এ রাজ্যে সম্প্রতি পরপর কয়েকজন চাষির মর্মান্তিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য সরকারি নীতিকে দায়ী করেছেন অল ইন্ডিয়া কিসান খেতমজদুর সংগঠন (এআইকেকেএমএস)-এর রাজ্য সম্পাদক গোপাল বিশ্বাস।তিনি বলেন, পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী ১ নম্বর ব্লকের নিমদহ অঞ্চলের আলুচাষি রূপ সনাতন ঘোষের আত্মহত্যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।ধার করে তিনি দু’বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন।সাম্প্রতিক অকালবৃষ্টিতে সদ্য লাগানো আলু পচে নষ্ট হয়ে যায়।গত বছরও ধার নিয়ে চাষ করে একই ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি।সেই ধার এখনও শোধ হয়নি, তার উপর আবার ঋণ নিতে হয়েছে।এর ফলে প্রচণ্ড মানসিক অবসাদে ৯ ডিসেম্বর তিনি আত্মহননের মর্মান্তিক পথ বেছে নেন।পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা-১ ব্লকের বাপি ঘোষও ধার করে এবার চার বিঘা জমিতে আলু চাষ করেন।তাঁরও চাষ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। মানসিক অবসাদে তিনিও ৮ ডিসেম্বর রাতে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।বাঁচানোর সমস্ত চেষ্টা সত্তে্বও শেষ পর্যন্ত ১০ ডিসেম্বর হাসপাতালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কালোবাজারি
আলু চাষ অত্যন্ত ব্যয়বহুল।বিঘা প্রতি কমপক্ষে ৪০-৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়।এই চাষে প্রচুর পরিমাণ মিশ্র সার প্রয়োজন হয়, যার ৫০ কেজি বস্তার সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্য ১৪৭০ টাকা।কিন্তু বাজার থেকে চাষিদের কিনতে হচ্ছে ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকায়।এভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় রমরমিয়ে চলছে সারের কালোবাজারি। সরকার নির্বিকার।তা ছাড়া সিন্ডিকেটগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা আলুর বীজ অস্বাভাবিক চড়া দামে চাষিকে কিনতে হচ্ছে। এই কালোবাজারি চক্রের সঙ্গে শাসক দলের যোগসাজশ রয়েছে।ফলে কৃষক শোষণের এই চক্রটি বেপরোয়া।
বিমার মাধ্যমে প্রতারণা
কৃষক শোষণের নতুন প্রকরণ শস্যবিমা।আলু চাষের সময় চাষিরা সরকারি নিয়ম বিধি মেনে ফসল বিমা করেন। কিন্তু ঘটন়া হল, প্রাকৃতিক কারণে ফসলের ক্ষতি হলেও চাষি ক্ষতিপূরণ পায় না।কৃষি ক্ষেত্রে সরকার বিমার দায়িত্ব বেসরকারি কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দিয়েছে। কোম্পানির প্রতিনিধিরা ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে সার্ভে করে কৃষি দপ্তরে রিপোর্ট দিয়ে বলে থাকেন, যে পরিমাণ ক্ষতি হলে (একটি ব্লকে ৫০ ভাগের বেশি) চাষি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য, সেই পরিমাণ ক্ষতি হয়নি।এই ভাবে চূড়ান্ত কৃষক বিরোধী নিয়ম দাঁড় করিয়ে চাষিকে ঠকানো চলছে।
ফড়েদের শোষণ
ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া চাষির বরাবরের সমস্যা। চাষি আলু তোলার সময় ৩ থেকে ৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হয়, যে আলু পরবর্তীকালে চাষি সহ সকলেই ২০-২৫ টাকা কেজি দরে কিনতে বাধ্য হয়। রাজ্য সরকারের কাছে এআইকেকেএমএস দাবি করেছে, সরকার চাষির কাছ থেকে লাভজনক দামে আলু কিনে, গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে সস্তায় বিক্রির ব্যবস্থা করুক। কিন্তু বর্তমান তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার পূর্বতন সিপিএম সরকারের মতো একই রাস্তায় হাঁটছে।হিমঘর মালিক ও আলু সিন্ডিকেটগুলোর স্বার্থে তারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করছে না।
ঋণের বোঝা
এআইকেকেএমএস-এর আরও দাবি, কৃষি উন্নয়ন সমবায় ব্যাঙ্ক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো থেকে চাষিরা বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা যে ঋণ নিয়েছে রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার তা সব মকুব করে দিক। কিন্তু কোনও সরকারই চাষির এক টাকাও ঋণ মকুব করেনি। অথচ কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার অতীতে কংগ্রেস সরকারের মতো আদানি আম্বানি সহ হাতেগোনা কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানিকে প্রায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করে দিয়েছে। এই হল সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। এরা সকলেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। চাষির দুঃখ, বেদনা, আত্মহত্যা এদের স্পর্শ করে না। সরকারি কর্তারা দায় এড়াতে বেমালুম বলে দেয় পারিবারিক কারণে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু চাষি এবং আমজনতা কঠিন সত্য কথাটি জানে। সত্যটি হল সরকার ডঃ স্বামীনাথন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ফসলের এমএসপি নির্ধারণ করা ও তাকে আইনসঙ্গত করার মতো জরুরি কাজটি করেনি, ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ তুলতে না পেরে ক্রমাগত ঋণের জালে জড়িয়ে যাচ্ছেন চাষিরা। তাই আলুচাষির আত্মহত্যা বেদনাদায়ক হলেও সরকারের কাছে নতুন কোনও ঘটনা নয়, আত্মহত্যার মিছিলে সংযোজন মাত্র। দেশ জুড়ে এই মৃত্যুমিছিলের দৈর্ঘ্য অনেক। প্রায় ১৮ লক্ষ চাষি ইতিমধ্যে ভারতবর্ষে আত্মহত্যা করেছে।
এআইকেকেএমএস-এর দাবি, আত্মঘাতী আলুচাষি রূপসনাতন ঘোষ ও বাপি ঘোষের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক এবং অকাল বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত আলু চাষিদের বিঘা প্রতি ৩০ হাজার টাকা ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্তদের বিঘা প্রতি ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। কোনও মৃত্যুরই ক্ষতিপূরণ হয় না। এটা অসহায় পরিবারকে সামান্য সহযোগিতা মাত্র। কৃষকমৃত্যু আটকাতে হলে ফসলের লাভজনক দামের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। বন্ধ করতে হবে কৃষক বঞ্চনার বিচিত্র প্রক্রিয়া। আর দাবি আদায়ের জন্য কৃষকদের সংগঠিত হতে হবে গণআন্দোলনের ময়দানে।