১৯ ডিসেম্বর মহারাষ্ট্রের পুণের এক সভায় আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তব্য অনেককে বিস্মিত করেছে। তিনি বলেছেন, রাম মন্দির নির্মাণের পর থেকে কেউ কেউ ভেবে নিয়েছেন, নতুন নতুন জায়গায় একই ধরনের কাজ করে তাঁরা হিন্দুদের নেতা হয়ে উঠবেন। তিনি বলেছেন, প্রতিদিন নতুন নতুন বিতর্ক খুঁজে বার করা হচ্ছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আরএসএসের আদর্শ, নীতি, কর্মপ্রক্রিয়া সম্বন্ধে কিছু ধারণা থাকলে এই কথায় বিস্মিত না হওয়াটাই বিস্ময়ের। ব্যাপারটা আরও বিস্ময়কর হয়ে দাঁড়ায় যখন মনে পড়ে, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-আরএসএসের বর্তমান প্রধান আইকন নরেন্দ্র মোদির মুখনিঃসৃত বাণী– ‘হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র’ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দিয়ে দেবে কংগ্রেস। সেই সময় মোহন ভাগবতজির নীরবতার বিশেষ বার্তা ছিল না কি? যখন নরেন্দ্র মোদিজি বিশেষ ধর্মের মানুষদের দিকে আঙুল তুলে বলেন, ‘পোশাক দেখেই বোঝা যায় কারা সন্ত্রাসবাদী!’ মোহন ভগবতজির নীরবতা যে সম্মতির লক্ষণ, তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় কি? তা হলে এখন তাঁর হল কী?
সভাটি ছিল ‘বিশ্বগুরু ভারত’ বিষয়ে, অতএব মোহন ভাগবতজির কথাতে ঔদার্য ফোটানোর দায়ও ছিল। আন্তর্জাতিক মহলে বিজেপি শাসিত ভারতের যে পরিচয় দাঁড়িয়েছে, তা যে খুব গর্বের কিছু নয়, ভাগবতজির সেটা অজানা নয়। বিশ্বের বহু মানুষের চোখে এখন ভারত মানে ধর্মান্ধ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক একটি দেশ। যেখানে গো-রক্ষার নামে মানুষকে পিটিয়ে মারা যায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি সম্বলিত ঘৃণা-ভাষণ দিয়ে হাততালি কুড়ানো যায়, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন নিয়ে গর্ব করে ভোট চাওয়া যায়। এমনকি ২০০২-এর গণহত্যার নায়কদেরও দেশের সর্বোচ্চ পদে তিন-তিনবার বসিয়ে দেওয়াও আজ অক্লেশে সম্ভব! এটা জেনেই বিজেপির অভিভাবক হিসাবে তাদের ভাবমূর্তি রক্ষার চেষ্টার দায় থেকেই ‘বিশ্বগুরু’ সাজার মঞ্চে তাঁকে এ কথা বলতে হয়েছে।
মোহন ভাগবতজি ২০২২-এও একবার বলেছিলেন, রামমন্দির তৈরি ছিল হিন্দুদের বিশ্বাসের বিষয়, আমরা কাজটা শেষ করেছি। এখন আর এ নিয়ে জঙ্গি আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। প্রত্যেক মসজিদের নিচে শিবলিঙ্গ খোঁজা আর প্রত্যেক দিন একটি করে বিতর্ক তোলা উচিত নয়। তা হলে! তিনি কি আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনও পরিবর্তন এনেছেন? দেখা যাচ্ছে, ভাগবতজির পুণে বত্তৃতারদশদিনপরেইআরএসএস-এরমুখপত্রঅর্গানাইজারেরকভার-স্টোরিতেসম্ভলেরমসজিদেরঅধিকারদাবিকরেলেখাহয়েছে, ‘ব্যাটল ফর সিভিলাইজেশনাল জাস্টিস’ অর্থাৎ সভ্যতার ন্যায় বিচারের প্রশ্নে লড়াই চলছে। মোহন ভাগবতজি ২০১৪-তে কটকের একটি সভায় বলেছিলেন, ‘হিন্দুস্তানের গভীরে একটাই ধর্ম প্রোথিত আছে। সেটি হল হিন্দুত্ব’(বর্তমান ১৯.