পহেলগাঁওয়ে ২৬ জন পর্যটকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে সারা দেশ স্তম্ভিত। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রতিটি ভারতবাসী এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করছে। অবিলম্বে হত্যাকারী সন্ত্রাসবাদীদের খুঁজে বের করে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। শুধু দেশে নয়, এই সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সন্ত্রাসবাদীরা যাঁদের খুন করেছে তাঁদের মধ্যে যেমন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নাগরিকরা আছেন তেমনই রয়েছেন দু’জন নেপালের নাগরিক। এই বর্বর হত্যাকাণ্ডকে কাপুরুষোচিত আখ্যা দিয়ে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি দাবি করেছেন।
গোয়েন্দা ব্যবস্থা ব্যর্থ হল কী করে
ভারতে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ এর আগেও বহু বার হয়েছে। শুধু বিজেপি শাসনেই উরি, পাঠানকোট, অমরনাথ, পুলওয়ামার মতো জঙ্গি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এ বারের হামলা যেন আগেরগুলির থেকে অন্য মাত্রার। জানা গেছে, ঘটনার আগে সন্ত্রাসবাদীরা এলাকা ঘুরে পরিকল্পনা ছকে গিয়েছে। বেঁচে যাওয়া পর্যটকদের বয়ান অনুযায়ী, ঘটনার দিনও সন্ত্রাসবাদীরা সেনার পোশাকে ধীরেসুস্থে এলাকায় পৌঁছে পর্যটকদের একে একে খুন করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আবার তারা ধীরেসুস্থে এবং নিরাপদে ফিরে গেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, পুরো ঘটনাটি জঙ্গিদের নিখুঁত এবং দীর্ঘ পূর্বপরিকল্পনার ফল। আশ্চর্যের বিষয়, সরকারি বয়ান অনুযায়ী গোয়েন্দারা ঘুণাক্ষরেও এই পরিকল্পনা আগে টের পায়নি। এই দীর্ঘ সময়ে মিলিটারি, সীমান্তরক্ষী বাহিনী কিংবা পুলিশের কোনও দেখা মেলেনি। স্বাভাবিক ভাবেই মৃত পর্যটকদের পরিবারের সাথে সারা দেশের মানুষ প্রবল ক্ষোভে প্রশ্ন তুলেছেন, পহেলগাঁওয়ের মতো পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এমন জায়গায় এই সময়ে যে খুবই ভিড় থাকে তা জানার পরও সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা রাখা হল না কেন? কেন জঙ্গিদের পরিকল্পনা গোয়েন্দারা জানতে পারল না? ঘটনাস্থলে নিরাপত্তারক্ষীদের পৌঁছতে কেন এত দেরি হল? এতখানি নিরাপত্তাহীন অবস্থায় পর্যটকদের কেন যেতে দেওয়া হল? কাশ্মীর জুড়ে যেখানে কয়েক মিটার অন্তর সশস্ত্র সেনা প্রহরা থাকে, পর্যটকরা পর্যন্ত বারবার তল্লাসির মুখে পড়েন, সেখানে এমন ভরা পর্যটন মরসুমে ধারেকাছে কোনও সেনা, পুলিশ কারও দেখা মিলল না, এটা কী করে সম্ভব হল?
