আমাদের সামনে।

বিজ্ঞানের অন্যান্য বিশেষ বিশেষ শাখাও পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান বা মনস্তত্ত্ব বা সমাজ বিজ্ঞানের মতো নিজের নিজের ক্ষেত্রের বিশেষ বিশেষ নিয়ম বা তত্ত্বগুলিকে তুলে ধরে।

এই সমস্ত শাখাগুলিকে যখন আমরা একেবারে একই সঙ্গে নিজেদের চোখের সামনে তুলে ধরি তখন তার মধ্যে থেকে কতগুলি সাধারণ সত্য আমাদের সামনে ফুটে ওঠে।

প্রথমত, আমাদের সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত বিশেষ সত্যের ধারণাই এই সমস্ত বিজ্ঞানের কোনও না কোনওটার অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ আমাদের সমস্ত বিশেষ সত্যের ধারণাই বস্তুজগৎ সম্পর্কিত, বস্তুর কোনও বিশেষ রূপের অবস্থান সম্পর্কিত। এবং যেহেতু বিজ্ঞানের সমস্ত বিভাগের সর্বপ্রকার নিয়ম ও তত্ত্ব পরীক্ষিত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, যেহেতু বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত কোনও নিয়ম বা তত্ত্বই মানুষের অলীক কল্পনা বা মনগড়া ধারণা থেকে উদ্ভূত নয়, সেই হেতু আমাদের যে সব ধারণা যে সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে মেলে কেবলমাত্র সেই সমস্ত জ্ঞান সেই সব ধারণাই সঠিক এবং সত্য।

দ্বিতীয়ত, মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, যে মনটা দিয়ে আমরা মানুষকে, সমাজকে, জগতকে বিচার করে দেখতে যাই সেই মনটা নিজেই একটা বিশেষ বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু। আজ যদি কারও মন বলে যে, এই পার্থিব বস্তু জগতের বাইরে বস্তুর উর্ধ্বে কোনও অতীন্দ্রিয় সত্তা আছে, তা হলে মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের সাহায্যে তাকে এ সত্যটা প্রমাণ করে দেখিয়ে দেওয়া সম্ভব যে, তার মনের ওই চিন্তাটা সমাজের প্রচলিত সংস্কার এবং ধারণার থেকেই জন্মলাভ করেছে, যে সংস্কার যে ধারণা মানব সভ্যতার আদিযুগে বিজ্ঞানের অতি শৈশবে এক বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। যে হেতু আজকের মতো সামগ্রিকভাবে দুনিয়াকে জানার উপায় সেদিন বিজ্ঞানের ছিল না, সেইহেতু প্রচলিত শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সমাজের সমস্ত নিয়মশৃঙ্খলা বিধানের অধিকারী স্বৈরাচারী শাসকের একাধিপত্যই মানুষের মনে প্রতিফলিত হয়েছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বহু বিচিত্র কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত নিয়মশৃঙ্খলার উৎস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে। কাজেই জগৎ সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে, সঠিক সামগ্রিক ধারণা গড়ে তুলতে হলে মানুষের নিজের মনগড়া ধারণার উপরে নির্ভর না করে আমাদের নির্ভর করতে হবে বিজ্ঞানের পরীক্ষিত সত্যের উপর, কারণ মানুষের মনের উপর বস্তু জগৎ সম্পর্কে বিজ্ঞানের পরীক্ষিত সত্যলব্ধ ধারণার প্রতিফলনই হচ্ছে বস্তু জগতের সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান, সত্য জ্ঞান।

বিজ্ঞানের বিশেষ বিশেষ শাখাগুলির পরীক্ষিত সমস্ত সিদ্ধান্তগুলির মধ্য থেকে যে সাধারণ সিদ্ধান্ত সমূহ আমাদের সামনে উপস্থিত হয়, তা থেকে আমরা জানতে পারি যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুরই অর্থাৎ জড়, জীব, মানুষ অথবা মানুষের সমাজ, মানুষের মন তথা চিন্তাজগৎ–এ সব কিছুরই আবির্ভাব ঘটেছে বস্তু থেকে। এখানে বস্তু বলতে কোনও বিশেষ একটা বস্তুকে বোঝায় না, সাধারণভাবে নির্বিশেষ বস্তুকে বোঝায়, যেমন মানুষ বলতে আমরা কোনও বিশেষ একটি মানুষকে বুঝি না, সাধারণভাবে মানুষকে বুঝি।

