প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী থেকে বিজেপির আইটি সেল সবাই একযোগে ভারতীয় অর্থনীতির আয়তনে বিশ্বে পঞ্চম স্থান অধিকারের আখ্যানই ফলাও করে প্রচার করে চলেছে। কালো টাকা উদ্ধার করে, সকলের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়া প্রভৃতি পূর্ববর্তী ‘জুমলা’গুলির মতোই বর্তমানে জি ২০-র সভাপতিত্বকে সামনে রেখে ‘বিশ্বগুরু’ হয়ে ওঠা বা প্রধানমন্ত্রীর দয়াতেই যে দেশের মানুষ খেতে পারছে তার প্রমাণ স্বরূপ ৩০০ কোটি টাকা খরচ করে প্রধানমন্ত্রীর মুখচ্ছবি সংবলিত ২০ কোটি ব্যাগ বিতরণ বা রেশন দোকানের সামনে প্রধানমন্ত্রীর বড় কাটআউট লাগানো প্রভৃতি পদক্ষেপও চলছে জোরকদমে। তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ সাল থেকে ২০২৪-এর জানুয়ারি পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞাপনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ৩০০০ কোটি টাকারও বেশি খরচ করেছে। প্রচারের ঢক্কানিনাদ যত তীব্রই হোক দেশের বাস্তব চিত্র কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। আসলে অর্থব্যবস্থার তত্ত্বগুলি সাধারণ মানুষের বোধগম্য না হওয়ার সুযোগেই তথ্যের মারপ্যাঁচ ঘটিয়ে একটা মেকি বাস্তবতাকে খাড়া করার প্রচেষ্টা অনায়াসে চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। মোদিজি যতই বিশ্বগুরু হতে চান না কেন, জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত কুড়িটি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন মাথাপিছু গড় আয় ভারতেরই। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪৩তম। আর্থিক বৃদ্ধির হার নিয়ে নেতারা হুঙ্কার দিচ্ছেন অথচ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় কণামাত্র। মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব আকাশছোঁয়া। ২০২১-২২ সালে দেশের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০২৩ সালে হয়েছে ৩০ শতাংশ। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার কনজিউমার এক্সপেন্ডিচার বা ভোগব্যয় গ্রামাঞ্চলে নিম্নমুখী এবং নরেন্দ্র মোদির সময়কালেই দেশের আর্থিক বৃদ্ধি সর্বনিম্ন– এই তথ্যগুলি কিন্তু সিংহভাগ জনগণের অজানা। ফলে প্রধানমন্ত্রী যখন প্রতিদিন দেশের সার্বিক উন্নয়নের কথা বলছেন বা ‘গরিবি দূরীকরণের’স্লোগান দিয়ে বলছেন ‘উন্নয়নই’ তাঁর অগ্রাধিকার, তখন উন্নয়নের প্রকৃত সুফল কারা পাচ্ছে? অন্তত সাধারণ মানুষ সামান্যতমও পাচ্ছেন না, এটা দিবালোকের মতো সত্য।
ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম। মনে রাখা দরকার যে এই ফোরাম কিন্তু মূলত পুঁজিবাদী বাজারপন্থী ও খোলা ধনতন্ত্রে বিশ্বাসী। অথচ এই ফোরামই অসমান বৃদ্ধি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে। দেখা যাচ্ছে আয়ের নিরিখে যারা উপরের দিকে রয়েছে সেই কম সংখ্যক মানুষেরই আয় বেড়েছে, নিচের দিকে থাকা মানুষের বেশিরভাগেরই কোনও আয় বাড়েনি বরং কমেছে। এই দ্বিতীয়প্রবণতাটি বর্তমানে দেশেরপ্রধান ধারা। ফলে যখন কেন্দ্রীয় সরকার একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে দাবি করছে যে পূর্ববর্তী ১০ বছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে দেশের পরিবারগুলির মাসিক খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে বা দাবি করছে যে দেশের দারিদ্রের হার কমে ৫ শতাংশে নেমেছে, তখন আর্থিকভাবে এগিয়ে থাকা মানুষের তুলনায় আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের আর্থিক পার্থক্য সমাজেপ্রকটতর হচ্ছে। তা ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের প্রকাশিত রিপোর্টে প্রমাণিত। আবার সরকারের রিপোর্টে কতগুলো অসঙ্গতি সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। প্রথমত, যে নীতি আয়োগ সম্প্রতি বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকের রিপোর্টে বলেছিল ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে দেশের দরিদ্র মানুষের হার ১১.২৮ শতাংশ, সেই নীতি আয়োগের সিইও বি ভি আর সুব্রহ্মনিয়ম কিছুদিনের মধ্যেই দারিদ্রের হার কমে ৫ শতাংশ নেমেছে বলে যে রিপোর্ট প্রকাশ করলেন তার পিছনে কোন জাদুমন্ত্র কাজ করছে তা দেশের মানুষের অজানা। দ্বিতীয়ত, যে সমীক্ষার রিপোর্ট প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রকাশিত হওয়ার কথা তা ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ করেনি। পরবর্তী সময়ে যখন এই রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যায় তখন স্পষ্ট হয় যে, নোটবন্দি ও জিএসটি চালুর ফলে ওই সময় মানুষের খরচের ক্ষমতা চার দশকের মধ্যে ছিল সর্বনিম্ন। মূল্যবৃদ্ধি যে ঊর্ধ্বমুখী এবং গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত ভোগব্যয় যে নিম্নমুখী সেটাও উক্ত রিপোর্টে সামনে আসে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের অধীনে থাকা ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিসের পরিসংখ্যান থেকে উঠে এসেছে, আর্থিকভাবে এগিয়ে থাকা মানুষের ভোগব্যয় কিছুটা বাড়লেও পিছিয়ে থাকা মানুষের ক্ষেত্রে তা ক্রমাগত কমেছে। ওই রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে, যখন আর্থিকভাবে নিচের দিকে থাকা ৫ শতাংশ গ্রামীণ মানুষের মাসিক খরচ ১৩৭০ টাকা এবং শহরের ক্ষেত্রে ২০০১ টাকা মাত্র, তখন উপরের দিকে থাকা ৫ শতাংশ গ্রামীণ মানুষের মাসিক ব্যয় ১০,৫০১ টাকা এবং শহরের ক্ষেত্রে ২০,৮২৪ টাকা। অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের আশঙ্কাই সত্য। সরকার যতই তথ্যের মারপ্যাঁচ করুক না কেন এই সত্য দেশের অর্থনীতিতে ক্রিয়াশীল। দেশের জিডিপি বাড়ছে বলে যখন এত লাফালাফি হচ্ছে তখনও নিচের দিকে থাকা মানুষগুলির কোনও আর্থিক উন্নতি ঘটেনি।
তাই প্রধানমন্ত্রী যখন জনগণের সামনে উন্নয়নের স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াচ্ছেন বা দেশের ২৫ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার উপরে উঠে এসেছে বলে দাবি করছেন তখন দেশের প্রকৃত আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে।
কোনও শিল্প-কলকারখানা গড়ে তোলা বা ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার ব্যাপারে পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের মতোই বর্তমান বিজেপি সরকারও সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। পরিবর্তে দেশের অসমান আর্থিক বৃদ্ধির সুফল মালিক শ্রেণির কাছে যাচ্ছে, তাদের কর বা ঋণ সমস্তই মকুব করে দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি ও করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের উপর।
দেশের এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অসাম্যের মূলে রয়েছে বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে উৎপাদনের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে। এই ব্যবস্থাই দেশের এক শতাংশ পুঁজিপতি শ্রেণিকে সমস্ত সম্পদের মালিক করে তুলেছে। সে কারণেই করোনা অতিমারিতে সমগ্র দেশ যখন বিপন্ন, মানুষ আশ্রয়-চিকিৎসা ও খাদ্যের জন্য হাহাকার করছে তখন দেশের ৩০০ জন শিল্পপতি নতুন করে বিলিয়নেয়ার হয়ে গেছে। শ্রমিককে তার শ্রমের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন বেড়েছে মালিকের মুনাফা, অন্য দিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই অবস্থায় বাজারে কার্যকরী চাহিদা না থাকায় উৎপাদনে লগ্নি হওয়ার পরিবর্তে পুঁজির লগ্নি হচ্ছে শেয়ার বাজার বা রিয়েল এস্টেটের মতো ক্ষেত্রগুলিতে। আর এই শেয়ার বাজার চাঙ্গা হওয়াকে যে আর্থিক বৃদ্ধি বলে দেখানো হচ্ছে তার সাথে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বা ভোগব্যয় বৃদ্ধি হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। যাকে বৃদ্ধি বলে দেখানো হচ্ছে তাও অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই বৃদ্ধিটা বুদবুদের মতো মাঝে মাঝে ফুলে উঠলেও পরক্ষণেই তা ফেটে যায়– শুরু হয় মন্দা।
ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি না হলে, খয়রাতি নয়– স্থায়ী কাজ পাওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের বেকার সমস্যার সমাধান না ঘটাতে পারলে, সর্বোপরি বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করতে না পারলে এই অসাম্যকে দূর করা মালিক শ্রেণির পদলেহনকারী কোনও নেতা, কোনও অর্থনীতিবিদ বা কোনও সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও তা জানেন। যে একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের তিনি সেবাদাস তাদের স্বার্থেই তাঁকে চলতে হয়, কাজ করতে হয়। সেজন্য মিথ্যার আশ্রয় ছাড়া তাঁর আর পথ কী!