জানা যাচ্ছে, ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী নিরাপত্তা পোস্টের দূরত্ব ২০ কিমি। অবাক ব্যাপার! এই কি তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-বর্ণিত আঁটোসাঁটো নিরাপত্তার ব্যবস্থা? এর উপর নির্ভর করেই কি প্রধানমন্ত্রী বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ায় কাশ্মীর এখন সন্ত্রাসমুক্ত? এই কি তাঁদের নোট বাতিলের মধ্যে দিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের কোমর ভেঙে দেওয়ার নমুনা? তাঁদের এমন বক্তৃতায় বিশ্বাস করে পর্যটকরা যে নিশ্চিন্ত মনে সেখানে গিয়েছিলেন, সেই বিশ্বাস করাটাই কি তাঁদের অপরাধ? এর দায় কেন প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করবেন না? এ কথা সবার জানা যে, এ সব কোনও প্রশ্নেরই উত্তর বিজেপি সরকার দেশের মানুষকে দেবে না। ঠিক যেমন, ২০১৯-এ নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যেও কী করে সন্ত্রাসবাদীরা পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে হামলা করে ৪০ জন জওয়ানকে হত্যা করতে পেরেছিল, এ প্রশ্নের উত্তর সরকারের কাছ থেকে দেশের মানুষ আজও পায়নি।
দুর্গতদের পাশে ছিলেন স্থানীয় কাশ্মীরীরাই
অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকা হওয়া সত্ত্বেও পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য সে দিন কোনও নিরাপত্তারক্ষীর দেখা মেলেনি। পর্যটকদের বাঁচাতে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র কেড়ে নিতে গিয়ে খুন হয়েছেন টাট্টু চালক সইদ আদিল হুসেন শাহ। মৃত পর্যটকদের বেঁচে ফেরা আত্মীয়রা জানিয়েছেন, জঙ্গিরা চলে যাওয়ার পরেও প্রায় এক ঘণ্টা কোনও সেনা বা পুলিশের দেখা মেলেনি। দীর্ঘ সময় ধরে রক্তক্ষরণের কারণেও অনেকে মারা গেছেন। পর্যটকদের বক্তব্য, যদি সঙ্গে সঙ্গে সেনার সাহায্য পাওয়া যেত, যদি হেলিকপ্টারে দ্রুত আহতদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া যেত তবে হয়তো অনেককেই বাঁচানো যেত। সন্ত্রাসী হামলার পর থেকেই ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক হুঙ্কারে বিজেপি-আরএসএস নেতারা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলছেন, অথচ সেই সময় নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে দুর্গতদের বাঁচাতে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আহতদের কাঁধে চাপিয়ে দুর্গম পথ ধরে হেঁটে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁরা সকলে স্থানীয় বাসিন্দা এবং ধর্মে মুসলমান। এর দ্বারা তাঁরা প্রমাণ করেছেন, তাঁদের প্রথম পরিচয় তাঁরা মানুষ, তার পরে তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়। জঙ্গিদের গুলিতে আহত পিতাকে নিয়ে দিশেহারা মহিলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় দুই কাশ্মীরী যুবক। নিজেদের প্রাণের পরোয়া না করে তাঁরা মৃতপ্রায় মানুষটিকে কাঁধে করে নীচে নামিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন, পাশে থেকেছেন। যা দেখে মহিলা বলেছেন, সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে আমি আমার পিতাকে হারালেও পেয়েছি দুই ভাইকে। স্থানীয় মানুষের মানবিকতার এমন অনেক উদাহরণ উজ্জ্বল হয়ে ফুটে রয়েছে সেই রক্তাক্ত দিনটির গাঢ় অন্ধকারে। আজ যখন হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের জিগিরে বিজেপি-আরএসএস নেতারা গলা ফাটাচ্ছেন, তখন সীমান্তে অনুপ্রবেশ আটকাতে গিয়ে প্রাণ দেওয়া জওয়ান নদীয়ার ঝন্টু শেখের পিতা মৃত সন্তানের সামনে দাঁড়িয়ে গভীর ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, সন্তানের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের প্রমাণ করতে হচ্ছে, আমরা ভারত বিরোধী নই।
অন্য দিকে কাশ্মীরবাসীরাই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের প্রতিবাদে কাশ্মীর জুড়ে অভূতপূর্ব বনধ পালন করেছেন। মোমবাতি মিছিল থেকে তাঁরা স্লোগান তুলেছেন, আমরা প্রথমে ভারতীয় তার পরে কাশ্মীরী। কাশ্মীরের মসজিদে মসজিদে সে দিন এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে।
এতগুলি মৃত্যু, তবু লক্ষ্য শুধুই ভোটব্যাঙ্ক!
