কেন্দ্রীয় বাজেটঃ না আছে সততা, না ন্যায়বিচার

ছবিঃ দি হিন্দুর সৌজন্যে

২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশে রামরাজ্যের সূচনা হয়েছে। ফলে ১ ফেব্রুয়ারি সংসদে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করলেন, আসন্ন লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে তা যতই অন্তর্বর্তী বাজেট হোক, মানুষ আশা করেছিল, নিশ্চয়ই তাতে রামরাজ্যের খানিকটা আভাস পাওয়া যাবে। তারা আশা করেছিল, অর্থমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সত্য ছবি তুলে ধরবেন এবং বাজেটে ‘রামরাজ্যের’ প্রজাসাধারণের, অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, গরিবিতে বিপর্যস্ত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দুরবস্থা দূর করার লক্ষে্য প্রয়োজনীয় ঘোষণা করবেন। কিন্তু তাঁর বাজেট ভাষণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনায় না মিলল সততার নিদর্শন, না পাওয়া গেল জনসাধারণের প্রতি ন্যায়বিচারের কোনও পরিচয়। আসন্ন লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে অর্থমন্ত্রীকে কেবল কিছু অলীক স্বপ্নের বুদবুদ ওড়াতে দেখা গেল।

অর্থমন্ত্রী বাজেট ভাষণে জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ অর্থাৎ জিডিপি ৭ ট্রিলিয়ন ডলারে অর্থাৎ ৭ লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। স্বপ্নের পোলাওয়ে ঘি ঢালতে কার্পণ্য করেননি তিনি। এতদিন প্রধানমন্ত্রী ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের খোয়াব দেখাতেন, অর্থমন্ত্রী এবার একলাফে সেই সীমা পার হয়ে গেলেন। কিন্তু কী ভাবে, কোন হিসাবের ভিত্তিতে তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী, তা কিন্তু তিনি ভুলেও খোলসা করেননি। হিসাব বলছে, ২০৩০-এ ৭ লক্ষ কোটি ডলারের জিডিপিতে পৌঁছতে গেলে অর্থনীতির প্রকৃত বৃদ্ধির হার হওয়া প্রয়োজন ৯.৫৫ শতাংশ। অথচ বাস্তবে গত ১০ বছর ধরে অর্থনীতির প্রকৃত বৃদ্ধির গড় হার মাত্র ৬ শতাংশের কাছাকাছি।

দেশের মানুষের আর্থিক বৃদ্ধির গড় হার বাড়াতে হলে প্রয়োজন জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো। দেশে কায়েম থাকা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার নিজস্ব নিয়মেই আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের কেনার ক্ষমতা ক্রমাগত কমছে। বেকারত্বের হার সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। প্রয়োজন ছিল এই অবস্থার মধ্যেও যতটা পারা যায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের হাতে পণ্য ও পরিষেবা কেনার মতো টাকাপয়সার জোগান দেওয়া। প্রয়োজন ছিল ধনকুবের, পুঁজি মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারি নীতির পরিবর্তে কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের স্বার্থে সমস্ত নীতিকে ঢেলে সাজানো। কিন্তু এবারের বাজেটে চূড়ান্ত প্রয়োজনীয় এই বিষয়গুলিতে সামান্য গুরুত্বও দিল না কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।

