২৯ জুন, কলকাতার রাজপথ অবার সাক্ষী হল যৌবনের তাজা লাল রক্ত ঝরার। সরকার ভেবেছিল কিছু লোহার ব্যারিকেড দিয়ে রুখে দেবে প্রতিবাদের জোয়ারকে। ভেবেছিল এ জোয়ারের ঢেউ মাথা নোয়াবেপুলিশের লাঠির আস্ফালনে আর উর্দিধারীদের কিছু হুমকির সামনে। কিন্তু প্রতিবাদীদের স্রোতের সামনে ভেসে গেল পুলিশের ব্যারিকেড, জলকামানের বিশাল কলেবর, আর নির্বিচারে চালানো লাঠির আঘাত।
লাঠির ঘায়ে যখন প্রতিবাদীদের মাথা ফাটছে, হাত-পা ভাঙছে, কেউ কেউ পড়ে গেলে তার উপর চলছে লাঠির বৃষ্টি, পাগলের মতো লাঠি ঘুরিয়ে পুলিশ যখন চাইছে যে কোনও ভাবে হোক প্রতিবাদের মেরুদণ্ড ভাঙবেই– সে উদ্যত লাঠি রুখে দিয়েছেন প্রতিবাদী তরুণী খালি হাতে। আঘাত পেয়েছেন, রক্ত ঝরেছে কিন্তু প্রতিবাদের জায়গা ছাড়েননি তাঁরা। পুরুষ পুলিশকর্মীরা মারার জন্য বীরদর্পে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মহিলা বিক্ষোভকারীদের উপর। শতাধিক আহত, গুরুতর ২০। তাঁদের অনেকের শরীরে একাধিক ক্ষতে চিকিৎসকদের সেলাই করতে হয়। ১০ জনকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ এবং নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। অনেকের মাথা, বুক, হাত ও পায়ের আঘাত অত্যন্ত গুরুতর। একজনের মেরুদণ্ডের আঘাত খুবই গুরুতর হওয়ায় তাকে ভর্তির পরামর্শ দেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
এ দিনের আইন অমান্য ছিল দীর্ঘদিন আগে থেকে ঘোষিত কর্মসূচি। অথচ দেখা গেল ২০ হাজারের বেশি আইন অমান্যকারীকে গ্রেপ্তার করার জন্য কোনও ব্যবস্থাই করেনি পুলিশ। ১৪৪ ধারা ভাঙার পর তাঁদের গ্রেপ্তার করার জন্য কোনও গাড়ির ব্যবস্থাই তারা করেনি। বোঝাই যায় আসলে গণতান্ত্রিক পথে আইন অমান্য করতে দেওয়া নয়, বিক্ষোভকারীদের পেটানোটাই ছিল পুলিশের উদ্দেশ্য। তাই ১৪৪ ধারা জারি থাকা এলাকা তো অনেক দূরের কথা, মিছিল এস এন ব্যানার্জী রোড হয়ে কর্পোরেশন বিল্ডিং পার হতেই পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তা আটকায়। নির্ভীক মিছিলকারীরা ‘আইন ভাঙো জেলে চলো’ স্লোগান দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই শুরু হয় নির্বিচার লাঠিচার্জ।
কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতি প্রতিরোধে এই আইন অমান্যের ডাক রাজ্য জুড়ে আলোড়ন তুলেছে। প্রচারের রেশ যেখানেই পৌঁছেছে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসে তাতে সমর্থন জানিয়েছেন। বলেছেন আপনারাই পারবেন এই জোয়ালটা ভাঙতে। ভাঙুন আইন, আমরা পাশে আছি, আর সহ্য হয় না, আমরা আন্দোলন চাই। যতদিন মানুষ পড়ে পড়ে মার খায় আর কপাল চাপড়ায়, সরকার কিছু ডোল অথবা কিছু শ্রী-এর নামে টাকা ছুঁড়ে দিলে পেটে গামছা বেঁধেও তা নিয়ে মুখ বুজে কষ্ট সইতে থাকে মানুষ, সরকার থাকে নিশ্চিন্ত। কিন্তু আন্দোলনের ডাক, বিশেষত যে ডাক এসেছে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর মতো জনজীবনের সব সমস্যা নিয়ে গণআন্দোলনের, সমাজ বদলের লড়াইয়ের শক্তির থেকে সে আহ্বান যখন জনমানসে ঢেউ তোলে, মানুষের ঘুমিয়ে থাকা বিবেককে ধাক্কা দেয়– অত্যাচারী শাসক তাকে ভয় না করে পারে না।
