ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ সহ কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচনী সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, রেশনে প্রতি মাসে কার্ড প্রতি ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য সরবরাহ করার কর্মসূচি তিনি আগামী পাঁচ বছর, অর্থাৎ ২০২৮ সাল পর্যন্ত চালিয়ে যেতে চান। দেশে কেউ ক্ষুধা নিয়ে ঘুমোতে যাক–এটা তিনি নাকি চান না! চমৎকার স্বীকারোক্তি! প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষণার দ্বারা সরাসরিই স্বীকার করে নিলেন দেশে বিরাট সংখ্যক মানুষ ক্ষুধার্ত। স্বীকার করে নিলেন, যে ৮১ কোটি মানুষ প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় কয়েক বছর ধরে রেশনের চাল পেয়ে আসছেন, তাঁদের খাদ্য নিরাপত্তা নেই। সরকার রেশনে খাদ্য না দিলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে ক্ষুধা নিয়েই ঘুমোতে যেতে হবে। এই ঘোষণার দ্বারা প্রধানমন্ত্রী এও দেখিয়ে দিলেন বিধানসভা ভোটে বিজেপির জয়কে যতই তিনি উন্নয়নের জয় বলুন না কেন, তাঁর রাজত্বকালে মানুষের অবস্থা কেমন শোচনীয়! দেখা গেল, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে কেন্দ্রীয় সরকার আয়োজিত ‘অমৃত মহোৎসব’-এর রোশনাই সিংহভাগ মানুষের আর্থিক দৈন্য ঢাকতে পারেনি।
এই ঘোষণাটি প্রধানমন্ত্রী করেছেন কোথায়? বিজেপির নির্বাচনী মঞ্চে। তিনি পার্লামেন্ট থেকে এ ঘোষণা করেননি। নির্বাচিত সাংসদদের সাথে আলোচনা করে তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। স্বাভাবিকভাবেই একে ভোটের চাল বলছেন অনেকেই।
ভোট একটা গণতান্ত্রিক অধিকার। তাই স্বাধীনভাবে নাগরিকের সচেতন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পরিবেশ বজায় রাখা একটা সুস্থ নির্বাচন ব্যবস্থায় কাম্য। প্রধানমন্ত্রী ঠিক এই জায়গাটাতেই মারাত্মক আঘাত করলেন। মানুষের আর্থিক দুর্দশার সুযোগ নিয়ে সামান্য চালের বিনিময়ে প্রভাবিত করে তাঁদের ভোট নিজের দলের দিকে টানার এক হীন ষড়যন্ত্র করলেন।
ভোটের জন্য খয়রাতি এখন সারা দেশে চালু করে দিয়েছে ভোটসর্বস্ব সব দল। তামিলনাড়ূতে জয়ললিতার ‘আম্মা ক্যান্টিনক্স বা ‘দু-টাকার চালক্স দেওয়া, নানা সুবিধা দেওয়া এখন সব রাজ্যেই ভোট কেনার প্রচলিত মাধ্যম। যতদিন যাচ্ছে, ভোটের আগে ব্যক্তি ধরে ধরে গিফট দেওয়ার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। এক একটা ভোটের জন্য কে কত বেশি দাম দিতে পারে তার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা চলছে। সদ্য অনুষ্ঠিত পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে যা নগ্ন ভাবে ঘটেছে। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি, ‘লাডলি বহেনা’ স্কিমে ১ কোটি ৩০ লক্ষ মহিলাকে মাসে ১২৫০ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কংগ্রেসও নারী সম্মান যোজনার নামে ১৫০০ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কংগ্রেস বেশি দিচ্ছে জেনে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মাসে ৩০০০ টাকা করে দেওয়ার। ভোটকে এরা নিলামের জায়গায় নিয়ে এসেছে। পুঁজিবাদের দৌলতে ভোটাধিকার হয়ে গিয়েছে কেনাবেচার পণ্য। তৃণমূল কংগ্রেস এ রাজ্যে যে পাঁচ টাকার ডিম-ভাতের লঙ্গর চালাচ্ছে বা ইমাম ভাতা, পুরোহিত ভাতা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ইত্যাদি প্রকল্প চালাচ্ছে– অথবা কৃষক বন্ধু প্রকল্পে কিছু নগদ অর্থ উপভোক্তার অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে– তার রাজনৈতিক দিকটি অবশ্যই গণতন্ত্রের মর্যাদাকে অবনমিত করে ভোট ক্রয়। কিন্তু এর একটি অর্থনৈতিক দিকও আছে।
