শুধু আইন নয়, বধূহত্যা আটকাতে দরকার তীব্র সামাজিক আন্দোলন

 

সংবাদপত্রের পাতা খুললেই প্রতিদিন নারী নির্যাতনের অজস্র ঘটনা চোখে পড়ে। খুন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ সহ এই সব ঘটনা বিবেকবান মানুষকে বিচলিত করে। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৭৫ বছর, অথচ দেশের নারীরা প্রতিদিন অত্যাচারিত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অসম্মানিত হয়ে চলেছে।

সম্প্রতি বধূহত্যা সংক্রান্ত একটি মামলায় ২৮ পৃষ্ঠার এক রায়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি রিপোর্টকে তুলে ধরেছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। মহিলাদের হত্যা নিয়ে ২০১৮ সালের সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ বছর ভারতে যত মহিলাকে হত্যা করা হয়েছে তার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই পণের জন্য। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, এই ধরনের হত্যা আটকাতে দেশের পণপ্রথা বিরোধী আইনের যথাযথ রূপায়ণ জরুরি। শীর্ষ আদালতের এই বক্তব্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের জঘন্য অপরাধে যারা যুক্ত, প্রায়ই দেখা যায় তারা নানা ভাবে, কখনও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, কখনও পুলিশকে ঘুষ দিয়ে, কখনও অভিযোগকারীদের ভয় দেখিয়ে বিচারপ্রক্রিয়াকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা যাতে এ ভাবে শাস্তি এড়িয়ে যেতে না পারে বিচার ব্যবস্থার সে ব্যাপারে আরও সজাগ হওয়া জরুরি। কিন্তু তার সাথে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, শুধু আইন করে বা প্রচলিত আইনকে কঠোর করে কোনও কুপ্রথাকে সমাজ থেকে সমূলে উপড়ে ফেলা যায় না। যদিও পণপ্রথার বিরুদ্ধে যে আইন আছে, তাকে আরও কঠোর করা জরুরি, যাতে কেউ পণ নিতে ভয় পায়। কিন্তু শুধু আইনি ব্যবস্থার সাহায্যে পণপ্রথার মতো সমাজমননের গভীরে শেকড় গেড়ে থাকা একটি কুপ্রথাকে বন্ধ করা যায় কি? আইন থাকা সত্ত্বেও আঠারো বছরের নিচে ছেলেমেয়েদের বিবাহ দেশ জুড়ে আজও ব্যাপক। আইনসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সমাজে আজও বিধবা বিবাহ তেমন ভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আজও সমাজে শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে বেশিরভাগ পুরুষ নারীদের থেকে নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করে। নারীকে তার সহকর্মী, সহধর্মী হিসাবে দেখে না, দেখে ভোগের সামগ্রী হিসাবে।

সমাজে মূল্যবোধের যত অবক্ষয় হচ্ছে, গণতান্ত্রিক চেতনার মান যত নিম্নগামী হচ্ছে, ব্যক্তিগত ভোগ-লালসা যত বাড়ছে, পণের দাবি ততই বাড়ছে। মেয়ের বিয়ে দেওয়া মা-বাবার পক্ষে একটা অত্যন্ত কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত গুণই থাকুক এবং যত উচ্চশিক্ষিত হোক, মূলত পণ-সামগ্রীর মূল্যের বিচারেই বিয়ের বাজারে মেয়েদের মূল্য স্থির হয়। যদি কোনও কারণে দাবি অনুযায়ী সবকিছু মেয়ের পরিবার দিতে সক্ষম না হয় তা হলে অনেক সময় বিয়ে ভেঙে যায় বা মেয়েটিকে শ্বশুর বাড়িতে দিনের পর দিন অসহনীয় অপমান অত্যাচার সহ্য করতে হয়। আবার যে মা-বাবা নিজের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য পণের অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন, তারাই ছেলের বিয়ের সময় মেয়ের বাবার থেকে জবরদস্তি পণ আদায় করেন।

এই কুপ্রথার প্রতিকারের জন্য দরকার সমাজ অভ্যন্তরে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা, সমান অধিকার সমাজে প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতার পর কোনও সরকারই এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেনি। পণপ্রথার বিরুদ্ধে একটা তীব্র সুসংগঠিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলে তা থেকে যে সামাজিক চেতনা গড়ে উঠবে, তাতে বাবা-মা পণ নিয়ে বিয়ে করার জন্য জোর করলে যুবক-যুবতীরা যেমন আত্মগ্লানিতে ভুগবেন, তেমনই তা প্রত্যাখ্যান করার সাহস দেখাবেন।

এক সময় এই আন্দোলন কিছুটা হলেও হয়েছে। যুবকরা পণপ্রথার বিরোধিতা করেছে। তারা অভিভাবকদের অমান্য করে পণ না নিয়ে বিয়ে করেছে। আজও মর্যাদাবোধসম্পন্ন যুবকরা পণ ছাড়াই বিয়ে করেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে, নীতি-নৈতিকতা মূল্যবোধের সঙ্কটের কারণে হাত পেতে পণ নিতে অনেক শিক্ষিত পুরুষেরও রুচিতে বাধে না। বাস্তবিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর মানুষ হওয়ার শিক্ষার মধ্যে ফারাক আছে। কোনও না কোনও ভাবে সামাজিক সংগ্রামে অংশ না নিলে দ্বিতীয়টি অর্জন করা যায় না, যেখানে প্রথমটি শুধুই পুঁথিগত বিদ্যা। আবার কোনও কোনও মেয়ে নিজেই বিয়েতে বাবা-মার কাছে টাকা, গয়না, জিনিসপত্র চায়। এই অবস্থায় উন্নত রুচি, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলে যুবসমাজকে তাতে যুক্ত করতে না পারলে সমাজে পণপ্রথার মতো কুপ্রথাগুলি শুধু আইন করে বন্ধ করা যাবে না।

এই আন্দোলনে সংবেদনশীল সচেতন নারী-পুরুষ উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে। যদিও নারী-জীবনের এই সমস্যা থেকে মুক্ত হতে হলে নারীদেরই বেশি উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে না এলে চলবে না। বাইরে থেকে কেউ নারীদের মুক্তি বা স্বাধীনতা দিতে পারে না, যদি না নারীরা নিজেরা তা চায় ও অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে। তাই এ ব্যাপারে মহিলা সংগঠনগুলির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্যি অল ইন্ডিয়া মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়া অন্য কোনও সংগঠন নারীদের মধ্যে সচেতনতা জাগানো এবং স্বাধীনতার জন্য যথার্থ বিজ্ঞানসম্মত পথে তাদের সংগঠিত করে এই সমস্যা সমাধানে গণআন্দোলন গড়ে তোলার কাজটা করছে না।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৫ সংখ্যা (২৭ আগস্ট ২০২১)