মিছিল শুরুর আগে রামলীলা পার্কের বিক্ষোভ সভায় ছাত্র, যুব, কৃষক, শ্রমিক ফ্রন্টের নেতারা জনজীবনের নানা দাবি তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। দলের পলিটবুরো সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেন, যে আইনের নাগপাশে জনগণকে বেঁধে রেখে যথেচ্ছ দুর্নীতির রাস্তা করে দেয় শাসকরা, সে আইন ভাঙাই যথার্থ মানুষের কাজ। আইন যেখানে অন্যায়, তাকে ভাঙাটাই ন্যায়। তাঁর এই আহ্বান অনুরণিত হয় হাজার হাজার কণ্ঠের শপথ উচ্চারণে। মিছিল শুরু হওয়ার মুখেই পুলিশ তা আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা ভেবেছিল এখানেই দমে যাবে আন্দোলন। কিন্তু তারা সফল হয়নি। প্রতিবাদী অসংখ্য কণ্ঠের স্লোগান যখন একযোগে সুউচ্চ কণ্ঠে বলে ওঠে– যে আইন জীবনের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেয়, ভেঙে ফেলবই তাকে। কোনও শাসক নেই যে এই দৃঢ়তাকে ভয় পায় না। এই মিছিলে যুবদের অংশগ্রহণ যেমন চোখে পড়ার মতো ছিল, একই সাথে অসংখ্য মহিলা থেকে শুরু করে বর্ষীয়ান বহু মানুষও যোগ দিয়েছিলেন। শহরের অফিস কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক, গ্রাম্য কৃষক, জবকার্ড হোষ্প্রর যুবক, আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এমন অসংখ্য পেশা ও সামাজিক স্তরের মানুষ মিশে গিয়েছিলেন প্রতিবাদী জনজোয়ারে।
মিছিল এস এন ব্যানার্জী রোডে ঢুকতেই বারবার তা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসাররা। কিন্তু সে বাধা কাটিয়ে মিছিল ক্রমাগত এগিয়ে চলতে থাকলে কটেজ ইন্ডাস্ট্রির সামনে লাঠি চালিয়ে মিছিল থামায় পুলিশ। কমরেড তরুণ মণ্ডল, তরুণ নস্কর সহ কিছুজনকে তারা গ্রেপ্তার করে। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ব্যাপার হল, মিছিলকারীরা যখন ফিরছেন তখন বারবার পিছন থেকে অতর্কিত অক্রমণ করতে থাকে পুলিশ। তাতেই আহতের সংখ্যা বাড়ে। বিচ্ছিন্নভাবে ফুটপাথ থেকেও নানাজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে থাকে। যাঁরা গ্রেপ্তার হতেই চেয়েছিলেন, তাদের আইন অমান্যের সুযোগ দিয়ে গ্রেপ্তার না করে বারবার পিছনে তাড়া করে বিচ্ছিন্নভাবে ধরা হচ্ছে কেন, এই প্রশ্ন তুলে মহিলা কর্মীরা রুখে দাঁড়ান এলিট সিনেমার সামনে। বহু যুবকও তাতে সামিল হন। এই প্রতিরোধ দেখে পুলিশ পিছু হটতে থাকে, যদিও তার মধ্যেও চেষ্টা করে চলে কিছুজনকে আঘাত করতে। পুলিশের এই জঘন্য আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানান স্থানীয় দোকানদার এবং পথচারীরা।
লাঠির সামনে বুক পেতে দাঁড়ানো ভয়হীন এই যৌবন আন্দোলনের যে অধ্যায় সূচনা করল, তা এগিয়ে যাবে বহুদূর।