যে কোনও বিশেষ বস্তুরই আবির্ভাব ঘটছে আর একটা বিশেষ বস্তু থেকে, অর্থাৎ বস্তু ক্রমাগত পরিবর্তনের পথে একটা বিশেষ রূপ থেকে আর একটি বিশেষ রূপে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই দিক থেকে দেখতে গেলে যে কোনও বিশেষ বস্তুরই জন্ম আছে–যা অন্য কোনও বিশেষ বস্তু থেকে রূপান্তর গ্রহণেরই নামান্তর, এবং মৃত্যু, যা অন্য কোনও বিশেষ বস্তুতে রূপান্তরিত হওয়ারই নামান্তর–তা-ও আছে। বস্তুর বিশেষ রূপের যেমন সৃষ্টি আছে তেমনি বিনাশও ঘটে। কিন্তু সাধারণভাবে বস্তুকে ধরলে তার নির্বিশেষ রূপের বিনাশের প্রশ্ন যেমন ওঠে না, সৃষ্টির প্রশ্নও তেমনি অবান্তর। সাধারণভাবে নির্বিশেষ বস্তু ছিল, আছে এবং থাকবে। পৃথিবী, মানুষ মানুষের মন এগুলো বস্তুর বিশেষ বিশেষ রূপ মাত্র–কাজেই এদের ক্ষেত্রে অন্য বিশেষ রূপের বস্তুর মধ্য থেকে জন্ম বা সৃষ্টির প্রশ্নটা উঠতে পারে, কিন্তু যখন সাধারণভাবে বস্তুজগৎ বলা হয়–যে বস্তুজগতের মধ্যে পৃথিবী, মানুষ, মানুষের মন, গ্রহ-তারা-রবি-শশী সব কিছুই পড়ে যায়–সেই বস্তু জগতের আদি বা অন্ত বলতে কিছুই নেই। কাজেই এমন কোনও কিছুই বস্তুজগতের ভিতরে বা বাইরে নেই যা বস্তুনিরপেক্ষ। দুনিয়ার সমস্ত বস্তুই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পর নির্ভরশীল, কোনও কিছুই চরম বা আদি বা চূড়ান্ত বা স্বয়ম্ভু নয়।

দ্বিতীয়ত, এই সমস্ত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত থেকে একটি সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, এই দুনিয়ার যাবতীয় বস্তুই পরিবর্তনশীল, বস্তুর ক্রমাগত পরিবর্তনের পথে একটি বিশেষ বস্তু অন্য এক বিশেষ বস্তুতে পরিবর্তিত হচ্ছে। এবং এই রূপান্তর বা পরিবর্তন যেহেতু সমস্ত বিশেষ বস্তুরই ধর্ম অতএব তা থেকে এ সত্যে আমরা উপনীত হতে পারি যে–পরিবর্তন বস্তুর ধর্ম। এবং যেহেতু বস্তু সর্বদাই বিরাজ করে বিশেষ বস্তুর রূপে সেই হেতু বস্তু কখনও কোনও বিশেষ রূপে চিরকাল থাকতে পারে না, অর্থাৎ সনাতন, শাশ্বত, স্থায়ী, নিত্য বা ধ্রুব বস্তু বলে কোনও বস্তুই নাই। এই সবগুলি বিশেষণই শুধুমাত্র আপেক্ষিক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে, অর্থাৎ বস্তুর কোনও বিশেষ রূপ অপেক্ষাকৃত কম স্থায়ী এবং এই অর্থে অস্থায়ী এবং কোনও বিশেষ রূপ তার চাইতে অধিকতর স্থায়ী বলা চলতে পারে।