অথচ বিজেপি নেতারা মেতে উঠেছেন এই হত্যাকাণ্ডের জন্য গোটা মুসলমান সমাজকে দায়ী করে প্রচার চালাতে। তাঁরা প্রচার করছেন মুসলমান মাত্রেই জঙ্গি। এর একমাত্র উদ্দেশ্য– দেশ জুড়ে মুসলমান বিরোধী মানসিকতা তৈরি করে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে মজবুত করা। না হলে সংগঠিত গণহত্যা বলেই কি কোনও বিশেষ ধর্মকে কাঠগড়ায় তোলা যায়? সন্ত্রাসবাদীদের মুসলমান পরিচয়ের জন্য যদি গোটা মুসলমান সমাজকে দায়ী করা হয় তা হলে মালেগাঁও বিস্ফোরণে বহু মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেত্রী সাধ্বী প্রজ্ঞার হিন্দু পরিচয়ের জন্য তো গোটা হিন্দু সমাজকে দায়ী করতে হয়! সাধ্বী প্রজ্ঞা এবং তাঁর সহযোগীদের ফাঁসি চেয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ। একই ভাবে ওড়িশায় খ্রিস্টান যাজক গ্রাহাম স্টেইনসকে হত্যা করেছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সদস্যরা। নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশদের যাঁরা খুন করেছে তারাও তো সংগঠিত হত্যাকাণ্ডই চালিয়েছে। বিজেপির যুক্তিধারা মানলে এই সব হত্যাকারীদের হিন্দু পরিচয়ের জন্য তো গোটা হিন্দু সমাজকেই দায়ী করতে হয়! তা কি কেউ করবে? না, করলে তা যুক্তিসঙ্গত হবে? অথচ শুধুমাত্র ভোটের স্বার্থে আজ বিজেপি নেতারা এই ঘটনাকে পুঁজি করে মুসলমান বিরোধী বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
সন্ত্রাসবাদীর পরিচয় সন্ত্রাসবাদীই
অথচ কে না জানে যে সন্ত্রাসবাদীদের একটাই পরিচয় তারা সন্ত্রাসবাদী, খুনি। পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদীরা যে পর্যটকদের খুন করেছে তাঁদের অধিকাংশ ধর্মে হিন্দু এ কথা ঠিক, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কাশ্মীরের অধিবাসীদেরই জীবন-জীবিকার, যাঁদের বেশির ভাগই ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান। কাশ্মীরবাসীর জীবিকা মূলত যে পর্যটন শিল্প নির্ভর, সেই পর্যটন শিল্পেরই এর দ্বারা ক্ষতি হল সবচেয়ে বেশি। এই ঘটনার পর দেশের নানা প্রান্তে হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন সাধারণ কাশ্মীরী মানুষ এবং ছাত্রছাত্রীরা। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই হামলার প্রতিক্রিয়া হিসাবে যে ভারত থেকে সমস্ত পাকিস্তানীদের বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছে, ভারত থেকে পাকিস্তানে বয়ে যাওয়া সিন্ধু নদীর জল বন্ধের হুমকি দিয়েছে তা কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ, যাঁরাও ধর্মে মুসলমান। উন্নত মানের চিকিৎসার জন্য পাকিস্তান থেকে যে সব মুসলিমরা ভারতে আসেন, তারাও অসহায় হলেন। অর্থাৎ এই হত্যাকাণ্ডের দ্বারা মুসলমান স্বার্থ রক্ষা দূরের কথা মুসলমান ধর্মের মানুষেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে এই সন্ত্রাসবাদীরা। এর থেকেই স্পষ্ট পর্যটকদের হত্যাকারীদের আসল পরিচয় ধর্মে নয়, তাদের একমাত্র পরিচয় তারা মানবতাবিরোধী, সন্ত্রাসবাদী, খুনি।
এর দায় কার?