বাজেট ভাষণের শুরুতে অর্থমন্ত্রী বড় গলা করে বলেছেন, ‘‘দেশের মানুষ বর্তমান নিয়ে গর্বিত। তারা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী।” বাজেটের দিনকয়েক আগে প্রধানমন্ত্রীও তাঁর ভাষণে বলেছেন, গরিব, যুব, অন্নদাতা অর্থাৎ কৃষক ও নারী– এই চার গোষ্ঠীর উপর নজর দিলেই নাকি উন্নত দেশ হয়ে ওঠা আদৌ কঠিন নয়। দেখা যাক কেমন ‘বর্তমানে’ দিন কাটাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী উল্লেখিত দেশের এই চার গোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা ভোগব্যয় নিয়ে সর্বশেষ সমীক্ষা করেছিল ২০১৭ সালে। সেই রিপোর্ট এতটাই উজ্জ্বল যে সরকার তা প্রকাশ করেনি। যদিও সেই রিপোর্ট ফাঁস হয়ে যায় এবং জানা যায় ভারতের গ্রামগুলিতে প্রকৃত ভোগব্যয় ক্রমাগত কমছে। অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য, জামাকাপড় সহ ভোগ্যপণ্য কেনার ক্ষমতা কমতে থাকায় সেই খাতে খরচ তথা কার্যকরী চাহিদা কমছে। অতি সম্প্রতি গত ৩১ জানুয়ারি প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যানও দেখাচ্ছে, দেশে চাহিদা বৃদ্ধির গড় হার ৫ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ মোদি সরকারের শাসনে একদিকে আয়ের অভাব, অন্যদিকে জিনিসপত্রের চড়া দাম– সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের দিন চালানো দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে। অপুষ্টি, ক্ষুধা মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। ভারত সরকারের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে ২০২৩-এর এপ্রিল মাসে একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা দেখিয়েছে, দেশে দু’বছরের কম বয়সী শিশুদের ২০ শতাংশ, সংখ্যায় যা প্রায় ৬০ লক্ষ, দিনভর না খেয়ে থাকে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের জায়গা হয়েছে ১১১ নম্বরে। শতাংশের হিসাবে বিশ্বের মধ্যে অপুষ্টি-অনাহারের কারণে ঠিকমতো বাড়তে না পারা সবচেয়ে বেশি শিশু রয়েছে ভারতে। গর্ব করার মতো বিষয়ই বটে! অর্থমন্ত্রী কথিত উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী নিশ্চয় ভারতের কৃষকরাও। দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ফসলের নূ্যনতম সহায়ক মূল্যের যে প্রতিশ্রুতি মোদি সরকারের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন কৃষকরা, চরম নির্লজ্জের মতো আজও তা চালু করেনি সরকার। আয় কমেছে গোটা কৃষিক্ষেত্রেই। কেন্দ্রে মোদি সরকার আসীন হওয়ার বছর ২০১৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে মূলত বিপুল ঋণের ফাঁসে জড়িয়ে কৃষিতে নিযুক্ত ১ লক্ষেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমান যেমনই হোক, অর্থমন্ত্রী যখন বলেছেন, তখন এই কৃষকরা নিশ্চয় তাঁদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী! মহিলারাও হয়ত খুশি তাঁদের বর্তমান জীবন নিয়ে। কারণ দেশে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা। কাজের বাজারে মেয়েদের যোগদান কমছে। মহিলাদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে মজুরিবিহীন কাজে। অপুষ্টিতে ভুগছেন দেশের প্রায় অর্ধেক মহিলা। আনন্দিত হওয়ারই তো কথা! যাঁদের নিয়ে অহরহ প্রধানমন্ত্রীর গৌরববাণী বর্ষিত হয়, কী অবস্থা সেই যুবশক্তির? সরকারি তথ্যই বলছে, দেশে ১৫-২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ, আর ২৫ বছরের কমবয়সি স্নাতকদের মধ্যে ৪৩ শতাংশই কর্মহীন। পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের আরেকটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশে স্নাতক বা তার চেয়েও বেশি শিক্ষিত কর্মপ্রার্থী তরুণদের প্রতি ৪ জনে একজন কর্মহীন। অর্থমন্ত্রী সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে নিশ্চয় এঁদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথাই বলেছিলেন!