০৮.২০১৪)। তাঁর কথায়, ‘ভারত হিন্দু রাষ্ট্র। দেশের প্রতিটি হিন্দু পরিবারের মধ্যে সেই হিন্দু পরিচয়ের আত্মশ্লাঘা জাগিয়ে তুলতে হবে। ভারতের সংস্কৃতির সনাতন আচারই হল হিন্দুত্ব’ (ওই)। তিনি আরও বলেছেন, ‘এক জায়গায় সব হিন্দুকে জল খেতে হবে। একই ধর্মস্থলে তাদের প্রার্থনা করা উচিত। এমন কি মৃত্যুর পর একই জায়গায় সকলের শেষকৃত্য হওয়া উচিত’(আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯.০৮.২০১৪)। মোহন ভাগবতজি ২০২৩-এর ৩১ আগস্ট ‘দৈনিক তরুণ ভারত’-এর একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্র এবং এটাই সত্য যে সমস্ত ভারতীয়ই হিন্দু।’ গত বছর জানুয়ারি এবং এই বছর অক্টোবরে দুটি বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, ‘হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দুরা যুদ্ধের মধ্যে আছে,’ এবং তিনি হিন্দু সমাজকে পরামর্শ দেন নিজেদের সুরক্ষার জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪)। কে হিন্দু এই প্রশ্নে আরএসএস-এর পরম পূজনীয় বিডি সাভারকর বলছেন, ‘যে ব্যক্তি সিন্ধু থেকে সমুদ্র পর্যন্ত দেশকে নিজেদের পূর্বপুরুষের দেশ পিতৃভূমিরূপে গণ্য করে, বৈদিক সপ্তসিন্ধু থেকে উদ্ভূত জাতির রক্তের অধিকার বলে দাবি করে– যারা একই ইতিহাস ও সাহিত্য, কলা, সংস্কৃতি বিধি ও সংস্কার ইত্যাদির মাধ্যমে অভিব্যক্ত ওই জাতির সংস্কৃতিকে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে, সর্বোপরি যারা হিন্দুস্তানকে নিজেদের পূণ্যভূমি বা পবিত্রভূমি বলে গণ্য করে, এই দেশকে নিজেদের মহাপুরুষ ও গুরু, ঋষি ও অবতারের নিবাস ও তীর্থভূমি বলে মেনে নিয়েছে তাকেই হিন্দু বলা যাবে। হিন্দুত্বের লক্ষণ হল এক রাষ্ট্র, এক জাতি, এক সংস্কৃতি’ (হিন্দুত্ব, বিডি সাভারকর, পৃঃ ১৩২)। সাভারকরের কথা অনুযায়ী হিন্দুত্বের লক্ষণ যদি এক রাষ্ট্র, এক জাতি, এক সংস্কৃতি হয় এবং তার সাথে মিলিয়ে ভাগবতজির পুরনো কথাগুলোকে একবার স্মরণ করা যায়– দেখা যাবে, নানা ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় নিয়ে যে বৈচিত্র্যের রূপ ভারতে দেখা যায়, আরএসএস তার বিরোধী। তাঁদেরই ব্যাখ্যা অনুযায়ী আরএসএস-এর কাঙিক্ষত হিন্দুরাষ্ট্রে খ্রিস্টান, মুসলমানদের স্থান কী হবে? সাভারকর বলেছিলেন, ‘একটা জাতি, সে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষের দ্বারাই তৈরি হবে। জার্মানিতে ইহুদিদের কী করা হয়েছে? তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ বলে তাদের জার্মানি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল’(এমএসএ হোম স্পেশাল বিভাগ, ৬০ডি (জি) পিটি-৩, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি, ২২-১-২০০০-এ উদ্ধৃত)। মোহন ভাগবতজি কি বিনায়ক দামোদর সাভারকরের এই ইচ্ছার বিরোধিতা করার কথা ভাবছেন? এমনটা তো শোনা যায়নি! তা হলে তাঁর ‘হিন্দু মুসলিম এক ডিএনএ’ ধরনের কথাগুলোকে কীভাবে দেখতে হবে?
