অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন কেউ কেউ। আত্মবিস্মৃত হয়ে জীবনে চরম সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সম্পূর্ণ সচেতন ভাবে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মবলিদান– এর উদাহরণ বেশি নেই। নিজেকে জ্বলন্ত প্রতিবাদের শিখায় পরিণত করে আত্মাহুতি দিলেন অ্যারন বুশনেল। অত্যাচারিত মানুষের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তাদের বাঁচার লড়াইকে সমর্থন জানিয়ে এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজ রক্তলোলুপ আমেরিকা ও ইজরায়েলের কুকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সম্প্রতি গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলেন মার্কিন বায়ুসেনার এই কর্মী।
আমেরিকায় ইজরায়েলি দূতাবাসের সামনে অ্যারন বুশনেলের দেহ যখন দাউদাউ করে জ্বলছে, যন্ত্রণায় দেহ কুঁকড়ে যাচ্ছে, তখনও তাঁর মুখে ফ্রি প্যালেস্টাইনের স্লোগান। দূতাবাসের কর্মীরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা যায়নি তাঁকে। এ দৃশ্য বিশ্বের প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, অ্যারন বুশনেল মাত্র ২৫ বছর বয়সে আত্মহত্যার মতো কষ্টকর পথ বেছে নিতে বাধ্য হলেন কেন? কারা তাঁকে বাধ্য করল এ পথে যেতে?
অ্যারন অন্য পাঁচটা যুবকের মতো চাকরি করতে গিয়েছিলেন। সেনার চাকরিতে আপাত গ্ল্যামার আছে। কিন্তু তাতে যে নিজের পরিজন-প্রতিবেশীদের মতো অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে হবে, তা বোধহয় স্বপ্নেও কল্পনা করেননি। মেনে নিতে পারেননি সাম্রাজ্যবাদীদের শাসকদের নির্বিচার হত্যালীলাকে। আত্মহত্যা করেই তার প্রতিবাদ কর়েছেন।
আমেরিকার ইন্ধনে ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইজরায়েলের গাজা ভূখণ্ডে নির্বিচার বোমাবর্ষণ, নিরস্ত্র মানুষের উপর আকাশপথে, জলপথে, স্থলপথে কামান-ট্যাঙ্ক নিয়ে লাগাতার হামলায় ইতিমধ্যেই ৩০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন, যার বড় অংশ শিশু ও নারী। আহত অসংখ্য। হাসপাতালগুলিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ত্রাণ শিবিরের লাইনে পর্যন্ত হামলা চালিয়ে যুদ্ধে সর্বস্বান্ত মানুষকে হত্যা করেছে ইজরায়েল। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে চোখের সামনে এই নৃশংস ঘটনা বহু সেনাকর্মীর বিবেকে আঘাত করেছে। তাদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, সাম্রাজ্যবাদীদের বাজার দখলের খেলায় বোড়ে হিসাবে ব্যবহার করা হবে কেন তাদের? কেন নিরীহ নারী-শিশু হত্যায় তাদের হাত রক্তাক্ত হবে? ঘরে ফিরে ওই হাতে তাঁরা তাঁদের সন্তানকে আদর কর়বেন কী করে, পরিজনদের কাছেই বা কী জবাবদিহি করবেন?
সহ্যের সীমা পেরনোয় গত ডিসেম্বরে আটলান্টায় ইজরায়েলি দূতাবাসের সামনে গায়ে আগুন দেন একজন। তাঁর কাছ থেকে একটি প্যালেস্টাইনি পতাকা পাওয়া যায়। ফলে গাজায় ইজরায়েলি হানাদারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদেই যে তিনি গায়ে আগুন দিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট। তারপরই সেনাকর্মী অ্যারনের আত্মহত্যা। অসংখ্য মার্কিন সেনা এবং ইজরায়েলি সেনার বুকের ভিতর জমে থাকা যন্ত্রণার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন অ্যারন।
শিশুঘাতী-নারীঘাতী সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের উদ্দেশে অ্যারন ধিক্কার জানিয়েছেন যন্ত্রণাময় মৃত্যু বরণ করে। সাথে সাথে বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী, শান্তিকামী মানুষের শোক, যন্ত্রণা ও রুদ্ধ বিবেকের দরজা যেন খুলে দিয়েছেন তিনি। আমেরিকার হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন অ্যারনের সমর্থনে রাস্তায় নামছেন। এমনকি নিজেদের ইউনিফর্ম পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন প্রাক্তন মার্কিন সেনারা। তাঁরাও ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’, ‘রিমেম্বার অ্যারন বুশনেল’ স্লোগান তুলছেন। গাজায় ইজরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটছিল মার্কিন জনতার মধ্যে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন তাঁদের করের টাকা ইজরায়েলের পিছনে ঢালা হবে নিরপরাধ প্যালেস্টিনীয়দের হত্যা করার জন্য? অ্যারনের আত্মহত্যা সেই ক্ষোভের বারুদে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কায় রয়়েছে মার্কিন শাসকরা।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ বলে বড়াই করে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। তার অস্ত্রব্যবসা চাঙ্গা রাখতে অস্ত্র সরবরাহ করে, সৈনিক পাঠিয়ে দেশে দেশে যুদ্ধ বাধাতে এবং জিইয়ে রাখতে যা খুশি তাই করে চলেছে আমেরিকা। খোদ ইজরায়েল সরকারই বলছে, সাম্রাজ্যবাদীদের হানায় ইতিমধ্যেই ৮০ শতাংশ গাজাবাসী দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তার পরেও গাজাবাসীর ‘প্রতিরোধের’ কথা বলে তারা দেশটাকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রসংঘ কাগুজে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া কার্যত কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। অনাহারে, অর্ধাহারে, বিনা চিকিৎসায়, জলের অভাবে মারা গিয়েছেন বহু জন। চোখের সামনে দিনের পর দিন এই দৃশ্য ‘মানুষ’ হয়ে দেখা সম্ভব হয়নি– তাই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের জ্বলন্ত বিবেক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন অ্যারন। অ্যারনের মৃত্যু জাগিয়ে তুলেছে বিশ্ব জুড়ে বহু মানুষের বিবেককে।