ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অমর শহিদ বীরাঙ্গনা কনকলতা বরুয়া। তাঁর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রখ্যাত সাহিত্যিক নিরুপমা বরগোহাইকে সভাপতি এবং জিতেন চলিহা ও ময়ূখ ভট্টাচার্যকে যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত করে ‘সারা আসাম শহিদ কনকলতা জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি’ গঠিত হয়েছে। ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে কনকলতার ভূমিকা, তাঁর চরিত্রের অনুকরণীয় দিকগুলি সমাজের সর্বস্তরে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
শহিদ কনকলতা ১৯২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর দরং জেলার গহপুরের কাছে বরঙ্গাবাড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪২ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে একজন সাধারণ স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেন এবং ২০ সেপ্টেম্বর গহপুর থানায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করে পুলিশের গুলিতে শহিদের মৃত্যুবরণ করেন।
একজন সাধারণ নারী হিসাবে কনকলতার শিক্ষা-দীক্ষা, নাম, যশ, খ্যাতি, রাজনৈতিক কেরিয়ার এসব কিছুই ছিল না। কিন্তু মাত্র ১৭ বছর বয়সে অকৃত্রিম দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা, অসীম নির্ভীকতা ও সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের দৃঢ়চিত্ততা দেখিয়ে তিনি নিজের অসাধারণত্ব প্রমাণ করেছিলেন। আজকের মতো সেদিনও ছিল আত্মবিক্রয়ের, আখের গুছিয়ে নেওয়ার সুবিধাবাদী রাজনীতি। ছিল বিরোধিতার নামে ব্রিটিশের তোষামোদ, ভীরুতা, কাপুরুষতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা। কিন্তু সেগুলোর কোনও কিছুই কনকলতাকে স্পর্শ করতে পারেনি। অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করে তার প্রতিবাদের মধ্যেই যে মূল্যবোধ নিহিত থাকে, কঠিন সত্যকে গ্রহণ করতে না পারলে যে প্রকৃত মানব জীবন গড়ে উঠতে পারে না, আত্মবলিদানের মাধ্যমে এই মূল্যবোধগুলিই দেখিয়ে দিয়ে গেলেন কনকলতা।
শিশু বয়সে মাতৃহারা কনকলতা ঠাকুরদা ঘনকান্ত বরুয়ার তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। প্রাথমিক স্কুল শিক্ষার পর সেই সময়ের প্রথা অনুযায়ী তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত হলেও ছোট বয়স থেকেই জানা, বোঝা ও সত্যানুসন্ধানের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আকাঙক্ষা। বরঙ্গাবাড়ির বরুয়া পরিবারে তখন বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর যাতায়াত ছিল, মামারাও ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ঘরোয়া রাজনৈতিক পরিবেশেই কনকলতা দেশের জনসাধারণের পরাধীনতার দুঃখ-যন্ত্রণা অনুভব করতে পেরেছিলেন এবং নিজের অজান্তেই তাঁর মনের মধ্যে দেশপ্রেম এবং কর্তব্যবোধ জেগে উঠেছিল। মামা দেবেন বরার কাছ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন ও ব্রিটিশের অন্যায় অত্যাচারের কাহিনী শুনে শুনে কনকলতার মনে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার জন্ম হয়েছিল। মামার হাত ধরেই কনকলতা যোগ দিয়েছিলেন বিভিন্ন ব্রিটিশ বিরোধী সভা-সমিতিতে এবং সেখানে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার উদ্দীপনাময় দেশাত্ববোধক গান শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং সেই পথেই তাঁর দেশের জন্য কিছু করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মন-মানসিকতা গড়ে উঠেছিল।
দেশে তখন এক দিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আবহাওয়া এবং অন্যদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ বাহিনীর আপসহীন অভূতপূর্ব সংগ্রাম। এই পরিবেশে আপসহীন বিপ্লবীদের চাপে গান্ধীজিকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিতে হয়। আসামে এই আন্দোলনে স্ফূলিঙ্গের প্রকাশ ঘটে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মৃত্যুবাহিনীর মাধ্যমে। অনেক পুরুষের পাশাপাশি বহু মহিলাও এই মৃত্যুবাহিনীতে নাম নথিভুক্ত করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী জাগরণের ক্ষেত্রে আসামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন চন্দ্রপ্রভা শইকিয়ানী এবং পুষ্পলতা দাস। পুষ্পলতা দাসের পরিচালনায় বরঙ্গাবারী জারনিয়াল সত্রে মহিলাদের সভায় মৃত্যুবাহিনীতে নাম লেখানোর জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠেন কনকলতা। বয়স ১৮ বছর না হওয়ার জন্য নেতৃত্ব তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাননি। তাঁর বারংবার অনুরোধে তাঁর নাম পরে অন্তর্ভুক্ত হয়। এভাবেই দৃঢ়তা, সাহস, প্রগাঢ় দেশপ্রেম ও মুক্তির আকুতির জন্যই তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সমর্থ হন।
১৯৪২ সনের ২০ সেপ্টেম্বর। গহপুর এবং ঢেকিয়াজুলিতে ব্রিটিশ থানায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকে ঘিরে বিপুল জনজাগরণের সৃষ্টি হয়। প্রায় সব নেতা আগেই গ্রেপ্তার হওয়ার ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয় তা পূরণ করতে সেদিন জনগণ এগিয়ে এসে সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বরঙ্গাবাড়ি থেকে গহপুর থানার দিকে হাজার হাজার জনতার দৃপ্ত মিছিলের সামনে তখন কনকলতা। চোখে-মুখে, চলার ভঙ্গিতে তাঁর প্রত্যয়ভরা বিশ্বাস, করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে। থানার সামনে পুলিশের বিশাল বাহিনীর দুর্ভেদ্য বাধা উপেক্ষা করে পতাকা হতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন কনকলতা। পুলিসের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ়তার সাথে বললেন, ‘অনুগ্রহ করে আমাদের রাস্তা ছেড়ে দিন, আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশের জনতার স্বার্থে আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করবই।’ সাথে সাথে ভয়ঙ্কর শব্দে কেঁপে উঠল চারিদিক। ব্রিটিশ পুলিশের গুলি বক্ষ ভেদ করে নিরস্ত্র কনকলতার। পাশে থাকা মুকুন্দ কাকতি পতাকা তুলে ধরলে তিনিও শহিদের মৃত্যু বরণ করেন। গহপুরের রক্তসিক্ত মাটিতে রচিত হল স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
শহিদ কনকলতা জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে গত ২২ ডিসেম্বর রাজ্যব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পালন করা হয়। গুয়াহাটিতে সুসজ্জিত শোভাযাত্রা উলুবারী ভলভো পয়েন্ট থেকে লক্ষ্মীরাম বরুয়া সদন পর্যন্ত পরিক্রমা করে। কমিটির তত্ত্বাবধানে একশো জন কিশোর-কিশোরী শহিদ কনকলতার ছবি সংবলিত পতাকা হাতে হাতে নিয়ে মার্চ করে।
লক্ষ্মীরাম বরুয়া সদনে এক গাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানে কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রবীণ সদস্য তরেণ বড়ো পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন। কমিটির উপ-সভাপতি ডাঃ চিত্রলেখা দাস এবং উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তি ও জনতা শৃংখলাবদ্ধ ভাবে শহিদ কনকলতার প্রতিকৃতিতে মাল্যার্পণ করেন। একশোজনের কিশোরবাহিনী গার্ড অফ অনার জানায়। কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক জিতেন্দ্র চলিহার পরিচালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করেন কমিটির উপ-সভাপতি সুভাষ গোস্বামী। সভায় বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী তরেণ বড়ো, ডাঃ চিত্রলেখা দাস ও বিশিষ্ট নিবন্ধকার, লেখক শ্রী জিতেন শর্মা। আজকের এই চরম সামাজিক অবক্ষয়ের অন্ধকার সময়ে তরুণ প্রজন্ম যখন সমাজবিমুখ মানসিকতার শিকার, তখন শহিদ কনকলতা বরুয়ার জীবনসংগ্রাম চর্চা কীভাবে আলোকবর্তিকার কাজ করতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা করেন বক্তারা।
আসামের বরাক, ব্রহ্মপুত্র, উজান ও নিম্ন আসামের সর্বত্র শহিদ কনকলতা জন্মশতবর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়েছে। শিলচর, হাইলাকান্দি, তেজপুর, যোরহাট ও গুয়াহাটিতে সুসজ্জিত মিছিল এবং আলোচনাসভা-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। তাছাড়া করিমগঞ্জ, নগাঁও, উত্তর লক্ষ্মীমপুর, গোয়ালপাড়া, ধুবরী, নলবারি, মঙ্গলদৈ, টংলা, বাইহাটা চারিআলী, তামুলপুরে শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠান, আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।