সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে একটা খোলা চিঠি দেওয়া হয়েছে। লেখকরা হলেন মানবাধিকার কর্মী। তার মধ্যে রয়েছেন তেলেঙ্গানার মানবাধিকার কর্মী হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দীপক কুমার। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট স্টিফেনস কলেজের অধ্যাপিকা নন্দিতা নারায়ণ সহ মানবাধিকার আন্দোলনের আরও অনেক বিশিষ্টজন। মোট স্বাক্ষরদাতা ১৩৫ জন।
তাঁরা চিঠিতে বেশ কিছু অভিযোগ তুলে ধরেছেন–যা অত্যন্ত গুরুতর। বলেছেন, কাশ্মীর থেকে শুরু করে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ওড়িশা, দিল্লি সহ বিভিন্ন রাজ্যে মানুষের ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদকে, আন্দোলনকে, সরকারি নীতির বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করার অধিকারকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক শক্তির দ্বারা দমন করা হচ্ছে।
যে সব সংবাদকর্মী এই অন্যায়গুলির বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের সপক্ষে লিখছেন, তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে, তাদের খুন করাও হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের হাতিয়ারগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে।
আদিবাসীদের জমি, বসতি উচ্ছেদ করে ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যে একচেটিয়া কর্পোরেট মালিকগোষ্ঠীর খনি তৈরি করা হচ্ছে। প্রশাসনিক শক্তি দিয়ে এই সব এলাকার জনগণের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এই সব এলাকায় সামরিক শিবির প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ওই সব জায়গায় স্থানীয় ভুক্তভোগীরা, যুবক-যুবতী, চাষিরা শান্তিপূর্ণভাবে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। আন্দোলন দমন করার জন্য সব ধরনের নিপীড়ন চলছে। গুলি চালিয়ে হত্যা করা চলছে। মাওবাদী, সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে এদের দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে সাংবাদিকরা সত্য ঘটনা তুলে ধরছেন তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ছত্তিশগড়ের শিলগড়ে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অবস্থানও রেহাই পায়নি। প্রতিবাদ সভা করার জন্য বৈধ অনুমতি নেওয়া থাকলেও কয়েক ঘণ্টা আগে হঠাৎ তা বাতিল করে দেওয়া হয়। দিল্লিতে যন্তরমন্তর হচ্ছে এমন একটা স্থান যেখানে ঐতিহ্যগত ভাবেই প্রতিবাদ সমাবেশ চলে আসছে। ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘ ঘোষিত মানবাধিকার দিবস উদযাপনের জন্য ১২ দিন আগে সভা করার আগাম অনুমতি থাকলেও শেষমুহূর্তে তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ২০টি সংগঠন মিলিত ভাবে এই ডাক দিলেও সরকারের কাছে তা গুরুত্বহীন। প্রতিবাদস্থল পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল। কোনও ব্যক্তি মালিকানাধীন এলাকায় বা হলে প্রতিবাদী সভা করার অনুমতি থাকলেও মালিককে এমনকি খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, যাতে অনুমতি বাতিল করে।
শ্রীনগর বা শিলগড়ের মতো সারা দেশেই গণতান্ত্রিক অধিকার আজ বিপন্ন। শিলগড়ে গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গণে বক্তা ছিলেন জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হুসেন মাসুদি। হঠাৎ তা বন্ধ করে দেওয়া হল। সাংবাদিকরা নিষিদ্ধ হলেন। জমায়েত নিষিদ্ধ হওয়ায় নূ্যনতম বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের সুযোগ কেড়ে নেওয়া হল, প্রশাসনিক শক্তি এলাকা ঘিরে রেখে দিল।
যে কোনও গণপ্রতিবাদ, স্বাধীন মত প্রকাশ করলে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী-নেতা, লেখক কেউ রেহাই পায় না। তাদের কখনও অপহরণ করা হয়, গায়েব করে দেওয়া হয়, খুন করে দেওয়া তো আছেই। বহু ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার মিথ্যা গল্প প্রচার করে এনকাউন্টারের নামে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
দেশে এমন একটা অবস্থা—যা গণতন্ত্রের প্রাথমিক ও মৌলিক অধিকারগুলিকে অনায়াসে পদদলিত করছে। আইনসভা, বিচারবিভাগের আপেক্ষিক স্বাধীনতা ধ্বংস করে চূড়ান্ত প্রশাসনিক দৃঢ় কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গণতন্তে্রর নামে, পার্লামেন্টের ঠাটবাট বজায় রেখে এই যে ব্যবস্থা—তাকে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি? একচ্ছত্র সামরিক শাসনের চেয়ে গণতন্তে্রর আলখাল্লা চাপানো এই কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা অনেক ধূর্ততার সঙ্গে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে। দিন দিন তাকে শক্তপোক্ত করা চলছে। তাই এইসব মানবাধিকার নেতা-কর্মীদের উত্থাপিত দাবিগুলি আজ কোটি কোটি সাধারণ মানুষের দাবি হয়ে উঠেছে।
প্রধান বিচারপতির কাছে এই সব অভিযোগের বিচার চেয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। কিন্তু বিচারবিভাগও যেভাবে সরকারের কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে, তাতে কতটুকু সুবিচার মিলবে প্রশ্ন থেকেই যায়। কাজেই শেষ পর্যন্ত জনগণের আন্দোলন ছাড়া কোনও রাস্তা খোলা নেই।