কেন টাকার বিনিময়ে ভোট কেনা হচ্ছে? যে বিজেপি উগ্র হিন্দুত্বে মাতিয়ে ভোট করার নজির গড়েছে, মন্দির বানাচ্ছে, মুসলিম বিদ্বেষী আওয়াজ তুলে মেরুকরণ ঘটাচ্ছে, ব্রিগেড মাঠে গীতা পাঠের কর্মসূচি নিয়েছে, সেই বিজেপিকে কেন নানা প্রকল্পের ছদ্মবেশে জনগণকে অর্থ ভিক্ষা দেওয়ার কর্মসূচি নিতে হচ্ছে? কারণ, জনজীবনে প্রবল অর্থনৈতিক সঙ্কট জীবনের অন্য সমস্যাগুলিকে ছাপিয়ে উঠছে। খালি পেটে তো আর ধর্ম হয় না! ধর্মের মালা জপ করে কম দামে জীবনদায়ী ওষুধ পাওয়া যায় না। কাজ চাই, চাকরি চাই, ন্যায্য মজুরি চাই, বিনামূল্যে শিক্ষা-চিকিৎসা চাই– জনগণের এই সব দাবি পূরণের কোনও প্রতিশ্রুতি বা দিশা কোনওটিই বিজেপির ঝুলিতে নেই। বরং জ্বল জ্বল করেছে ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা। বছরে ২ কোটি চাকরি র প্রতিশ্রুতি ভাঁওতা বলে প্রমাণিত হয়েছে। মোদি ক্ষমতায় আসার আগে গ্যাস সিলিন্ডার সাড়ে চারশো টাকায় পাওয়া যেত। এর দাম এখন হাজার টাকার কাছাকাছি। সরকারি ভর্তুকি কমাতে কমাতে ১৯ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। মোদির ৯ বছরের শাসনে লাভবান হয়েছে কেবল আদানি, আম্বানিদের মতো একচেটিয়া পুঁজিপতিরাই। আবার রাজ্যে রাজ্যে যে দলগুলি ক্ষমতায়, তাদের শাসনও পুঁজিপতিদেরই সুবিধা দিচ্ছে! আর এই পুঁজিপতি তোষণের সমস্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জনসাধারণের উপর। ফলে সর্বত্র প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া। এই ক্ষোভকে প্রশমিত করে ভোট পেতেই সব রাজ্যে খয়রাতি প্রকল্পের ছড়াছড়ি।
খয়রাতি প্রকল্প পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রয়োজনেই। এই প্রয়োজনটি বুঝতে, অক্সফাম রিপোর্টের দিকে তাকাতে হবে। অক্সফাম রিপোর্ট দেখিয়েছে, ভারতের জাতীয় সম্পদের ৪১ শতাংশের মালিক জনপিরামিডের সবচেয়ে উপরের অংশে থাকা ১ শতাংশ। আর ৫০ শতাংশ সাধারণ মানুষের সম্পদ মোট জাতীয় সম্পদের ৩ শতাংশ। এই যে বিভাজন, এই যে বিরাট বৈষম্য, এটা তো আকাশ থেকে পড়েনি। এটা বিদ্যমান পুঁজিবাদী শোষণ-শাসনেরই ফল। স্বাধীনতার ৭৫ বছর ধরে যে শাসন ধারা কংগ্রেস ও বিজেপি পালাক্রমে চালিয়ে যাচ্ছে, তার সম্মিলিত ফল জনগণের এই আর্থিক দৈন্য এবং পুঁজিপতিদের বিপুল ধনস্ফীতি– যা অক্সফাম রিপোর্টে ধরা পড়েছে।
আর একটি বিষয়ও লক্ষণীয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার প্রায় প্রতিটি পণ্য থেকে যে জিএসটি আদায় করে থাকে তার ৬৪ শতাংশ দিয়ে থাকে নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষ। আর উপরের দিকে ১০ শতাংশ মানুষ, যারা অতি ধনী তারা মাত্র ৩ শতাংশ দেয়। অর্থাৎ যাদের সম্পদ কম, তাদের উপরই ট্যাক্সের বোঝা বেশি। আর যারা বিপুল সম্পদের মালিক তাদের দিতে হয় সামান্য ট্যাক্স। এই যে সাধারণ মানুষের উপর বিপুল ট্যাক্সের বোঝা, সেটা কমানোর কোনও ইচ্ছা বা চেষ্টা কোনও সরকারেরই নেই। ফলে বৈষম্য বেড়েই চলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মোদিজি ঘোষণা করেছেন, ২০২৯ সালের মধ্যে ভারতকে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত করতে চান। সে জন্য অর্থনীতিকে তিনি এই সময়ের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে চান। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটুক– সবাই চায়। কিন্তু তার সুফল কী ভাবে ৮১ কোটি মানুষের জীবনে পৌঁছবে? এর দ্বারা কি তাঁদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে? তাঁদের ভেঙে পড়া খাদ্য নিরাপত্তা কি মজবুত হবে? বিশ্ব অর্থনীতির প্রথম, দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশগুলিতে সাধারণ মানুষের জীবনের অর্থনৈতিক সঙ্কট কি আদৌ দূর হয়েছে? করোনা অতিমারি দেখিয়ে দিয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ আমেরিকার ভিতরের চেহারাটা। লাখে লাখে মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরছে। কারণ, পুঁজিপতিদের স্বার্থে পরিচালিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পুঁজিপতিদের স্বার্থ নির্ভর করে জনস্বার্থ লঙ্ঘনের উপর। ফলে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি দেশের সাধারণ মানুষের কোনও কাজে আসবে না। অবশ্য তা বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভারতের পুঁজিপতিদের প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা বাড়াবে– এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়।
অক্সফাম রিপোর্ট ভারতের সাধারণ মানুষের যে অর্থনৈতিক সঙ্কট তুলে ধরেছে, সেই প্রেক্ষাপটে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর থেকেও সাধারণ মানুষের আশা করার বিশেষ কিছু নেই। শিল্পমেলা, শিল্পসম্মেলন ইত্যাদি করার মধ্য দিয়ে লগ্নি ও চাকরির আশা জাগানোর চেষ্টা হলেও সেগুলি কোনও কাজে আসছে না। কারণ অর্থনীতি ঝিমোচ্ছে। ঝিমিয়ে পড়া পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে সাময়িকভাবে হলেও খানিকটা চাঙ্গা করার জন্য সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির তত্ত্ব দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ কেইনস। সেই তত্ত্ব অনুযায়ী সরকার বিভিন্ন খয়রাতি প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ করে থাকে। উপভোক্তাদের কাছে টাকা পৌঁছলে তাকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ বাজার খানিকটা চাঙ্গা হয়। পুঁজিপতিদের মাল বিক্রি গতি পায়। ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্প, গরিব কল্যাণ যোজনা ইত্যাদি এই তত্ত্বেরই ব্যবহারিক প্রয়োগ। ফলে বাইরের দিক থেকে প্রকল্পগুলির একটা জনদরদি মুখোশ থাকলেও সরকারি ব্যয়ে পুঁজিপতিদের মাল বিক্রির বাজার কৃত্রিমভাবে তৈরি করে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। একে জনদরদ ভাবা, হয় প্রতারণা অথবা বোকামি।
৫ বছরের জন্য রেশনে চাল সরবরাহের যে কর্মসূচি তাতে প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হবে। অর্থাৎ উপভোক্তারা সামগ্রিকভাবে এই টাকাটা খাদ্যের জন্য খরচ না করে অন্যান্য জিনিস কেনায় খরচ করতে পারবে। ৫৩টি মন্ত্রকের অধীনে এ রকম ৩১০টি প্রকল্প চালানো হয়, যার মধ্য দিয়ে উপভোক্তাদের অ্যাকাউন্টে কিছু নগদ টাকা পৌঁছে যায়। একে ভিত্তি করে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার খানিকটা চাঙ্গা হয়। এ ভাবে সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্র-রাজ্যের সব সরকার। মৃতপ্রায় পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে এভাবে ঠেকনা দিয়ে কতদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে? দেউলিয়া পুঁজিবাদী অর্থনীতির উপরিকাঠামো সংসদীয় রাজনীতিও তাই আজ দেউলিয়া। তারই অনুষঙ্গ হিসাবে সুবিধা দিয়ে ভোট আদায়, টাকা দিয়ে ভোট কেনা–হয়ে উঠেছে সব শাসকের দস্তুর।