সংসদে এবারের শীতকালীন অধিবেশনে প্রায় দেড়শো জন বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করে দিয়ে বিরোধীশূন্য সংসদে বিনা বিতর্কে পাশ করিয়ে নেওয়া হল বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিল যার অনেকগুলির মধ্যেই বিজেপি সরকারের দমনমূলক স্বৈরাচারী চরিত্রের ছাপ স্পষ্ট।
২১ ডিসেম্বর পাশ হওয়া ‘টেলিকমিউনিকেশন বিল-২০২৩’-এর বিরুদ্ধেও উঠেছে একই অভিযোগ।জাতীয় নিরাপত্তা, জনগণের সুরক্ষা ইত্যাদির অজুহাতে আসলে নাগরিকদের টেলি-যোগাযোগ ব্যবহারের উপর নজরদারি বাড়ানোর ছাড়পত্র এই আইনের ছত্রে ছত্রে।এই আইন চালু হলে ডিজিটাল ও অন্যান্য মাধ্যমে পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও গোপন বলে কিছুই থাকবে না এবং কোনও রকম রক্ষাকবচ ছাড়াই ব্যক্তিগত সমস্ত তথ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
এই আইনে টেলিকম পরিষেবার সংজ্ঞা একেবারেই অস্পষ্ট। ফলে টেলি-যোগাযোগ ছাড়াও হোয়াটসঅ্যাপ, এক্স (আগেকার টুইটার), ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো অনলাইন সমাজমাধ্যমগুলিকেও সরকার চাইলেই এই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারে। দেশের নিরাপত্তা বা জরুরি পরিস্থিতির অজুহাত তুলে সরকার এই আইনে চাইলে যে কারও পাঠানো বার্তা আটকে দিতে পারে, সেগুলির উপর নজরদারি চালাতে পারে কিংবা সেগুলির প্রচার বন্ধ করে দিতে পারে। বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা যেহেতু সরকারকেই দেশ করে তুলেছে, তাই সরকারের কোনও নীতি বা সরকারি দলের কোনও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এই মাধ্যমগুলি ব্যবহার করে পারস্পরিক মতবিনিময় এবার থেকে দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে। শুধু তাই নয়, ইন্টারনেট ব্যবহার করে পারস্পরিক যোগাযোগের ব্যবস্থাটিকে সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বলে বিধান দেওয়া সত্ত্বেও এই আইনে সরকারকে ইচ্ছামতো ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার অধিকারও দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শুধু ব্যবহারকারীদের উপরেই নয়, পরিষেবা সরবরাহকারী সংস্থাগুলিকেও এই আইনে মুঠোয় পুরতে চেয়েছে বিজেপি সরকার। ডিজিটাল পরিষেবায় এখনও পর্যন্ত ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকারকে মান্যতা দেওয়া হয়। যেমন, হোয়াটসঅ্যাপ বা ই-মেল ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তা শুধু যাঁকে পাঠানো হয়েছে, তিনিই দেখতে পান, অন্য কেউ নয়। নতুন আইনে এই বিষয়টি থাকবে না।এ দেশে কাজ করতে হলে পরিষেবা সরবরাহকারী সংস্থাগুলিকে নতুন আইনে এ সংক্রান্ত শর্ত মানতে হবে।ফলে বিপন্ন হবে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা।শর্ত না মানলে এই আইন অনুযায়ী পরিষেবা সরবরাহকারী সংস্থার কাজ বন্ধ করে দিতে পারবে সরকার।সুতরাং যত স্বৈরাচারীই হোক, নতুন আইন চালু হলে সরকারের সুরে সুর না মিলিয়ে ভারতে কাজ করার উপায় থাকছে না ডিজিটাল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলির।
নতুন এই আইনে নাগরিকদের বায়োমেট্রিক তথ্যের উপর জোর দিয়েছে বিজেপি সরকার। এতে সাধারণ একটা ফোনের সংযোগ নিতে গেলেও গ্রাহককে তার বায়োমেট্রিক তথ্য দিতে হবে। এমনকি যে ইন্টারনেট যোগাযোগ ছাড়া আজকের দিনে জীবন প্রায় অচল, তা ব্যবহার করতে গেলেও দিতে হবে বায়োমেট্রিক তথ্য। সরকার ইতিমধ্যেই নানা কাজে দেশের মানুষের কাছ থেকে যে বায়োমেট্রিক তথ্য নিয়েছে, সেগুলি যে সরকারের হাতে সুরক্ষিত অবস্থায় নেই, তা বহু আগেই প্রমাণিত হয়ে গেছে।আধার কার্ড বা রেশন কার্ড থেকে বায়োমেট্রিক তথ্য হাতিয়ে তা ব্যবহার করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট লুটের বহু ঘটনায় দেশের মানুষকে আজ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আশঙ্কার মধ্যে কাটাতে হয়।
এই অবস্থায় টেলিকমিউনিকেশন আইনে ঢালাও ভাবে বায়োমেট্রিক তথ্য সরবরাহ করতে হলে পরিস্থিতি যে আরও কতখানি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, তা ভাবতেও ভয় হয়।
স্বাধীনতাপূর্ব টেলিকম আইন সহ দেশের প্রচলিত আইনগুলি বাতিল করে নতুন এই আইনে যেভাবে দেশের নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার অধিকারকে সরকারি নজরদারির আওতায় নিয়ে এল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তা কোনও স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে অকল্পনীয়। কিছুদিন আগেই দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিকদের মোবাইল ফোনে চরবৃত্তির উদ্দেশ্যে ইজরায়েল থেকে বিপুল ব্যয়ে কেনা ‘পেগাসাস’ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে।
যথারীতি সেই অভিযোগ অস্বীকার করলেও নতুন টেলিকম আইনটি পাশ করিয়ে বিজেপি সরকার নিজেই প্রমাণ করে দিল যে, শুধু সাংবাদিক বা রাজনৈতিক বিরোধীদের উপরেই নয়, দেশের সমস্ত নাগরিকের প্রতিটি কার্যকলাপের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করাই তার চরিত্রবৈশিষ্ট্য। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, শিক্ষা ও চিকিৎসাহীনতায় জর্জরিত দেশের সাধারণ মানুষ যতই জনস্বার্থ রক্ষায় কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতা ও অপদার্থতায় তিথিবিরক্ত হয়ে উঠছে, ততই সরকার বিক্ষোভের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠছে। মত প্রকাশ ও বিনিময়ের উপর এই আইনি কড়াকড়িতে সরকারের সেই আতঙ্কই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বিজেপি সরকার এ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। একের পর এক এই ধরনের আইন তারা সেই কারণেই নিয়ে আসছে। নতুন টেলিকম আইন এ দেশে টিকে থাকা গণতান্ত্রিক অধিকারগুলির কবর রচনা করবে। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকেই তাই এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।