Breaking News

সরকার চাইলে এখনই কমাতে পারে পেট্রল–ডিজেলের দাম

দিল্লি

পেট্রল–ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, বাসের ভাড়াবৃদ্ধি, রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সহ জনজীবনে বিভিন্ন আক্রমণের বিরুদ্ধে এস ইউ সি আই (সি) পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, সারা দেশে আন্দোলনে সামিল৷ এই আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী করার, দাবি আদায়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত এই দলের হাজার হাজার কর্মী৷

সরকার কী অজুহাতে পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়াল? সরকারের বক্তব্য আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে ভারতে তো বাড়বেই৷ সরকারের এই যুক্তি খাড়া করেই বাস মালিকরা দাবি তুলল তেলের দাম বেড়েছে, অতএব বাসের ভাড়া বাড়াতেই হবে৷

সরকার এবং মালিক পক্ষ এভাবেই যুক্তি করে থাকে৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে, ভারতের বাজারে দাম বাড়বেই –বিষয়টা কি সবসময় এমনভাবেই সম্পর্কিত? দেখা যাক, তথ্য কী বলে? আন্তর্জাতিক বাজারে এখন অশোধিত তেলের দাম কত? ব্যারেল প্রতি ৮০ ডলারের কাছাকাছি৷ সেই হিসাবে দেশীয় বাজারে এখন পেট্রলের দাম লিটারে ৮০ টাকার আশে পাশে এবং ডিজেলের দাম ৭০ টাকার মতো৷ কিন্তু আজ থেকে চার বছর আগে ২০১৪ সালের মে মাসে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠন করেন, সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম ছিল বর্তমানের দামের থেকে প্রায় ২৭ ডলার বেশি৷ এত বেশি দাম সত্ত্বেও তখন দেশীয় বাজারে পেট্রলের দাম ছিল ৭১.৭১ টাকা প্রতি লিটার, যা বর্তমানের দামের থেকে প্রতি লিটারে ৮ টাকা কম৷ আর ডিজেলের দাম ছিল ৫৬.৭১ টাকা যা বর্তমানের দামের থেকে প্রায় ১৪ টাকা কম৷

তথ্য দেখাচ্ছে, ২০১৪ সালের তুলনায় আজ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তো বাড়েইনি, বরং কমেছে ২৬.৯৪ ডলার৷ তা হলে কোন ভোজবাজিতে ভারতে দাম বেড়েই চলেছে? এর পিছনে রয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্স এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকারের বিপুল ট্যাক্স৷

২০১৪ সালের মে মাসের পর যাঁরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে তেলের দাম বৃদ্ধির সাফাই গেয়ে থাকেন, তাঁরা ভেবে দেখুন সরকার সম্পূর্ণ অন্যায় এবং অযৌক্তিকভাবে পেট্রল–ডিজেলের দাম বাড়িয়ে কীভাবে জনগণের পকেট ফাঁকা করছে৷

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যে ৭৩ শতাংশ কমল তার কোনও সুবিধা কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার দেশের মানুষকে পেতে দিল না৷ এর প্রায় সবটাই ট্যাক্স বাড়িয়ে লুটে নিয়েছে৷ এবার যুক্তির খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, সত্যি সত্যিই আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বেড়েছে৷ তা হলে যে সরকার নিজেকে দেশপ্রেমিক বলে দাবি করে, সে কি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির বোঝা দেশবাসীর উপর চাপাবে? ন্যূনতম প্রতিবাদটুকু করবে না? আমেরিকা সহ যে সাম্রাজ্যবাদী লবি তেলের দাম বাড়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলবে না? সমস্ত রকম কূটনৈতিক পথ অবলম্বন করে দাম কমানোর জন্য এদের উপর চাপ সৃষ্টি করবে না?  দেশে যে তেল কোম্পানিগুলি আকাশছোঁয়া মুনাফা করছে তাদের লুঠের রাশ টেনে ধরবে না? এর কোনও একটা কি করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি? গত চার বছরে বহুবার তিনি বিদেশ সফর করেছেন, তেলের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কোথাও কি সোচ্চার হয়েছেন? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিজেপি লৌহ পুরুষ, বিকাশ পুরুষ হিসাবে প্রচার করে৷ তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নে তাঁর ভূমিকা কী? তিনি দেশের অসহায় মানুষকে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদী শক্তির শোষণের মুখে ঠেলে দিলেন৷ একই সাথে অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত মানুষের উপর করের বোঝা বাড়ালেন৷ এর মধ্যে কোথায় মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা? কোথায় দেশপ্রেম?

