এস ইউ সি আই (সি) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রবীণ সদস্য, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার চাষি-মজুর, মেহনতি মানুষের নেতা, কুলতলি কেন্দ্রের ন’বারের বিধায়ক কমরেড প্রবোধ পুরকাইতের সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটল ২৬ মার্চ ভোরে। ওই দিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে জয়নগরের দক্ষিণাঞ্চল স্বাস্থ্যসদনে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। এই জননেতার প্রয়াণের সংবাদ পেয়েই জেলার সব প্রান্ত থেকে দলের কর্মী ও হাজার হাজার সাধারণ মানুষ তাঁকে শেষবার দেখার জন্য ছুটে আসেন।
বিগত শতকের ৬০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে চাষি-মজুরের ওপরে নির্মম শোষণ-বঞ্চনা, জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এস ইউ সি আই (সি)-র নেতৃত্বে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় যে উত্তাল লড়াই শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলনে কমরেড প্রবোধ পুরকাইত বিশেষ স্থান অর্জন করেন।
চুপড়িঝাড়া এলাকার অত্যন্ত প্রতাপশালী জোতদার পরিবারের সন্তান কমরেড প্রবোধ পুরকাইত কলেজে পড়ার সময় দলের কথা শুনেছিলেন। ছাত্র জীবনের শেষে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার সংস্পর্শে এসে গরিব চাষি-মজুরের পক্ষ নিয়ে জোতদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং নিজেকে দলের সাথে যুক্ত করেন। ছাত্রজীবনে প্রথমে ডায়মন্ডহারবার কলেজে ও পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজে পড়াশোনা শেষ করে কুলতলির ভুবনেশ্বরী জয়কৃষ্ণ হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে গ্রামে ফিরে দলের সংগঠক কমরেড ধীরেন ভাণ্ডারীর জীবনসংগ্রাম দেখে ও তাঁর প্রচেষ্টায় তিনি দলের সাথে যুক্ত হন। দলের তৎকালীন জেলা সম্পাদক কমরেড ইয়াকুব পৈলানের সাহচর্যে দলের কর্মীতে পরিণত হন। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রয়াত সদস্য কমরেড শচীন ব্যানার্জী, সুবোধ ব্যানার্জীর মতো সুযোগ্য নেতৃত্বের সংস্পর্শে জীবন সংগ্রামকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করেন। দলের সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৬৭ সালে দল তাঁকে বিধানসভার প্রার্থী হিসাবে মনোনীত করে। তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হন। কেবলমাত্র ১৯৭২ সালে যখন কংগ্রেস সারা রাজ্যে ভোটে ব্যাপক রিগিং ও সন্ত্রাস করেছিল সেবার ছাড়া জনগণ তাঁকে ৯ বার বিধায়ক হিসাবে নির্বাচিত করেন।
তাঁর কাকা ছিলেন কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা। তিনি বহু চেষ্টা করেও বিপ্লবী আন্দোলন থেকে কমরেড প্রবোধ পুরকাইতকে নিবৃত্ত করতে পারেননি। তিনি পরিবারের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন। তেভাগার দাবিতে, জোতদারদের দ্বারা চাষিদের শোষণের উদ্দেশ্যে চালু করা নানাবিধ কুপ্রথা প্রতিরোধে গড়ে ওঠা দুর্বার আন্দোলনে তিনি বিশিষ্ট সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। হাজার হাজার বিঘা বেনাম জমি উদ্ধার করে চাষিদের হাতে তুলে দেওয়ার সফল সংগ্রামে তাঁর সাহসী ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। ১৯৭০ সালে জোতদার ও কায়েমি স্বার্থবাজদের ষড়যন্ত্রে পুলিশ তাঁকে প্রচণ্ড মারধোর এবং গ্রেপ্তার করে নদীপথে থানায় আনতে গেলে চাষিরা আশঙ্কা করেন লোকচক্ষুর অন্তরালে পুলিশ তাঁকে খুন করে ফেলতে পারে। চাষিরা নদীঘাটে থাকা নৌকাগুলি কুড়ুল মেরে অচল করে দিলে পুলিশ তাঁকে ‘মাচায়’ করে মাথায় তুলে নিয়ে হাঁটা পথে মানুষের চোখের সামনে দিয়ে থানায় নিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
