দিল্লির সিংঘু এবং টিকরি সীমান্তে সংযুক্ত কিসান মোর্চার ডাকে দীর্ঘ ১৩ মাস ধরে চলা কৃষক আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী ৭৩৬ জন কৃষকের স্মৃতিতে শহিদ বেদি স্থাপনের জন্য অল ইন্ডিয়া কিসান খেতমজদুর সংগঠন (এআইকেকেএমএস) দিল্লি ও হরিয়ানা সরকারের কাছে জমি দেওয়ার জন্য দাবি জানাল। সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি সত্যবান এবং সর্বভারতীয় সম্পাদক শঙ্কর ঘোষ বলেন,
১৬ জানুয়ারি পাঞ্জাবের জলন্ধরে সংযুক্ত কিসান মোর্চার জাতীয় সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে সিংঘু এবং টিকরি সীমান্তে কিসান শহিদ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এর জন্য দিল্লি ও হরিয়ানা সরকারের কাছে বিনামূল্যে জমি দেওয়ার জন্য দাবি করা হয়।
জলন্ধর সম্মেলন থেকে সারা দেশের কৃষকদের এই দাবিতে সোচ্চার হয়ে দিল্লি ও হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে চিঠি লেখার আবেদন জানানো হয়েছে।
২০২১-এ বিজেপি সরকার দেশ-বিদেশের একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজিপতিদের স্বার্থে যে তিনটি কালা কৃষি আইন পাশ করেছিল তা বাতিল করার জন্য কৃষকরা তাদের জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। এই কালা কৃষি আইনে বলা হয়েছিল সব ধরনের শস্য, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল ও তৈলবীজ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা মজুতদার ও কালোবাজারিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এপিএমসি বাজারগুলি তুলে দিয়ে কৃষিপণ্যের সম্পূর্ণ ব্যবসা বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। কৃষকদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস কৃষিজমিকে কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চুক্তিচাষের কথা এই আইনে ছিল।
মোদি সরকারের এই কালা আইন যদি বাতিল করা না যেত, গ্রাম এবং শহরের গরিব মানুষ, বিশেষ করে শ্রমজীবী জনগণ অনাহারে মারা যেত এবং চাষি ঋণগ্রস্ত হয়ে তার জমি বিক্রি করতে বাধ্য হত। যে মূল্যবৃদ্ধি অসহনীয় হয়ে উঠেছে তা আরও ভয়াবহ হত। এর ফলে দেশের কৃষক ও খেতমজুররা তাদের জীবন-জীবিকা হারিয়ে কোম্পানির গোলাম হয়ে যেত। এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কৃষকরা দিল্লির রাজপথে মাসের পর মাস অবস্থান আন্দোলন করেছেন। প্রবল তাপদাহ ও ঠাণ্ডা অগ্রাহ্য করে বা নানা অসুস্থতা নিয়েও ধরনায় বসে, জীবন দিয়ে আম্বানি-আদানিদের মতো বৃহৎ পুঁজিপতি ও তাদের সেবাদাস মোদি সরকারকে মাথা নত করতে বাধ্য করে অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক জয় অর্জন করেছেন।
একই সাথে গাজিপুর, ধানসা সীমান্ত এবং শাহজাহানপুর, পালওয়াল ও সুনহেদা সীমান্তেও কৃষকরা ধরনায় বসেছিলেন। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস থেকে শুরু করে একটার পর একটা সরকার যেভাবে কৃষকদের উপর দমন পীড়ন চালাচ্ছে ও পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থবাহী নীতি গ্রহণ করেছে, তা থেকে কৃষকদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, যদি তাদের কৃষিজমি, জমিতে উৎপাদিত ফসল ও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হয় তা হলে পুঁজিপতিদের স্বার্থে তৈরি আইনের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করা ছাড়া বিকল্প কোনও রাস্তা নেই। ঐতিহাসিক এই আন্দোলনের চাপে মোদি সরকার চাষিদের ঋণ মকুব করা ও কমপক্ষে উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে মোদি সরকার চাষিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আন্দোলনকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিতে মোদি সরকার ও এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদী, খালিস্তানি, আন্দোলনজীবী ইত্যাদি শব্দ কৃষকদের দিকে বিষাক্ত তিরের মতো ছুঁড়ে দিয়েছিল, কিন্তু আন্দোলনের গমকে কৃষকরা তা শুকনো পাতার মতো উড়িয়ে দিয়েছিল।
কৃষকদের এই আন্দোলন দেশের জনগণের মন জয় করে নিয়েছিল। ছাত্র, যুব, মহিলা, শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী, দোকানদার এবং বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ দেশের সমস্ত অংশের জনগণ এই আন্দোলনকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিল। এই আন্দোলন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, আঞ্চলিকতা, ভাষা ইত্যাদিকে ভিত্তি করে যে সমস্ত সামাজিক বৈষম্য আছে তা দূর করে সমস্ত মানুষকে এক সূত্রে গেঁথেছিল।
এই আন্দোলনে যে কৃষকরা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের স্মৃতিতে শহিদ স্মৃতিসৌধ তৈরি করা দেশের সমস্ত কৃষক এবং শ্রমিকদের কর্তব্য। সমস্ত ধরনের শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আসন্ন সংগ্রামের জন্য আগামী প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে এই স্মৃতিসৌধগুলি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে চিহ্নিত থাকবে।