এ বিভ্রান্তিও রয়েছে যে, ট্যাক্স না চাপালে, ট্যাক্স না বাড়ালে দেশ চলবে কী করে? দেশ চালানোর জন্য কিছু ট্যাক্স অবশ্যই প্রয়োজন আছে৷ কিন্তু এই ট্যাক্স আদায়ের টার্গেট কাদেরকে করা হবে? সরকার জনস্বার্থবাহী হলে সাধারণ মানুষের উপর ট্যাক্স কম করে, পুঁজিপতিদের উপর ট্যাক্স বাড়াবে৷ কিন্তু এদেশে নানা সময়ে শাসন ক্ষমতায় থাকা বিজেপি–কংগ্রেসের ইতিহাস কী? তারা ক্ষমতায় থেকে পুঁজিপতিদের কোটি কোটি টাকা ট্যাক্স ছাড় দিয়েছে, বিপরীতে জনসাধারণের উপর ট্যাক্স বাড়িয়েছে৷ আবার এ কথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, ট্যাক্স আদায় হলেই তার সবটা দেশের স্বার্থে খরচ হয়৷ সম্প্রতি নীরব মোদি, মেহুল চোকসি সহ যে সমস্ত পুঁজিপতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে পালিয়েছে, তাদের ঋণ শোধ করছে সরকার জনগণের দেওয়া ট্যাক্স থেকে৷ ফলে ট্যাক্স না বাড়লে দেশ চলবে কী করে এই ভাবনাটা অত্যন্ত শিশুসুলভ৷ একটা শ্রেণি বিভক্ত সমাজে কোন শ্রেণির উপর কোন শ্রেণির সরকার ট্যাক্স আরোপ করছে, কী উদ্দেশ্যে করছে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় আনা অত্যন্ত জরুরি৷

বাসের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রেও এক তরফা ভাবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিকে অজুহাত করা চলে না৷ এ কথা ঠিক, বাস মালিকরা বিনালাভে বাস চালাবে না৷ কিন্তু কতটা লাভ রেখে চালাবে তার কি স্পষ্ট গাইডলাইন থাকবে না? মালিক এবং সরকার মিলেই কি ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারে? এ ক্ষেত্রে পরিবহণ যাত্রীদের বক্তব্য কেন শোনা হবে না? তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয় কেন বিবেচনায় আনা হবে না? ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানেন বাসে যাত্রীস্বাচ্ছন্দ্য এখনও সম্পূর্ণ উপেক্ষিত৷ বাসে ওঠার সিঁড়ি, আসন, জানলা, হাতল, ব্যাগপত্র রাখার ব্যবস্থা, সবেতেই রয়েছে কোনও না কোনও সমস্যা৷ আসন এত সরু যে ধারে বসা যাত্রীকে অত্যন্ত অস্বস্তিকর ভাবে থাকতে হয়৷ একটু বৃষ্টি হলেই ভিজে একসা হতে হয়৷ দুই আসনের মধ্যে ব্যবধানও এত কম থাকে যে যাত্রীদের হাঁটু মুড়ে কষ্ট করে বসতে হয়৷ আসন সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি যাত্রী তোলা হয়৷ ফলে দাঁড়িয়ে যেতে হয় অনেককেই৷ ধরার হাতলগুলিও এমন অবৈজ্ঞানিকভাবে সেট করা যে,  চলন্ত বাস ব্রেক কষলেই হ্যাঁচকা টানে পাশের দিকে ছিটকে যায় যাত্রীর শরীর৷ যে কারণে পিঠে, কোমরে, কাঁধে, ঘাড়ে টান বা চোট বাসযাত্রীদের নিত্যসঙ্গী৷ এগুলি সমাধানে বাস মালিকরা যে নজর দেন না, রাজ্য পরিবহন দপ্তর সেটাও দেখে না৷

জ্বালানি তেল সভ্যতার চালিকা শক্তি৷ সমস্ত উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে প্রয়োজন৷ এর দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে দিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সমস্ত পণ্যের দাম বৃদ্ধির রাস্তা খুলে দিল৷ বাস–ট্রামের ভাড়াবৃদ্ধি, রেলের ভাড়াবৃদ্ধি, লঞ্চ স্টিমারের ভাড়াবৃদ্ধি, ট্রাকের ভাড়াবৃদ্ধি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিকে আকাশছোঁয়া করে তুলবে৷ চাষে সেচের খরচ বাড়ায় কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে৷ সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে জনসাধারণকে বাড়তি মূল্য দিতে হবে৷ সরকার ‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার’ কথাটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কী নির্মম প্রহসন!

(৭০ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা ১৫জুন, ২০১৮)