কাশ্মীরের মানুষের ভালমন্দের দায়িত্ব কার? সরকারের না সেনাবাহিনীর! কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ সম্প্রতি কাশ্মীরে গিয়ে যা বলে এসেছেন, তার মানে শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় এটাই যে, কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের বড় অংশের মানুষের ভাগ্যকে ছেড়ে দিয়েছেন একদিকে সেনাবাহিনী, অন্য দিকে নানা গোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদীদের দ্বন্দ্বের মধ্যেই। তিনি পুঞ্চের টোপা মাস্তানদারার গ্রামে গিয়ে সেনাবাহিনীর অত্যাচারে নিহত নিরীহ তিন ভারতীয় নাগরিকের পরিবারকে সহানুভূতি জানাতে গিয়ে বলেছেন, সেনাবাহিনীর কাজ ‘জাতিকে রক্ষা’ করা এবং ‘মানুষের মন জয় করা’। কাশ্মীর ছাড়া দেশের অন্যত্র যে কোনও বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে বিষয়টি অদ্ভূত শোনাবে, কারণ সেনাবাহিনীর কাজ বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা করা। তাঁরা অবাক হবেন যে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী কথিত এই দুটি কাজ কবে থেকে ভারত সরকার সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দিল! ‘জাতি’ বলতে মন্ত্রীমশাই কী বলতে চেয়েছেন, তিনিই জানেন। কিন্তু মানুষের মনের খবর রাখার কথা তো নির্বাচিত সরকারের!যদিও কাশ্মীরবাসী মাত্রই রাজনাথজির তত্ত্বকে হাড়ে হাড়ে বুঝবেন, যেমনটা তাঁরা বুঝে চলেছেন বছরের পর বছর ধরে।
২০১৯-এর ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের পর থেকে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার জোরগলায় বলে চলেছে কাশ্মীরের মানুষের জীবন এখন নতুন খাতে বইছে। সন্ত্রাসবাদী হামলা, সরকারবিরোধী বিক্ষোভ এখন অতীত, শান্তির বাতাস মৃদুমন্দ নয়, বইছে একেবারে ঝড়ের গতিতে। উন্নয়নের স্রোত একেবারে জোয়ারে পরিণত হয়েছে। অথচ ২১ ডিসেম্বর পুঞ্চের ডেরা কি গলি এবং বাফলিয়াজ এলাকার কাছে সন্ত্রাসবাদী হামলায় পাঁচজন সেনা জওয়ান নিহত হলেন। তার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সেনাবাহিনী টোপা মাস্তানদারা গ্রামের আট বাসিন্দাকে তুলে নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে। পরের দিন পুলিশের দেওয়া খবর অনুযায়ী গ্রামবাসীরা সেনা ক্যাম্পে গিয়ে তার মধ্যে তিন জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। বাকি পাঁচজন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। এই হত্যাকে কেন্দ্র করে জনবিক্ষোভ সামাল দিতে নিহত এবং আহতদের পরিজনকে কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়ে এসেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। শোনা গেছে সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেডিয়ার সহ তিনজন কর্মী সাসপেন্ড হয়েছেন। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের দায় এক’দুজন সেনাকর্মীর ওপরে চাপিয়েই কি সরকার হাত ধুয়ে ফেলতে পারে? কাশ্মীর এখন প্রত্যক্ষভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন, তাহলে এমন ঘটনার দায় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা নেবেন না কেন?