মুখে তিনি যাই বলুন, অর্থনীতির এই বেহাল দশা নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রীর অজানা নয়। এই অবস্থায় রামরাজ্য তৈরি করা না হোক দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি নূ্যনতম দায়বদ্ধতা থাকলে একটা সরকারের তো উচিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি এবং সমাজকল্যাণমূলক খাতগুলিতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা! কিন্তু দেখা গেল, গত পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতায় ২০২৪-২৫ সালেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হয়েছে মোট খরচের মাত্র ১.৮ শতাংশ। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়েছে মোট খরচের মাত্র ২.৫ শতাংশ। বাজেট নথিতে দেখা গেল, গত অর্থবর্ষে কৃষিক্ষেত্রে যা বরাদ্দ হয়েছিল, তার তুলনায় ৪ হাজার কোটি টাকা কম খরচ করা হয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ টাকার মধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করা হয়নি। একই পরিস্থিতি সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসী উন্নয়ন খাতগুলির। ফলে স্পষ্ট যে কেন্দ্রের মোদি সরকার দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশের অগ্রগতির জন্য কতখানি আন্তরিক। বিপিএল তালিকাভুক্ত বয়স্ক মানুষ, মহিলা ও বিকলাঙ্গ মানুষকে সরাসরি আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রকল্প জাতীয় সামাজিক সহযোগিতা কর্মসূচির বরাদ্দও এবার নামমাত্র করা হয়েছে। এর পরিমাণ মোট বাজেট বরাদ্দের মাত্র ০.২ শতাংশ। বাস্তবে ২০১৪ সালে সরকারে বসার পর থেকেই জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলির দায়িত্ব ধীরে ধীরে ঝেড়ে ফেলছে মোদি সরকার। এবারের বাজেট নথি দেখাল, গত অর্থবর্ষে মহিলা, শিশু সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দের তুলনায় কম টাকা খরচ করা হয়েছে। খাদ্যে ভরতুকি ছাঁটাই করা হয়েছে। গত বছরের বরাদ্দ ২.১ লক্ষ কোটি টাকা থেকে কমে তা এবার হয়েছে ২ লক্ষ কোটি টাকা। মহিলাদের জন্য বরাদ্দ অর্থ ৪ শতাংশ থেকে কমে ০.০৬ শতাংশে নেমেছে। নারী নির্যাতন ব্যাপক পরিমাণে বাড়লেও নির্ভয়া ও মিশন শক্তির পুরো বরাদ্দ খরচ করা হয়নি এবং এবারের বাজেটে বরাদ্দ এক পয়সা বাড়ানোও হয়নি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কর্মসংস্থানের যখন এই হাঁড়ির হাল, তখন এনরেগা প্রকল্পে এবারের বাজেটে চলতি অর্থবর্ষের তুলনায় এক টাকাও বাড়ানো হল না। অথচ সকলেই জানেন, এই এনরেগা প্রকল্প তথা একশো দিনের কাজ লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ মানুষের রুটি-রুজির অন্যতম সংস্থান হিসাবে কাজ করে। আকাশছোঁয়া বেকারত্বে জনজীবন যখন জেরবার, তখনও বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনও রকম দিশা পাওয়া গেল না। কৃষিক্ষেত্রেরও একই হাল। সেখানকার বিভিন্ন বিভাগে যে বরাদ্দ করা হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই কম। সারে ভরতুকির পরিমাণ গত অর্থবর্ষে বরাদ্দ ১.৯ লক্ষ কোটি থেকে কমিয়ে এবার করা হয়েছে ১.৬ লক্ষ কোটি। কৃষি উৎপাদনের উন্নতির নাম করে যে পদক্ষেপগুলি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে সেগুলি থেকে একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের মুনাফা লোটারই বন্দোবস্ত করে দিয়েছে মোদি সরকার। অ’ফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে মানুষে মানুষে বিপুল বৈষম্যের ছবি দেখিয়ে দিয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২-২০২১-এর মধ্যে দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশ জমা হয়েছে ধনীতম ১ শতাংশের হাতে, আর দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ। এই প্রবল বৈষম্য দূর করারও কোনও চেষ্টাও বাজেটে পাওয়া গেল না। বরং দেখা গেল, একচেটিয়া ব্যবসায়ী সংস্থাগুলি ও ধনকুবেরদের থেকে যে প্রত্যক্ষ কর আদায় করে সরকার, তা কমেছে। জনসাধারণের ব্যবহার্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের উপর থেকে আদায় করা পরোক্ষ করের পরিমাণ ক্রমাগত তার চেয়ে বেড়ে চলেছে। জনগণের জন্য সামান্য সুরাহার বন্দোবস্ত করতে পরোক্ষ কর কমানোর কোনও ঘোষণা অর্থমন্ত্রী করলেন না।

বাস্তবে এই অন্তর্বর্তী বাজেট দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের চূড়ান্ত উদাসীন ও নির্মম দৃষ্টিভঙ্গিটিকে পরিষ্কার দেখিয়ে দিয়ে গেল। দেখিয়ে দিয়ে গেল, করের ভার, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি আর গরিবিতে বিধ্বস্ত এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য সামান্যতম দরদ এই সরকারের নেই। তাদের যাবতীয় দায়বদ্ধতা শুধু একচেটিয়া মালিকদের প্রতি। তাই গোটা বাজেটে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিষ্পিষ্ট, নাজেহাল সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারের একটি পদক্ষেপেরও দেখা পাওয়া গেল না। অথচ বাজেট পেশের পর সাংবাদিক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে জানিয়েছেন, গত ১০ বছরে দেশের মানুষের গড় আয় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। যেন তাঁর জানা নেই যে, এই গড় আয় বৃদ্ধির আসল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে দেশের ধনকুবেরদের, একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের আয় বিপুল বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যেই! দেশের মানুষের সঙ্গে এই যে তাঁদের মিথ্যাচার, তা থেকেই প্রমাণ হয়, বিজেপি সরকারের ‘রামরাজ্যে’র প্রতিশ্রুতির গোটাটাই আসলে ভোটের ভাঁওতা। এই ‘রামরাজ্যে’র হর্তাকর্তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার তো দূরস্থান, সামান্য সততার নজিরও মেলা দুষ্কর।