একশো শতাংশ লকডাউন। বাজার, মুদিখানা, ওষুধের দোকান থাকছে খোলা, কিন্তু ভিড় করা চলবে না। এক মিটার দূরত্ব রেখে চলবে বেচাকেনা। মাঝেমধ্যেই কোনও কোনও পণ্য উধাও। বলা হচ্ছে জোগান নেই। গাড়ি ঢুকছে না। ঋতু পরিবর্তনের সময়টা ভাইরাস সংক্রমণের সুবর্ণ সময়। তেমনি যে কোনও বিপর্যয়ের সময়টা কালোবাজারি, ফড়েদের সুবর্ণ সুযোগ। ফলে জিনিসের দাম বাড়ে লাগামহীন ভাবে। চাল, ডাল, তেল, সবজি কোনওটাই বাদ নেই। আতঙ্কিত মানুষ তবুও ভিড় জমায়। বেশি বেশি করে কিনে সঞ্চয় করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সরকারের টাস্ক ফোর্স বাজারে রুটমার্চ করে। কর্পোরেশনের প্রতিদিনের রুটিন-স্প্রে-তে যেমন মশা মরে না, তেমনি সরকারের নির্বিষ ‘কঠোর হুমকিতে’ জিনিষের দাম কমে না। সরকার বলে, মানুষ আতঙ্কে বেশি বেশি করে কিনছে বলে জোগান কমে জিনিসের দাম বাড়ছে। বোঝা যায়, এই সঙ্কটে সরকারের আশ্বাসে মানুষের বিশ্বাস নেই। এক পরিচিত রিক্সাওয়ালাকে দেখলাম মুখে রুমাল বেঁধে রিক্সায় সবজি সাজিয়ে অলিতে গলিতে ঘুরছে। রাস্তার মোড়ে ফুল বিক্রি করত যে ছেলেটা, সে জানাল, ‘ব্যবসা বন্ধ। আপাতত পুঁজি ভেঙে চাল, ডাল, আলু কিনে ঘরবন্দি হয়ে আছি। জানি না এভাবে ক’দিন চলবে। এরপর নতুন করে পুঁজিই বা কোথায় পাব? এমনই সব দোকান-কর্মচারী, চৈত্রসেলের জামাকাপড়ের হকার, রাজমিস্ত্রি, অটোচালক, টোটোচালক, যাদের মাসমাইনে নেই, সঞ্চয় নেই– এরা বেঁচে থাকবে কেমন করে? বেঁচে থাকার যুদ্ধে যারা নিত্যদিন মরে আছে, তাঁদের কাছে করোনার মৃত্যুভয় কোথায়?
তবুও করোনার এই ভয়াবহ সংক্রমণ রোধ করতে হবে। সামাজিকভাবেই এক মানুষের মতো দাঁড়াতে হবে। কিন্তু একে কার্যকরী করতে হলে ভাবতে হবে, বাস্তবে আমরা তো ‘এক মানুষ’ নই। প্রান্তিক এই মানুষদের জীবনের কার্যকরী সুরক্ষার ব্যবস্থা না করে তাদের এক মানুষের মতো দাঁড় করানো যায় না। প্রশাসনের কড়া দমননীতিতেও তা সম্ভব হতে পারে না। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার অনেক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ঘোষণাগুলি টিভি মিডিয়ায়, খবরের কাগজের মাধ্যমে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কিন্তু সেগুলি বাস্তবের মাটি কতটুকু ছুঁতে পারে, তাতে সংশয় যথেষ্টই। একশো শতাংশ লকডাউন সফল করে করোনাকে ঘায়েল করতে হলে জনমনের এই সংশয় আগে দূর করতে হবে।
তপন চক্রবর্তী
কলকাতা – ৩৪