৮০-র দশকে মৈপীঠে সিপিএম নেতৃত্ব এস ইউ সি আই (সি)-র সংগঠনকে ভাঙতে বর্বর ভূমিকা নেয়। দলের কর্মীদের নৃশংস হত্যা, লাশ গায়েব করা, পুলিশকে পাশে নিয়ে ব্যাপক সন্ত্রাস, মহিলাদের উপর অকথ্য অত্যাচার, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, গ্রাম থেকে তাড়ানো প্রভৃতি সন্ত্রাস চালিয়ে যেতে থাকে। সেই সময়ে শতাধিক পুলিশ ও গুণ্ডাবাহিনীর যৌথ অভিযানের সামনে পুরুষ কর্মী-সমর্থক শূন্য গ্রামে মাত্র একজনকে নিয়ে কমরেড প্রবোধ পুরকাইত বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানান। এই ধরনের বহু ঘটনায় মৃত্যুর পরোয়া না করে শাসক শ্রেণির আক্রমণের বিরুদ্ধে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। জোতদার পরিবারের সন্তান হলেও তিনি আদর্শবান নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গরিব মানুষের মধ্যেই জীবনের বড় সময় কাটিয়েছেন। তাদের পর্ণকুটিরে থাকা ও মেলামেশায় নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলেন। জনগণের মধ্যে দলকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুর্গম কুলতলির গ্রামে গ্রামে দিনে ৫০-৬০ মাইল হেঁটে ঘুরতেন। সহজ-সরল ভাষায় আকর্ষণীয় ভাবে তিনি বক্তব্য তুলে ধরে জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে পারতেন। গরিব মানুষকে সংগঠিত করে আন্দোলনের পর আন্দোলনে তিনি যে নিবেদিতপ্রাণ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন তার ফলে জনগণ তাঁকে নিজেদেরই আপনজন হিসাবে সাদরে গ্রহণ করে নেয়। সাধারণ মানুষ তাদের পারিবারিক সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে প্রায় সর্বদাই তাঁকে ঘিরে রাখত। দায়বদ্ধতা ও মমতার সাথে তাদের সাহায্যে তিনিও সদাব্যাপৃত থাকতেন।
জনপ্রিয় হলেও দলের শিক্ষায় তাঁর মধ্যে অহঙ্কারবোধ জায়গা করতে পারেনি। একদিকে বিধানসভায় দলনেতা হিসাবে কমরেড দেবপ্রসাদ সরকারকে, অপর দিকে দলের নেতা হিসাবে কমরেড ইয়াকুব পৈলান বা আমির আলি হালদারকে অন্তর থেকে মেনে নিয়ে সাবলীলভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন। বয়সে ছোটদের নেতৃত্ব মেনে নিতেও তাঁর অসুবিধা হয়নি। তিনি সমালোচনাকে হাসিমুখে গ্রহণ করতে পারতেন, ক্ষুব্ধ হতেন না।
পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিভূ কংগ্রেস এলাকায় ক্রমাগত হীনবল হয়ে পড়লে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় সিপিএম ফ্রন্ট সরকার। জোতদার কায়েমি স্বার্থবাদীরা সিপিএমের সাথে অশুভ আঁতাত গড়ে তোলে এবং রাতারাতি সিপিএম হয়ে যায়। আদর্শগত ও সাংগঠনিক দিক থেকে এস ইউ সি আই (সি)-কে দুর্বল করতে না পেরে এই জেলায় দলের কর্মী-নেতাদের খুন-সন্ত্রাস-মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা জনপ্রিয় নেতা প্রবোধবাবুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ১৯৮৫ সালে খুনের মিথ্যা মামলায় তাঁকে জড়িয়ে দেয়। নিম্ন আদালতে কয়েকজন কর্মীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। প্রবোধবাবু সহ শতাধিক কর্মী মুক্তি পান। বিস্ময়করভাবে পরবর্তীকালে প্রবোধবাবু সহ দলের ৫ জন নেতার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আকস্মিকভাবে মামলা ওঠে ও তাঁর যাবজ্জীবন জেলের আদেশ হয়। ২০০৫-এর ১৯ আগস্ট হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে তাঁকে জেলে পৌঁছে দেয়। জেলযাত্রার সূচনায় তদানীন্তন রাজ্য সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ তাঁর হাতে রক্তপতাকা তুলে দিলে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দেহ থাকবে কারাগারে, মন পড়ে থাকবে কুলতলির ঘরে ঘরে’। ২০১৫-র ২০ আগস্ট দল তাঁকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। জেলের মধ্যে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে ও নানা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ বছর প্রায় শয্যাশায়ী থাকেন। দীর্ঘ কারাবাসের মধ্যে তাঁর নেতৃত্বে জেলের মধ্যে পার্টির প্রত্যেকটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি, যেমন ২৪ এপ্রিল দলের প্রতিষ্ঠা দিবস, ৫ আগস্ট মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রয়াণ দিবস, নভেম্বর বিপ্লব দিবস প্রভৃতি পালিত হত। সেই কর্মসূচিগুলিতে অন্য বন্দিরাও যোগ দিতেন। এর মাধ্যমে বহু বন্দি, এমনকি জেলের অফিসারদের মধ্যে তাঁরা দলের রাজনীতির প্রভাব ফেলেছিলেন। নবজাগরণ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট মনীষী ও বিপ্লবী, শহিদদের জীবনচর্চা করতেন জেলবন্দিদের নিয়ে।