এটা বুঝতে একটু অন্য দিকে তাকাতে হবে। মোহন ভাগবতজির বক্তব্যের বিরুদ্ধে অখিল ভারতীয় সন্তসমিতি থেকে শুরু করে নানা হিন্দুত্ববাদী ওয়েবসাইট ও যোগী আদিত্যনাথের মতো বিজেপি নেতাদের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় অনেকে অবাক হয়েছেন। এতে একটা বিষয় বোঝা গেছে যে, আরএসএস এখন আর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একচ্ছত্র হৃদয়সম্রাট নেই। সিবিআই প্রাক্তন প্রধান বিজেপি ঘনিষ্ঠ এম নাগেশ্বর রাও এমনকি বছর দুয়েক আগেই ভাগবতকে ‘মেকি হিন্দু, ভণ্ড বলেছেন’। কিন্তু সাথে সাথে এটাও বুঝতে হবে, তাঁদের এই আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ধর্মের কোনও বিষয় নেই। পুরো বিষয়টাই রাজনৈতিক গদির দ্বন্দ্ব। মোহন ভাগবতজি বিজেপির প্রচলিত লাইন ধরে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের দেশের মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তুলে ধরার দায়িত্বপ্রাপ্ত। এজন্যই তিনি কি একটু উদার! বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কিছু ভিড় জমাতে পারলেও তাদের অপশাসনে মানুষের যে দুর্দশা, তা এই দিয়ে পুরোটা ঢাকা যাচ্ছে না। এই সত্যটা মোহন ভাগবত থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের চেয়ে বেশি কেউ জানেন না। অন্য দিকে বিজেপির সম্বলও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিটাই। ফলে উত্তরপ্রদেশ থেকে শুরু করে নানা রাজ্যে ভোটে জেতার জন্য তাদের নেতাদের উগ্র হিন্দুত্বের রাস্তাতেই হাঁটতে হচ্ছে। তাই উত্তরপ্রদেশেই কাশী-মথুরা-সম্ভল সহ প্রায় ৫০টি মসজিদের নিচে মন্দির খোঁজার জন্য নানা কর্মকাণ্ড চলছে। এ ব্যাপারে আদালতগুলোর ভূমিকাও অদ্ভূত। যে সব আদালতে বছরের পর বছর গুরুত্বপূর্ণ মামলা পড়ে থাকে সেই আদালতই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মসজিদের নিচে মন্দির খোঁজার সমীক্ষার নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছে। দেখে মনে হতে পারে ১৯৯১ সালের উপাসনালয় আইন– যেখানে বলা হয়েছে, ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট সমস্ত উপাসনালয় যে চরিত্র নিয়ে ছিল তার কোনও পরিবর্তন করা যাবে না, এর কোনও অস্তিত্বই যেন আদালত জানে না! এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সদ্যপ্রাক্তন প্রধান বিচারপতিও আশ্চর্য ভূমিকা নিয়েছেন জ্ঞানবাপী মসজিদের ক্ষেত্রে। তিনি আইনটির অস্তিত্ব জেনেও মসজিদের নিচে সমীক্ষার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য তিনি বলেছেন, তিনি আদালতে যে সব মন্তব্য করেছিলেন, সেগুলোকে রায়ের অংশ হিসাবে গ্রহণ করার দরকার নেই। অন্য দিকে আরএসএস নেতারা অতীতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভিত্তিতে যতটা শ্রদ্ধা সম্মান পেতেন, আজ আর খুব গোঁড়া হিন্দুদের মধ্যেও তা পান না। তাঁদের কর্মকাণ্ডের বেশিরভাগটাই যে, গদির লোভের সাথে যুক্ত, টাকার থলির জোরেই তাদের জোর এটা আজ খুব অস্পষ্ট নেই। ফলে মোহন ভাগবতজিরা এখন তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে খুব বেশি উগ্রতা চাইছেন না। বিশেষত তিনি যখন জানেন যে, বিচারবিভাগে এবং প্রশাসনের উচ্চ থেকে নিম্ন সব স্তরেই সাম্প্রদায়িক মনোভাবের দ্বারা প্রভাবিত লোকজনকে ইতিমধ্যেই বসানো গেছে, তাঁরাই বিজেপি-আরএসএস-এর অ্যাজেন্ডা পূরণে উদ্যোগ নেবেন। তাই মোহন ভাগবতজি পরামর্শ দিচ্ছেন, ধৈর্য ধরো, মিষ্টি কথাতেই যখন কাজ হচ্ছে, আর উগ্র প্রচার কেন? তাঁদের প্রধান লক্ষ্য সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছ থেকে ‘অধীনতামূলক সখ্যতা’র প্রতিশ্রুতি আদায়। এই লক্ষ্যেই তাঁর উদারতা প্রদর্শন। তিনি এখন দেশের অভিভাবক সেজে নরেন্দ্র মোদিদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টায় ব্যাপৃত। কারণ যে কর্পোরেট পুঁজি মালিকরা আরএসএস এবং বিজেপি উভয়কেই টাকার থলি সহ সমর্থন দিয়ে থাকে এটা তাদের অর্পিত কাজ। এদের অনুগত সেবক হিসাবে ভাগবতজির তা অমান্যের উপায় নেই।