তৃতীয়ত, সমস্ত বিশেষ বস্তুই একে অপরের সঙ্গে ক্রমাগত পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্যে আসছে এবং এই পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সর্বদাই একে অপরের উপর কম-বেশি প্রভাব বিস্তার করছে। এখন এই সমস্ত বিশেষ বস্তুগুলিই আবার অপর কতগুলি বিশেষ বস্তুর দ্বারা গঠিত–যে বিশেষ বস্তুগুলি নিজেরা পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত এবং এই পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সেগুলি আবার নিজেদের উপর পারস্পরিক প্রভাব বিস্তার করে চলে। এই ভাবে প্রতিটি বিশেষ বস্তুই আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হতে হতে চলে এবং এই দুই প্রকার দ্বন্দ্বের মধ্যে আবার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই মুখ্য, যেহেতু যে কোনও বিশেষ বস্তু বাইরের আর পাঁচটা বিশেষ বস্তুর সংস্পর্শে আসার সময়েই নিজে পরিবর্তিত হতে হতেই আসে–যে পরিবর্তন ঘটছে তার অভ্যন্তরীণ বস্তুগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তনের ফলে।

চতুর্থত, বিজ্ঞানের সমস্ত বিশেষ শাখার বিশেষ সত্য বস্তুর পরিবর্তনেরও একটা সাধারণ রূপ আমাদের সামনে তুলে ধরে। যে কোনও বস্তুই ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হতে হতে শেষপর্যন্ত এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছায় যেখানে এসে সে আর বর্তমান বিশেষ রূপটিকে সেই বিশেষ রূপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও ধর্মকে আর ধরে রাখতে পারে না। পরিবর্তনের পথে হঠাৎ এক জায়গায় এসে দেখা যায় সেই আগের রূপ আগের বৈশিষ্ট্য, আগের ধর্ম– এ সব কিছুই অন্তর্হিত হয়েছে বস্তুর এক নতুন রূপের মধ্যে, যে রূপের সঙ্গে আবির্ভূত হয়েছে সংশ্লিষ্ট নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য এবং ধর্মের। এক-দুই-তিন ডিগ্রি করে উঠতে উঠতে একশো ডিগ্রি তাপমাত্রায় উঠে দেখা যায় জল আর জল নেই, বাষ্প হয়ে গেছে– তার রূপ, গুণ, আকৃতি, প্রকৃতি সব গেছে পাল্টে। এক-দুই-তিন করে কাটতে কাটতে পনের বছরে পা দিয়েই ছেলেটা আর ছেলে থাকে না, যুবক হয়ে যায়। মেয়েটা মা-বাপের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয় হঠাৎ শাড়ি পরে। বস্তুর এই যে বিচিত্র পরিবর্তনের ধারা– ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে একটু একটু করে পরিবর্তন হতে হতে হঠাৎ একদিন একেবারে খোল-নলচে পাল্টে ফেলে নতুন রূপে দর্শন দেওয়া– এ-ও কি শুধু এই নতুন রূপে চিরস্থায়ী ভাবে বিরাজ করবার জন্যেই? বাস্তব ঘটনা এই ‘চিরস্থায়ী’ অবস্থানের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে।

পরিবর্তন মানেই একের মৃত্যু অন্যের জন্ম আর সদাসর্বদা পরিবর্তনই যেখানে বস্তুর ধর্ম সেখানে এই পরিবর্তনের অর্থই হচ্ছে, একটি বিশেষ রূপের অবস্থানের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আর একটি বিশেষ রূপের অবস্থানের জন্মের পথে নতুনতর এক বিশেষ রূপে রূপান্তরিত হওয়ার অন্তহীন ধারাপ্রবাহ। একটি বিশেষ বস্তুর বিকাশের পথেই সেই বিশেষ বস্তুর অস্তিত্বকেই বিলুপ্ত করতে করতে বস্তু ক্রমাগত বিকশিত ক্রমাগত পরিবর্তিত হতে থাকে। এবং এই ভাবেই এক নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনের প্রবাহে বস্তুজগতে বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর রূপে, জটিল থেকে জটিলতর রূপে, ক্রমাগত উন্নত থেকে উন্নততর রূপে পরিবর্তনশীল বস্তুর আত্মপ্রকাশ ঘটে চলেছে। (চলবে)

(এই নিবন্ধটি ১৯৬২ সালে গণদাবী ১৫ বর্ষ ৬ সংখ্যা থেকে ৯ সংখ্যা পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটির গুরুত্ব বিবেচনা করে পুনঃপ্রকাশ করা হল। এ বার দ্বিতীয় অংশ)