কমরেড প্রবোধ পুরকাইত দলের সংবাদ জানতে ব্যাকুল হয়ে থাকতেন। তত্ত্ব চর্চার আগ্রহে বহু পত্র-পত্রিকা পড়তেন। দেখা হলেই কর্মীদের উৎসাহিত করতেন। বিশিষ্ট নেতাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভাগুলোতে হাজির হতেন। গত ১১ মার্চ, জয়নগর শিবনাথ শাস্ত্রী সদনে এআইকেকেএমএস-এর সর্বভারতীয় সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের ভাষণ শুনতে অসুস্থ শরীরেই এসেছিলেন। এটাই ছিল রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাঁর শেষ অংশগ্রহণ।
তিনি বিধায়ক থাকা অবস্থায় তৎকালীন সিপিএম পরিচালিত সরকার দেশি-বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে ইকোটুরিজমের নামে সুন্দরবনের জল জঙ্গল, জীবন জীবিকা ও পরিবেশ বিনষ্টকারী প্রকল্প রূপায়ণে মেতে ওঠে। দলের নেতৃত্বে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে তা প্রতিহত করা হয়। সেই আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সুন্দরবনে সর্বনাশা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার বিরুদ্ধে আন্দোলনেও তিনি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তাঁর কর্মময় জীবনে কেন্দ্র-রাজ্য সরকারের সকল জনবিরোধী নীতি ও ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে রাজ্যে গড়ে ওঠা প্রতিটি আন্দোলন ও দলের কর্মসূচি রূপায়ণে তিনি আন্তরিক ও অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। কুলতলি এলাকার পানীয় জল, রাস্তাঘাট, স্কুল, স্থল ও নদীপথে যানবাহন ব্যবস্থা প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়নে তাঁর প্রচেষ্টা এলাকার মানুষের কাছে সমাদৃত হয়। খরা, বন্যা, ঝড় ঝঞ্ঝার বিভিন্ন বিপর্যয়ের মুহূর্তে দুর্গতদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ ও বণ্টনে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা গ্রহণ করতেন। ঘটিহারানিয়ায় হাইস্কুলে প্রায় ৩০ বছর তিনি ছিলেন পরিচালন সমিতির অন্যতম কাণ্ডারি। বর্তমানে সেখানে একটি কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্যে দলমত নির্বিশেষে মানুষকে নিয়ে কমিটি গড়ে তুলে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। গরিব মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরাতে সম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বাধানোর ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে তিনি সদাজাগ্রত ভূমিকা রেখে গেছেন। কমরেড প্রবোধ পুরকাইতের প্রয়াণে দল হারিয়েছে এক বলিষ্ঠ নেতাকে, জনসাধারণ হারিয়েছে তাঁদের অত্যন্ত আপনজনকে।
কমরেড প্রবোধ পুরকাইত লাল সেলাম
কুলতলিতে স্মরণসভা
৫ এপ্রিল কুলতলির জামতলা বাজারে কমরেড প্রবোধ পুরকাইত স্মরণসভায় পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু বলেন, কমরেড প্রবোধ পুরকাইত যে ভাবে হাজার হাজার গরিব, মেহনতি মানুষের পরিবারের একজন হয়ে তাঁদের সমস্যা নিয়ে লড়াই করেছেন, তা অবিস্মরণীয়। এই গুণ জন্মগত ছিল না, তাঁকে অর্জন করতে হয়েছে। দলের চিন্তার আলোকে তিনি সমাজে শোষণের চরিত্রকে চিনেছেন। বিপ্লবী রাজনীতি উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি– নিজের জীবনে তা প্রমাণ করে গেছেন কমরেড প্রবোধ পুরকাইত। তিনি বলেন, এস ইউ সি আই (সি)-র আদর্শের ভিত্তিতে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে প্রবোধ পুরকাইতের মতো এগিয়ে আসুন, নির্বাচনেও সেইভাবে লড়ূন। আরেক জন প্রবোধ পুরকাইত হওয়ার চেষ্টা করুন।
রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেন, এলাকার মানুষের তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ যা তাঁর মৃত্যুর পরেও দেখা গেল তা ব্যক্তি প্রবোধ পুরকাইতের প্রতি নয়, কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে পাথেয় করে যে নতুন জীবনবোধ তিনি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তার প্রতি।
বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন বিধায়ক তরুণকান্তি নস্কর ও জয়কৃষ্ণ হালদার, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সৌরভ মুখার্জী। সভাপতিত্ব করেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড নন্দ কুণ্ডু। সভায় ৫ হাজারের বেশি মানুষ উপস্থিত ছিলেন।