গ্রামবাসী যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁরা অত্যন্ত দরিদ্র পশুপালক গুজ্জর এবং বকরেওয়াল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। ভেড়া, ছাগলের পালের খাদ্য জোগাড়ের কারণে তাঁরা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। তাঁদের সাথে সন্ত্রাসবাদীদের যোগাযোগের কথা সরকার কিংবা সেনাবাহিনী কোনও দিনই বলতে পারেনি। বরং ১৯৯০ থেকে বহু বছর ধরে নানা ঘটনায় এই গোষ্ঠীর মানুষ তাঁদের চলাচলের বনাঞ্চল, তৃণভূমি কিংবা গ্রামে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর যাতায়াতের বিরোধিতা করার ফলে তাদের রোষের সামনে পড়েছে।অন্যদিকে সেনাবাহিনীর জুলুমও তাদের সইতে হয়েছে।
এছাড়াও বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে জম্মু এলাকায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এই গোষ্ঠীর মানুষকে বহিরাগত, দখলদার বলে চিহ্নিত করে একাধিকবার আক্রমণ করেছে। ২০১৮-তে জম্মুর কাঠুয়ায় এই সম্প্রদায়ের ৮ বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে হত্যা করার ঘটনা ঘটলে বিজেপির নেতারা এমনকি এক মন্ত্রীও ধর্ষকদের সমর্থন জানিয়ে মিছিল করেছিলেন। কাশ্মীরের মানুষ জানেন, বিজেপি মদতপুষ্ট সংগঠনগুলি ও সরকারের ভূমিকাই গুজ্জর-বকরেওয়াল সম্প্রদায়ের মানুষকে সরকার ও সেনার প্রতি বিরূপ করে তুলেছে। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর মন্ত্রীরা কাশ্মীরের অনেক উন্নয়নের গল্প ভারত জুড়ে শুনিয়েছেন। কিন্তু কাশ্মীরের অন্যান্য গরিব মানুষের মতো গুজ্জর-বকরেওয়াল গোষ্ঠীর মানুষের জীবন এতটুকু বদলায়নি। সে রাজ্যের জনগণের শিক্ষা, চাকরি, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ কোনও কিছুর অভাবই সরকার পূরণ করেনি। ৩১ ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার কলকাতা সংস্করণ লিখেছে, পুঞ্চে সামান্য একটা খেলার মাঠ তৈরির আর্জিও সরকার না মানায় মানুষকে চাঁদা তুলে তার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।
সম্প্রতি কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা সংক্রান্ত মামলাতে সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছে দীর্ঘকাল ধরে আইন শৃঙ্খলার বিষয় সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে রাখা যায় না। যদিও সে রাজ্যে দীর্ঘকাল ধরে চালু আছে সশস্ত্র বাহিনীর হাতে বিশেষ ক্ষমতার আইন ‘আফস্পা’। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার অজুহাতে এই আইন অতীতে কংগ্রেস চালু করেছিল, এখন জনগণকে দমিয়ে রাখতে তা বিজেপি পরিচালিত সরকারের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।এর সাথে আছে সন্ত্রাসবাদ দমনের বিশেষ আইন ইউএপিএ, কাশ্মীরে সরকারের বিশেষ হাতিয়ার পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট ইত্যাদি।
আফস্পার বলে সেনাবাহিনী কোনও মানুষকে যে কোনও সময় হত্যা পর্যন্ত করতে পারে। তার জন্য তাদের কোনও কৈফিয়ৎ দিতে হয় না। এর ফলে মানুষের জীবনে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তার একটি উদাহরণই বোধহয় যথেষ্ট, ২০২০-তে শোপিয়ান জেলার আমসিপোরা গ্রামে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে তিনজন গুজ্জর যুবককে মিথ্যে এনকাউন্টারে গুলি করে মারে এক সেনা অফিসার। দীর্ঘ তদন্তের পর কোর্ট মার্শালে প্রমাণ হয় প্রমোশনের দিকে তাকিয়ে এই মিথ্যে এনকাউন্টার করা হয়েছিল। অফিসারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু এই বছর নভেম্বরে আর্মড ফোর্সেস ট্রাইবুনাল ওই অফিসারের শাস্তি মকুব করে জামিন দিয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, দ্য ওয়্যার সরকারি তথ্য উদ্ধৃত করে দেখিয়েছে, পিরপঞ্জল এলাকায় যেখানে অতীতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের কথা কদাচিৎ শোনা যেত সেখানে শুধু ২০২৩-তেই ২৪ জন সরকার ঘোষিত সন্ত্রাসবাদী, ২১ জন সেনাকর্মী এবং ১০ জন সাধারণ মানুষ সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন। সারা কাশ্মীরে সংখ্যাটা সব মিলিয়ে প্রায় দুশো। কোন দিকে কাশ্মীরের পরিবর্তনের কথা বলছেন নরেন্দ্র মোদিজিরা! কাশ্মীরকে কাছে টানার দিকে, না আরও দূরে ঠেলে দেওয়ার পথে!