নিরাপত্তার কঠোর বেষ্টনী কাশ্মীর জুড়ে। অথচ প্রয়োজনের সময়ে কারও দেখা মিলল না। অসহায় ভাবে এতগুলি প্রাণ চলে গেল। স্বাভাবিক ভাবেই দেশ জুড়ে প্রশ্ন উঠছে, এর দায় কার? এই রকম পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনী এবং গোয়েন্দা বিভাগের চরম ব্যর্থতার জন্য সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের লজ্জিত হওয়া উচিত ছিল, দেশবাসীর কাছে এই ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল, উচিত ছিল সারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। অথচ দেখা গেল, কেন্দ্রের শাসক দলটি রাজ্যে রাজ্যে তাদের নেতা-কর্মীদের নামিয়ে দিল এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন তৈরির কাজে। যেহেতু মৃত পর্যটকদের প্রায় সকলেই হিন্দু তাই তাঁদের হত্যাকারীদের মুসলমান ধর্ম-পরিচয়টিকেই বিজেপি-আরএসএস নেতারা বড় করে দেখিয়ে বিদ্বেষ ছড়াতে থাকলেন। এই বিপজ্জনক বিভাজনের রাজনীতি বিরুদ্ধে সমাজের চিন্তাশীল মানুষ একদিকে যেমন প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন, তেমনই প্রশ্ন তুলেছেন যে, এমন সন্ত্রাসের ঘটনাগুলি যে নির্বাচনের সময়েই ঘটে তা কি কাকতালীয়? পুলওয়ামা ঘটনার পর উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচার চালিয়ে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ফয়দা তুলেছিল বিজেপি। এ বছর বিহারে এবং পরের বছর পশ্চিমবঙ্গ এবং তার পরের বছর উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন। অথচ মানুষের সমর্থন পাওয়ার মতো বিজেপি নেতাদের হাতে কিছুই নেই। তা হলে এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী জিগির তোলার চেষ্টা কি নির্বাচনগুলিকে সামনে রেখেই? প্রশ্নগুলি মানুষকে গভীর ভাবে ভাবাচ্ছে।
দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা
দেশের সঙ্কটজনক আর্থিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় আজ সমস্ত দিক থেকে ব্যর্থ বিজেপি সরকার। জীবনদায়ী ওষুধ সহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাফিয়ে বাড়ছে, সমান তালে বাড়ছে বেকার সমস্যা। ট্রাম্প ঘোষিত শুল্ক যুদ্ধ এই সংকটকে আরও তীব্র করে তুলছে। সরকারি সহযোগিতায় শ্রমিক শ্রেণির উপর মালিক শ্রেণির শোষণ ক্রমাগত তীব্র আকার নিচ্ছে। ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে বাড়ছে কৃষক আত্মহত্যা। ক্ষোভে ফুঁসছে শ্রমিক কৃষক সহ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। বিজেপি সরকারের শ্রমিক-কৃষক স্বার্থবিরোধী নীতিগুলির প্রতিবাদে ২০ মে দেশজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে দেশের শ্রমিক-কৃষক সংগঠনগুলি। ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে শ্রমিক কৃষক সাধারণ মানুষ দেশ জুড়ে ব্যাপক প্রস্তুতি চালাচ্ছেন। এই তীব্র ক্ষোভের সামনে পড়ে ভীত শাসক শ্রেণি, ভীত তাদের সেবাদাস হিসাবে কাজ করা বিজেপি নেতারা। শোষিত মানুষের বাঁচার এই লড়াইকে দুর্বল করতে, তাঁদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিভাজন তৈরি করতে এই সন্ত্রাসী হামলাকে কাজে লাগাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির বিশ্বস্ত সেবাদাস বিজেপি নেতারা।
দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত হননি
দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, চিন্তাশীল মানুষ কিন্তু বিজেপি-আরএসএসের এই মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত হননি। তাঁরা শাসক দলের প্রচারের মিথ্যা ফাঁস করে দিচ্ছেন। তাই বিজেপি ও সংঘ পরিবার সন্ত্রাসবাদীদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিবর্তে সেকুলার বুদ্ধিজীবী এবং বামপন্থীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছে। কারণ বিজেপি এবং আরএসএস নেতারা যে ভাবে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য গোটা মুসলমান সমাজকে দায়ী করছেন, এঁরাই সাহসের সাথে তার বিরোধিতা করছেন। বিজেপি আরএসএসের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূলে যে রয়েছে আসলে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরির লক্ষ্য এবং সমাজের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ-লুণ্ঠনকে অবাধে চলতে দেওয়া, তা সমাজের এই সেকুলার এবং বামপন্থী অংশটিই জনগণের সামনে ফাঁস করে দিচ্ছেন। তাই হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের নিশানায় পরিণত হয়েছেন সেকুলার বুদ্ধিজীবী এবং বামপন্থীরা। বাস্তবে সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আচ্ছন্ন এই সব নেতাদের সেকুলারিজম সম্পর্কে কোনও সঠিক ইতিহাসম্মত ধারণাই নেই। সেকুলাররা মনে করে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্ম নাগরিকদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। একটি যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ তথা সেকুলার রাষ্ট্র ব্যক্তির ধর্মবিশ্বাস, রীতিনীতি ও ধর্মীয় প্রচারকে যেমন কোনও ভাবে উৎসাহ জোগায় না, তেমনই প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি করে না। বিপরীত পক্ষে তা ধর্মে বিশ্বাসী জনসাধারণ এবং কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করে না এমন জনসাধারণ– উভয়েরই সমান অধিকারের নীতিকে কার্যত স্বীকার করে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তির দ্বারা। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, সুভাষচন্দ্র, ভগৎ সিং প্রমুখ মনীষীর সকলেই রাষ্ট্রের এমন ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকার কথাই বলে গেছেন। অথচ এই সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা ভোট-রাজনীতির স্বার্থে এই নীতিকেই আঘাত করছে।
হিন্দুত্ববাদীদের এই জঘন্য সাম্প্রদায়িক প্রচারে সর্বাত্মক ভাবে সঙ্গত দিচ্ছে সংবাদমাধ্যমের একচেটিয়া পুঁজি নিয়ন্ত্রিত একটি বড় অংশ। তারা চব্বিশ ঘণ্টা এই সন্ত্রাসী হামলাকে হিন্দুদের উপর মুসলমানের হামলা বলে প্রচার চালাচ্ছে। একই রকম প্রচার চালাচ্ছে শাসক দলের বেতনভোগী আইটি সেলগুলি। তারা সামাজিক মাধ্যমগুলিতে লাগাতার কদর্য ভাষায় আক্রমণ চালাচ্ছে সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে। রবীন্দ্রনাথ নজরুল সহ মনীষীদের বক্তব্যকে বিকৃত করে প্রচার চালাচ্ছে। এই সমাজমাধ্যমেই সরকার বিরোধী সামান্য কোনও বক্তব্য থাকলে কর্তৃপক্ষ ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ভায়োলেশন’ এর দোহাই তুলে তা মুহূর্তে মুছে ফেলে। অথচ এমন মারাত্মক সাম্প্রদায়িক প্রচারগুলি তারা সরকারি মদতে নিশ্চিন্তে চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও সংবাদমাধ্যমের অন্য একটি অংশ সরকারি নিরপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি এবং এই জঘন্য সাম্প্রদায়িক প্রচারের বিরোধিতা করছে। বহু সাংবাদিকও ব্যক্তিগত ভাবে এর বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখছেন।
তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সমস্ত রকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উস্কানির মোকাবিলায় সব স্তরের সাধারণ মানুষ, শোষিত মানুষ সহ মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ব্যাপক সংখ্যক জনসাধারণের মধ্যে নবজাগরণ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের মনীষীদের ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে বক্তব্যকে তুলে ধরতে হবে। জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাতে শামিল করতে হবে সব স্তরের শোষিত জনগণকে। তা না হলে সমাজের গরিব মানুষ নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত সহ চিন্তাশীল সব মানুষই বারে বারে এই উগ্রবাদীদের অসহায় আক্রমণের শিকার হবেন।