Breaking News

‘রামনাম’ হাতিয়ার করে বেপরোয়া সন্ত্রাস চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা

বিজেপি জোট শাসিত রাজ্য ঝাড়খণ্ডে সম্প্রতি পিটিয়ে মারা হল তবরেজ আনসারি নামে এক যুবককে৷ এই নিয়ে ১৩ জন মানুষ ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার হলেন এক ঝাড়খণ্ড রাজ্যেই৷ হাত–পা ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে ‘জয় শ্রীরাম’, ‘জয় হনুমান’ হুঙ্কারে ১৮ ঘন্টা ধরে অত্যাচার চালানো হয় ওই যুবকের উপর৷ হাড় হিম করা সন্ত্রাস চালানোর দীর্ঘক্ষণ পরে সরাইকেলা–খরসোঁয়া জেলার এক গ্রাম থেকে মৃতপ্রায় ওই যুবককে পুলিশ উদ্ধার করলেও তাঁর কোনও চিকিৎসার ব্যবস্থা তারা করেনি৷ পুলিশি হেফাজতেই মৃত্যু হয় ওই যুবকের৷

পশ্চিমবঙ্গেও একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম আমরা৷ সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে কিছু আসন জেতার পর থেকেই বিজেপি–আর এস এস সহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে লোকজনকে রাস্তায় রাস্তায় ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে বাধ্য করার জন্য জবরদস্তি চালানো হচ্ছে৷ কয়েকদিন আগে ক্যানিং লোকাল ট্রেনে  ঘটল একই ঘৃণ্য ঘটনা৷ ‘হিন্দু সংহতি’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত একদল মত্ত যুবক এক মাদ্রাসা–শিক্ষকের উপর চড়াও হয়৷ তাঁর মাথার টুপি ও দাড়ি নিয়ে কটূক্তি করে তাঁকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলার জন্য নির্যাতন চালাতে থাকে৷ চোখে মুখে ঘুঁষি মেরে পাকিস্তান যাবার ফতোয়া দেয়৷ তারপর পার্কসার্কাস স্টেশনে চলন্ত ট্রেন থেকে তাঁকে ঠেলে ফেলে দেয়৷

কী দোষ ছিল তবরেজ আনসারি বা ওই শিক্ষকের? অপরাধ তাঁদের একটাই– তাঁরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী৷ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর যে লক্ষ্য নিয়ে বিজেপি চলছে, তাতে তারা মনে করে অহিন্দু সকলকে হিন্দুদের পদানত হয়ে থাকতে হবে৷ সেই উদ্দেশ্যে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতি জাগাতেই এই আক্রমণ৷ বিগত পাঁচ বছর কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকাকালীন বিজেপির এই চরম হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে অসংখ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে৷ ২০১৪–র লোকসভা নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’, ২০১৯–র লোকসভা নির্বাচন জিতে এর সাথে যুক্ত করলেন, ‘সবকা বিশ্বাস’৷

এই স্লোগান তুলে তিনি সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস বা আস্থা অর্জনের যে কথা বলছেন তা চূড়ান্ত ভণ্ডামিতে পূর্ণ৷ বাস্তবে ভোটে জিতে নতুন উদ্যমে নতুন শক্তিতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নখদন্ত মেলে ধরতে উদ্যত প্রধানমন্ত্রীর দল৷ এ দেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার সুনিশ্চিত বলে প্রধানমন্ত্রী যতই বাগাড়ম্বর করুন, প্রকৃত চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত মার্কিন বিদেশ দফতরের এক রিপোর্টেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে৷ ধর্মীয় হানাহানি, উগ্র জাতীয়তাবাদ যে ভারতের মতো বহু ধর্মীয়, বহু ভাষাভাষী দেশে স্বাধীনতার ক্ষেত্রটিকে খর্ব করেছে– তা রিপোর্টে বলা হয়েছে৷ গুজরাট, উত্তরপ্রদেশের মতো দশটি রাজ্যের নাম উল্লেখ করে রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ওই রাজ্যগুলিতে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালানো হয়৷ কখনও গো–রক্ষার নামে, কখনও ‘ঘরে ফেরানোর’ নামে চলছে মুসলিম ও দলিত হিন্দুদের ওপর আক্রমণ ও হত্যা৷

 কেন সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করা? কারণ বিগত ৫ বছর শাসন ক্ষমতায় থেকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর একটিও রক্ষা করেনি প্রধানমন্ত্রীর দল৷ দেশ জুড়ে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, নারী নির্যাতন, কৃষকের আত্মহত্যা প্রভৃতি ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে৷ উন্নয়নের কথা বলে ভোটে জিতলেও উন্নয়ন তো দূরের কথা মানুষ আজ বেঁচে থাকার সমস্ত সুযোগ ও অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত৷

বিপরীতে উন্নয়ন হয়েছে এ দেশের মালিক– টাটা, বিড়লা, আম্বানি, আদানিদের৷ এই মালিকরাই ভোটে জেতার জন্য বিজেপিকে হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়েছে৷ ফলে মালিকদের মুনাফার পাহাড় আরও স্ফীত করার উদ্দেশ্যেই নরেন্দ্র মোদি এবারেও ক্ষমতায় বসেই রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা সহ রেল, বিমান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সমস্ত ক্ষেত্রগুলিকে মালিকদের মুনাফা লুঠের মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত করতে চাইছে বিজেপি সরকার৷ আর মানুষের অবস্থা ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে৷

মানুষ চাইছে এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে৷ মানুষের ক্ষোভ যাতে বিজেপি বা সরকারের উপর ফেটে না পড়ে, তার জন্য জাত–পাত–ধর্ম–বর্ণ-ভাষা প্রভৃতিকে ভিত্তি করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে, যাতে মানুষ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে, সংগঠিত প্রতিবাদে সামিল না হতে পারে৷ গরিব–মেহনতি মানুষকে একে অপরের শত্রু বানিয়ে আসল শত্রু এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকে আড়াল করতে চাইছে অত্যন্ত সুচতুরভাবে৷

তবরেজ আনসারির হত্যা বা ক্যানিং লোকাল ট্রেনে মুসলিম ধর্মাবলম্বী শিক্ষকের নিগ্রহে অপরাধীদের শাস্তি হবে কি না কেউ জানে না৷ শাস্তি না পাওয়াই স্বাভাবিক৷ দিল্লির কাছে দাদরি গ্রামে মহম্মদ আখলাককে মিথ্যা গুজবে যারা হত্যা করেছিল, গত লোকসভা নির্বাচনে এক সভায় তাদের দেখা গেল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের সাথে৷ এই অপরাধীরা বিজেপি–আর এস এসের সম্পদ৷ ফলে ন্যায়বিচারের কোনও আশা নেই৷ চাই এর বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা)