পুঁজিপতিদের অবাধ লুঠের সুযোগ দিয়ে জনগণের জন্য সামান্য খয়রাতি

রাজ্যের তৃণমূল সরকার ৮ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ভাতা বৃদ্ধি করে বা কেন ১০০ দিনের কাজের পাল্টা ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্পে ৫০ দিনের কাজের ঘোষণা করে যে বাজেট পেশ করেছে তার লক্ষ্য যে রাজ্যের জনগণের জীবন-মানের উন্নয়ন নয়, আসন্ন লোকসভা নির্বাচন, তা ছত্রে ছত্রে স্পষ্ট করে দিয়েছেন অর্থপ্রতিমন্ত্রী। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে পাশ করে বেরোচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে। সেই যুবসমাজ কোথায় কাজ বা চাকরির সুযোগ পাবে তার কোনও সুনির্দিষ্ট দিশা বাজেটে নেই। ৬টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও ইকনমিক করিডোরের ঘোষণা করে সেগুলিতে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের আশা দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোন শিল্প-প্রতিষ্ঠানে তাদের চাকরি হবে তার কোনও নিশানা নেই। মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া। তা আটকানোর কোনও উদ্যোগ নেই। এই ব্যর্থতা ঢাকতেই এবং মানুষের ক্ষোভ কমিয়ে ভোট কুড়োতেই ভিক্ষের খয়রাতি।

রাজ্যে ৮২০৭টি স্কুল বন্ধ করার জন্য সরকার আগেই তালিকাভুক্ত করেছিল। বাকি স্কুলগুলিতেও হাজার হাজার শিক্ষকপদ শূন্য। পরিকাঠামোর ভগ্নদশা। সেগুলি পূরণের ব্যবস্থার কোনও উল্লেখ বাজেটে নেই। উপরন্তু রাজ্যে বেসরকারি স্কুল খোলার ঢালাও অনুমতি দিতে পোর্টালের ব্যবস্থা করেছে সরকার। এ বার বেসরকরি সংস্থাগুলি সহজেই স্কুল খুলতে পারবে বলে বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি স্কুলগুলিকে রক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়ার পরিবর্তে বেসরকারিকরণের ঢালাও ব্যবস্থা করছে সরকার। ইতিমধ্যেই বৃহৎ পুঁজি রাজ্যে রমরম করে শিক্ষা-ব্যবসা চালাচ্ছে। সেই ব্যবসাকেই আরও গতি দেবে বাজেটের এই ঘোষণা।

বাজেটে বলা হয়েছে, এখন থেকে মাধ্যমিক পাশ করে একাদশে ভর্তি হলেই ছাত্রছাত্রীরা স্মার্ট ফোন বা ট্যাব পাবে। প্রয়োজন ছিল ছাত্রছাত্রীদের আরও বেশি করে ক্লাসমুখী করা, স্কুলগুলিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যায় শিক্ষক নিয়োগ করে নিয়মিত ক্লাসের ব্যবস্থা করা। তার পরিবর্তে ছাত্রছাত্রীদের আরও বেশি করে মোবাইলমুখী করে তোলার ব্যবস্থা হল। পরিবারে একাধিক সন্তান থাকলে তার জন্য বাড়তি স্থায়ী ব্যয়ের ব্যবস্থা করা হল। এতে পড়াশোনার পরিবর্তে মোবাইল আসক্তি আরও বেড়ে গিয়ে বেশিরভাগ সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নানা সমস্যাই বাড়বে।

মিড-ডে মিলের রাঁধুনি-সাহায্যকারীদের ভাতা ৫০০ টাকা বাড়িয়ে ২০০০ টাকা করা হয়েছে। সে-টুকুও দেওয়া হবে ১০ মাসের জন্য। যদিও তার দ্বারাও তাঁরা ন্যূনতম মজুরির ধারেকাছেও পৌঁছতে পারবেন না। অন্য দিকে ছাত্রছাত্রীদের মিড-ডে মিলের জন্য বরাদ্দ কিছুই বাড়ানো হয়নি।

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইগ্রান্ট ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার স্কিম ২০২৩’ চালু হয়েছে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক যাঁরা ঘরবাড়ি ছেড়ে রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাতে তাঁদের কী সুবিধা হবে তা পরিষ্কার নয়।

ডিএ-র দাবিতে সরকারি কর্মচারী-শিক্ষকরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন। বাজেটে ৪ শতাংশ নতুন ডিএ-র ঘোষণা হলেও কেন্দ্রীয় হারের তুলনায় তা এখনও ৩২ শতাংশ কম। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি নগণ্য। আশা-অঙ্গনওয়াড়ি-পৌরস্বাস্থ্যকর্মীদের উপর ক্রমাগত কাজের বোঝা বাড়ানো হচ্ছে, অথচ তাঁদের জন্য কোনও বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। বন্যা খরা প্রতিরোধে স্থায়ী কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সরকার খয়রাতি খাতে যে টাকা বরাদ্দ করেছে, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে– এই পরিমাণ টাকা আসবে কোথা থেকে? অর্থাৎ সরকারের আয়ের উৎস কী? পুঁজিবাদী অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের কারণে অন্যান্য রাজ্যের মতো এ রাজ্যেও নতুন কলকারখানা হচ্ছে না। ফলে উৎপাদন শিল্প থেকে সংগৃহীত যে করই সরকারের আয়ের মূল উৎস হওয়ার কথা, এ রাজ্যে তার পরিমাণ নগণ্য। ফলে ঋণ-ই সরকারের আয়ের প্রায় একমাত্র উৎস। বাজেটের তথ্য অনুযায়ী ৬২ হাজার কোটি টাকা নতুন বোঝা চেপে ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৬.৯৩ লক্ষ কোটি টাকায়। নতুন আর্থিক বছরে শুধু বাজার থেকেই ৭৯,৭২৭ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা ভেবেছে সরকার। অন্য রাজ্যগুলির মতো এ রাজ্যেও ঋণ করে ঘি খাওয়ার পথেই হাঁটছে সরকার। এটা রাজ্যের অর্থনীতির গভীর সঙ্কটেরই প্রকাশ।

ঋণ ছাড়া সরকারের হাতে আয়ের উৎস আর যা আছে তা হল মদ বিক্রি। তৃণমূল সরকার আগামী এক বছরে রাজ্যে মদ বিক্রি করে তুলবে ২১ হাজার ৮৪৬ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা। বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছে। গত বছরের থেকে এ বার মদ বিক্রি করে ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। একদিকে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটিকে ধ্বংস করা হচ্ছে, যুব সমাজের কাজের কোনও ব্যবস্থা নেই, অন্য দিকে ছাত্র-যুব সমাজকে মদের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা চলছে। স্বাভাবিক ভাবেই যুবসমাজের একাংশের মধ্যে মদে আসক্ত হওয়ার এবং অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ার ঝোঁক বাড়ছে। তার জন্য দায়ী সম্পূর্ণরূপে রাজ্য সরকারের এই নীতি।

বাজেটে মূল্যবৃদ্ধি রোধে কোনও ব্যবস্থাই নেই। শাক-সিr সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাফিয়ে বাড়ছে। কালোবাজারি দাপটে চলছে। বাজেটে এ সবের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করা হয়নি। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে ৫০০ টাকা বাড়ানো হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা-চিকিৎসার ব্যয়বৃদ্ধিতে তার বহুগুণ গৃহস্থকে খরচ করতে হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে গৃহস্থের আর্থিক সঙ্কট মিটবে না। কিন্তু আরও ৫০০ টাকা এই ভাণ্ডারে দিয়ে মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করার চেষ্টা হয়েছে।

রাজ্য বাজেট নিয়ে জনগণ যতই অখুশি হোক, খুশি শিল্পমহল। কারণ তাদের জন্য যা যা ঘোষণা করা হয়েছে তাতে খুশি হওয়ারই কথা। এত দিন প্রোমোটার কিংবা শিল্পের নামে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি নিয়ে বৃহৎ পুঁজিপতিরা অন্য কাজে লাগানো বা ফেলে রাখার ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা আরবান ল্যান্ড সিলিং (শহরে জমির ঊর্ধ্বসীমা) আইনের কারণে ছিল, এ বার সেই আইনটি পুনর্বিবেচনা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বাজেটে। গত শতকে দীর্ঘ কৃষক আন্দোলন ও গণআন্দোলনের ফল হিসাবে যে পশ্চিমবঙ্গ ভূমি সংস্কার আইন তৈরি করেছিল যুক্তফ্রন্ট সরকার, সেই আইনের ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত ধারাগুলি তুলে দেওয়ার ভাবনার কথা বলা হয়েছে বাজেটে। এত দিন পর্যন্ত সরকার বেসরকারি কোনও ক্ষেত্রকে জমি দিলে তা নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য লিজ হিসাবে দেওয়া হত। এ বার লিজে থাকা সব জমিকে মালিকানা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন থেকে সরকারের সব বিভাগ, সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা, পুর-সংস্থা ও পঞ্চায়েত সংস্থাগুলিও এই নীতিই অনুসরণ করবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

স্বাভাবিক ভাবেই খুশি আবাসন শিল্পের মালিকরা। তারা একে সরকারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বলে অভিনন্দিত করেছে। কারণ এ বার বিপুল পুঁজি নিয়ে জমি দখলে নামবে ধনকুবের আবাসন ব্যবসায়ীরা। শহরের দরিদ্র, নিম্নবিত্তরা এই জমি মাফিয়াদের আক্রমণের মুখে পড়বে। বস্তিগুলিও উচ্ছেদের মুখে পড়বে।

সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ২৯২০ মেগাওয়াটের চারটি সুপার ক্রিটিকাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ জনগণের টাকায় বৃহৎ পুঁজির জন্য মুনাফার ব্যবস্থা। যুব উদ্যোগপতিদের সহজে, কম সুদে, বন্ধকহীন ঋণের নামে ৪ শতাংশের অতিরিক্ত সুদ সরকার নিজেই মিটিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। নানা অছিলায় এর সুযোগ নেবে শিল্পমহলই। লোকসভা নির্বাচনে আঞ্চলিক পুঁজিপতিদের সমর্থন আদায় করতে ভোটের আগেই তাদের সামনে এমন সব লোভনীয় ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

এই বাজেটের তীব্র সমালোচনা করে এস ইউ সি আই (সি) রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য বলেছেন, কেন্দ্রীয় বাজেটের মতো রাজ্য বাজেটও নিতান্তই ভোটমুখী।